পাহাড়ে শান্তি চাইলে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ফর্মুলাতেই যেতে হবে

fec-image

জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই সরকার দেশের সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ব্যাপক প্রশংসা ও সমর্থন পাচ্ছে। এর ফলে হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরছে পরাজিত অপশক্তি এবং তার দোসররা। এমনকি ঘোষণা দিয়েই তারা মাঠে নেমেছে, এই সরকারকে একদিনের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেবে না বলে। একদিকে নিজেদের অপমানজনক পরাজয়, আর অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমর্থন ও গ্রহণযোগ্যতা তাদের অন্তর্জ্বালা ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। তাই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে তারা সংখ্যালঘুসহ নানা শ্রেণিপেশার ছদ্মাবরণে একের পর এক আন্দোলন নিয়ে হাজির হচ্ছে। ইতোমধ্যে তার বেশিরভাগই স্তিমিত করা সম্ভব হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা এখনো বিদ্যমান, যেমন পোশাক খাত, পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তেজনা ইত্যাদি। এসব সমস্যা নির্মূল করা একটু সময় সাপেক্ষ হলেও অসম্ভব কিছু না। তবে সে ক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে কার্যকর কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে এবং দৃঢ়তার সাথে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর যেসব ষড়যন্ত্র ও সংকট হতে পারে, তার স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য আমাদের একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে। বিশেষ করে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পরের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলেই এ বিষয়ে আন্দাজ-অনুমান করা অসম্ভব কিছু না। বিষয়টা আঁচ করতে পেরেই গত ৩১ আগস্ট ‘ভারতের মদদে পাহাড়ে প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা এবং আওয়ামী লীগের পতন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে যাচ্ছে সে ব্যাপারে সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা করে বলা আছে। এর পরের ঘটনাপ্রবাহ আমরা কী দেখলাম, ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি-অবাঙালিরা দুই দফায় সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এতে অন্তত ৬ জন নিহত এবং বেশ কিছু মানুষ আহত হয়েছে। দোকান-পাটে অগ্নিসংযোগ, এমনকি মসজিদ-কিয়াংয়ে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হলেও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। ফলে পাহাড়ে বসবাসকারী সাধারণ মানুষের মনে আতঙ্ক-অবিশ্বাস বাড়ছে।

ছাত্র-জনতার বিপ্লব সফল হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালি জনগোষ্ঠির দুই-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া মোটাদাগে সবাই সরাসরি এ আন্দোলনের বিপক্ষে ছিল। সারাদেশে যখন ছাত্র-জনতা সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন করছে, তখন পাহাড়ের অবাঙালিরা তাদের ৫% কোটা বহাল রাখার দাবিতে মিছিল-মিটিং করে যাচ্ছিল। ১৬ জুলাই আন্দোলনকে চূড়ান্তভাবে দমনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকার ব্যাপকভাবে যখন গুলি চালিয়ে ৬ শিক্ষার্থীকে শহীদ করলো এবং তার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমেই সরকার পতনের এক দফার দিকে দাবিত হলো, তখনো পাহাড়ের অবাঙালিরা নিজেদের কোটার দাবিতে মাঠে ছিল। কিন্তু যেই দেখেছে ৫ আগস্ট সরকারের পতন হয়ে গেছে, তখনই তারা ভোল পাল্টিয়ে নিজেরাও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের জামা গায়ে পরে। নিজেদের বৈষম্যবিরোধী দাবি করে বৈষম্য সৃষ্টিকারী সেই কোটার দাবিতেই ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। বিপ্লবীরা যখন তাদের সাফল্যগাথা হিসেবে সারাদেশে ব্যাপকভাবে আন্দোলনের স্লোগান, ঘটনাবলী গ্রাফিতি এঁকে বিপ্লবের স্মৃতিকে ধরে রাখায় মনোযোগ দিল, তখন পাহাড়ের অবাঙালিরা সেই সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিতর্কিত ও ষড়যন্ত্রমূলক গ্রাফিতি আঁকা শুরু করে। এসবের মাধ্যমে একদিকে যেমন তারা বিপ্লবের পক্ষে না থেকেও নিজেদের বিপ্লবী হিসেবে জাহির করার পাঁয়তারা করল, তেমনি সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাদের পুরানো অভিসন্ধিমূলক বিভিন্ন অসাংবিধানিক দাবি-দাওয়াকে সামনে নিয়ে আসতে থাকলো, যা স্বাভাবিকভাবেই বিপ্লবে অংশ নেয়া বাঙালিদের মধ্যে ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকেই বাড়তে থাকে দু’ পক্ষের উত্তেজনা।

এই উত্তেজনার মধ্যেই খাগড়াছড়িতে মো. মামুন নামের এক যুবককে তার ফার্নিচারের দোকান থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়। পরের দিন তার লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, মামুন চোর, তার নামে আগেও মামলা আছে। ঘটনার দিনও সে হোন্ডা চুরি করতে গিয়ে একসিডেন্ট করে, পরে ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হয়। আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মামুন হত্যার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে দেখা যায় তাকে মাটিতে চেপে ধরে বেশ কয়েকজন অবাঙালি নারী-পুরুষ নির্যাতন করছে। এই ফুটেজ দেখে বাঙালিরা ক্ষুব্ধ হয়, দীঘিনালা কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ মিছিল বের করে। মিছিল নিয়ে দীঘিনালা বাজারের লারমা স্কয়ারে পৌঁছালে কিছু অবাঙালি যুবক তাদের বাধা দেয়ার চেষ্টা করে, অন্যদিক থেকে মিছিলকারীদের উপর গুলি করা হয়। ফলে উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। শুরু হয় বাঙালি-অবাঙালি দাওয়া-পাল্টা দাওয়া। একপর্যায়ে বাজারের বিভিন্ন দোকান-পাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এর ফলে বাঙালিদের ৫৬টি এবং অবাঙালিদের ৫০টির মতো দোকান পুড়ে যায়।

দীঘিনালার ঘটনায় দুই পক্ষের বেশ কিছু মানুষ আহত হয়, তার মধ্যে একজনের অবস্থা ছিল আশঙ্কাজনক। ঠিক সেই সময় ফেসবুকে বিভিন্ন আইডি এবং পেজ থেকে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হতে থাকে। এমনকি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ফ্যান পেইজ থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ৬৭ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রচার করা হয়। ফলে পার্বত্য তিন জেলাতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ওইদিন সন্ধ্যায় খাগড়াছড়ি সদরে অবাঙালিরা সংঘটিত হয়ে মাঠে নামে। তাদের প্রতিরোধ করতে প্রস্তুতি নেয় বাঙালিরাও। পরিস্থিতি শান্ত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা টহল জোরদার করে। কিন্তু বাঙালিদের দমন করতে পারলেও অবাঙালিরা কোনোভাবেই পিছু হটছিল না। বরং তারা রোগী নিয়ে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর গাড়িতেও হামলা করে। রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে দূর থেকে গুলি করতে থাকে সেনাবাহিনীর গাড়ি লক্ষ্য করে। বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকেও পাল্টা গুলি ছুড়ে জবাব দিতে হয়। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হতাহতের শিকার হয়। এর জেরে পাহাড়ের নানা জায়গায় উত্তেজনা ছড়ায়। এক পর্যায়ে রাঙ্গামাটিতেও ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা। সেখানেও হতাহতের ঘটনা ঘটে। প্রশাসনের ব্যাপক তৎপরতায় পরিস্থিতি যখন কিছুটা শান্ত হওয়ার পথে, ঠিক তখনই ধর্ষণের অভিযোগ এনে খাগড়াছড়ি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক সোহেল রানাকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে অবাঙালি শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কক্ষ ও অন্যান্য সামগ্রীও ভেঙ্গে তছনচ করে তারা। এর মাধ্যমে আবারো বাঙালি-অবাঙালি উত্তেজনা ছড়ায়।

প্রশাসন দ্রুত ১৪৪ ধারা জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও পাহাড়ের বাতাসে আতঙ্ক জিঁইয়ে রেখেছে ষড়যন্ত্রকারীরা। একদিকে বাজার বয়কট, অন্যদিকে রাজধানীর শাহবাগ, ঢাবির রাজু ভাস্কর্য, জাতীয় প্রেসক্লাব, চবি ক্যাম্পাস, চেরাগী পাহাড় মোড়সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা মিছিল-মিটিং করছে, অন্যদিকে দেশের বাইরে বিশেষ করে ভারতের বিভিন্ন স্থানেও মিছিল-মিটিং করে এসব ঘটনার জন্য বাঙালি, সেনাবাহিনী এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে দোষারোপ করছে। ভারতের ত্রিপুরা, অরুণাচল, আসাম, দিল্লিতেও তারা সভা-সমাবেশ করছে; ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালিরা মানববন্ধন, মিছিল করেছে। এমনকি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালে সেখানেও তারা নানাভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার ইমেজ নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, ত্রিপুরার সংসদ সদস্যসহ তাদের পক্ষ থেকে এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মোদির কাছে চিঠি লিখে সরাসরি পার্বত্য চট্টগ্রামে হস্তক্ষেপের দাবি জানানো হয়েছে। কেউ কেউ তো পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে কেড়ে নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার দাবিও জানিয়েছে!

বাস্তবতা হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক প্রতিটি সংঘাতের সূচনা করেছে অবাঙালিরা। শুধু তাই নয়, সেই ঘটনায় যাতে বাঙালিদের জড়িত করে বড় ধরনের সংঘাত লাগানো যায় তারও ব্যবস্থা করেছে তারা। এর ফলে যখনই বাঙালিরা ক্ষিপ্ত হয়েছে, প্রতিরোধে মাঠে নেমেছে তখনই তারা আবার নিজেরা ভিক্টিম রুল প্লে করে দেশে-বিদেশে প্রচারের সুযোগ নিয়েছে এবং নিচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, পাহাড়ে এসব কেন ঘটছে, কারা ঘটাচ্ছে? এর সমাধানই-বা কী? আসলে এসব বহু পুরানো কৌশল। ইতিহাস জানা থাকলে তা বুঝতে যেমন সহজ, তেমনি সমাধানও সহজ হবে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ব্রিটিশদের কাছ থেকে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ওইদিন তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ (পরে পূর্ব পাকিস্তান), বর্তমান বাংলাদেশের সকল অংশই স্বাধীন হওয়ার কথা। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে তা হয়নি। বান্দরবান এবং রাঙ্গামাটিতে (খাগড়াছড়ি নামে তখন কোনো এলাকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না) তখনো ভারতের পতাকা উড়ছিল। পরে ১৭ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের গিয়ে ভারতীয় পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উড়াতে হয়েছিল। সেই সময় ভারতীয় পতাকা উত্তোলনকারীদের উত্তরসূরিরা এখনো সক্রিয় আছে পাহাড়ে।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, সেই ১৭ আগস্টকে তারা এখনো ‘ব্ল্যাক ডে’ হিসেবে পালন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে এটা তারা না করলেও কৌশলে ত্রিপুরাতে বসবাসরত চাকমারা বেশ ঘটা করেই পালন করে। একই কাজ তারা করেছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও। রাঙ্গামাটির চাকমা সার্কেল চিফ এবং বান্দরবানের বোমাং সার্কেল চিফ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপক্ষে গিয়ে যোগ দিয়েছেন পাকিস্তানিদের সঙ্গে। গড়ে তুলেছেন রাজাকার বাহিনী। পাকিস্তানিদের বিপক্ষে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে রাঙ্গামাটিতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের সবচেয়ে বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে চাকমা রাজাকারদের কাছ থেকে। পাকিস্তানি হানাদার এবং রাজাকারদের মোকাবিলা করতে গিয়েই নানিয়ারচরে শহীদ হয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ, মহালছড়িতে ক্যাপ্টেন মুশফিকসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে লুকিয়ে থেকে চাকমা এবং মিজো রাজাকাররা মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে ১৯৭২ সালেও। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফিরে সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন মাত্র, অন্যদিকে পাহাড়ে তখনো চাকমা এবং মিজো রাজাকারদের বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীকে অপারেশন চালাতে হচ্ছে, এমন সময় পাহাড়ের বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে পর পর দুটি দল স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছেন রাজধানীতে!

১৯৭২ সালের সংবিধানে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ গৃহীত হলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমা তার বিরোধিতা করে স্বাধীন জুম্ম ল্যান্ড প্রতিষ্ঠার মানসে গঠন করেন সশস্ত্র শান্তিবাহিনী। কিন্তু সাহায্য চেয়েও ভারতের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে পরে যোগ দিয়েছেন বাকশালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ভারতের মদদে সশস্ত্র বিদ্রোহে সক্রিয় হন। বাংলাদেশে তার পছন্দের সরকারকে হারিয়ে ভারত তখন এই দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য কাজে লাগায় এম এন লারমা এবং তার সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনীকে। দেরাদুন সামরিক একাডেমিতে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, অঢেল অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র এবং ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে নিরাপদ ঘাঁটি নির্মাণের সুযোগ করে দেয়। এদিকে ঘটনার পরমপরায় দেশে সংঘটিত হয় ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবের মাধ্যমে সিপাহী-জনতা ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। মুক্তিযুদ্ধে ১ নং সেক্টর কমান্ডার এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান জিয়াউর রহমানের যুদ্ধ ক্ষেত্র ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম। ফলে সেখানকার ইতিহাস, ভূগোল, জনমানস এবং সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলের অস্থিরতা সম্পর্কে ধারণা ছিল সুস্পষ্ট।

স্পষ্ট ধারণা থাকার কারণেই প্রেসিডেন্ট জিয়া বুঝতে পেরেছিলেন, পাহাড়ের সংকট সমাধান করতে হলে কী কী করতে হবে। তিনি ঘন ঘন পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করে একদিকে সেখানকার সামাজিক ও গোষ্ঠি নেতাদের সাথে ধারাবাহিক মিটিং করে স্থানীয় মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে অনেকের মনে থাকা শঙ্কা দূর করতে সংবিধানে প্রতিস্থাপন করেন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’। সাধারণ মানুষের উন্নয়নে গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, তাদের কৃষ্টি-কালচার রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষায় সুযোগ দিতে মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কোটা প্রদান করেন। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ লাভে তাদের জন্য নানা সুযোগ সৃষ্টি করেন। রাজনৈতিকভাবে তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে গঠন করে দেন ট্রাইভাল কনভেনশন। এছাড়াও পাহাড়ের আনাচে-কানাচে নির্মাণ করা হয় রাস্তা-ঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। জিয়াউর রহমানের এসব মানবিক এবং আন্তরিক উদ্যোগের ফলে পাহাড়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সাংস্কৃতিক চর্চাসহ জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে থাকে।

সে সময় পাহাড়ের কতিপয় নেতা প্রেসিডেন্ট জিয়ার কাছেও স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করেছিলেন। আবার একই সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের মদদ এবং সহযোগিতায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা অব্যাহত রাখে। তখন তার প্রতিকারে সমতল থেকে নদী ভাঙ্গা বেশকিছু পরিবারকে পাহাড়ে পুনর্বাসন করেন জিয়াউর রহমান, যারা একদিকে পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অনাবাদী ভূমিকে চাষের আওতায় আনে, অন্যদিকে দেশের অখণ্ডত ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠে। পাশাপাশি সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে ঢেলে সাজান তিনি। এর ফলে রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে দাবি আদায়ে জেএসএসের অপকৌশল বুমেরাং হয়ে যায়। একই সময় জেএসএসের সভাপতি এম এন লারমার ছোট ভাই শান্তিবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার সন্তু লারমাকে আটক করা হয়। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কৌশল হিসেবে প্রথমে সন্তু লারমার স্ত্রীকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তার পারিবারিক আর্থিক অনটন দূর করা হয়। পরবর্তীতে শান্তি আলোচনার স্বার্থে সন্তু লারমাকেও মুক্তি দেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। কিন্তু মুক্তি পেয়ে কথা রাখেননি সন্তু লারমা, তিনি আবার ফিরে যান জঙ্গলে। অপরদিকে কতিপয় বিপথগামী সৈনিকের হাতে নিহত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। যার কারণে পার্বত্য সমস্যার ইতি টানা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষজন এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, প্রেসিডেন্ট জিয়া আরো ২ থেকে ৩ বছর সময় পেলে পাহাড়ের এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে সক্ষম হতেন। বিশেষ করে, সংবিধানে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ প্রতিস্থাপন এবং পাহাড়ে বাঙালি পুনর্বাসন যে পার্বত্য সংকট সমাধানের পথে সবচেয়ে দূরদর্শী, সুদূরপ্রসারী এবং তাৎপর্যময় পদক্ষেপ, সেটা বহু গবেষক স্বীকার করেছেন। এমনকি বাঙালি পুনর্বাসন এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ জেএসএসের চাপ দিয়ে দাবি আদায়ের কৌশলকে গুড়িয়ে দিয়েছিল সেটা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির অনেক গবেষকও তাদের লেখায় উল্লেখ করেছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কৌশল ছিল ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর ‘রণ-তূর্য’ এবং তাতে তিনি সফলভাবে শান্তিবাহিনী এবং ভারতের ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য যে, পরবর্তী শাসকরা সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি। ভারতের চাপে তারা সমস্যার মোকাবিলায় শুধু ‘বাঁশরী’ বাজিয়ে গেছেন, কিন্তু ‘রণ-তূর্যে’র কথা বেমালুম থেকেছেন। ফলে সরকারগুলো যত ছাড় দিয়েছে শান্তিবাহিনী তত তাদের চেপে ধরেছে।

সরকারের ভুল নীতির সুযোগ নিয়ে তারা প্রথমে জেলা পরিষদ আদায় করেছে। পরে চুক্তি আদায় করেছে, সেই চুক্তির আলোকে অসাংবিধানিকভাবে জেলা পরিষদের কর্তৃত্ব বাড়িয়ে নিয়েছে, আঞ্চলিক পরিষদ আদায় করেছে, ভূমিকমিশন আদায় করেছে, ভূমিকমিশন আইন আদায় করেছে। এমন আরো বহু বিষয় আদায় করেছে। চুক্তির ৭২টি ধারা-উপধারা মধ্যে ইতোমধ্যে ৬৫টি ধারা বাস্তবায়ন করে নিয়েছে। কিন্তু চুক্তিতে তাদের নিজেদের জন্য মান্য একমাত্র ধারা ‘অস্ত্র সমর্পণ’ তারা বাস্তবায়ন করেনি। কিছু অস্ত্র জমাদানের নাটক করলেও বাস্তবে চুক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেএসএস আগের চেয়ে আরো ভয়ঙ্কর এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রের মজুত বাড়িয়ে চলেছে। ছোট বেলায় এক রাক্ষসের গল্প শুনেছিলাম, যার একটি মাথা কাটলে সাতটি মাথা গজিয়ে উঠত। রূপকথার সেই রাক্ষসের মতো সরকার পাহাড়ে একটি গোষ্ঠির সাথে চুক্তি করার পর সেখানে নানা নামে তেমনি সাতটি মাথা গজিয়ে উঠেছে। আগে যেখানে সাধারণ মানুষ একটি সশস্ত্র গ্রুপের চাঁদাবাজি, গুম, খুনসহ নানা সন্ত্রাসের শিকার হতো, এখন সেখানে বিভিন্ন নামের ৬/৭টি সন্ত্রাসী গ্রুপ দ্বারা নির্যাতিত, নিপীড়ত হচ্ছে।

অন্যদিকে চুক্তিতে জেএসএস এবং সরকার পক্ষভুক্ত হলেও তার পেছনে থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে ভারত, যার কারণে, সেই সময় নতজানু সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষায় তেমন কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না। তাছাড়া, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই চুক্তির মাধ্যমে যতটা না শান্তির আশা করেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করেছেন এর বিনিময়ে নোবেল পুরস্কার বাগিয়ে বিশ্ব নেত্রী হয়ে ওঠার। ফলে চুক্তি হয়েছে একপেশে, সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা জন্য হুমকিস্বরূপ। সে কারণেই, বাংলাদেশের মানচিত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অটুট রেখে এটাকে পুরোপুরিভাবে কোনো দিনই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ওইদিকে চুক্তির আলোকে সৃষ্ট আঞ্চলিক পরিষদে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে ক্ষমতায় আছেন সন্তু লারমা। লাগাতার ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে অনির্বাচিত একজন ব্যক্তিকে অন্যায্যভাবে ক্ষমতায় বসে থাকতে দেখে আরো অনেকের মনে খায়েশ জেগেছে। ইউপিডিএফ বহুদিন ধরেই চাইছে, সরকার তাদের সাথেও চুক্তি করুক, তাদেরকেও ক্ষমতার ভাগ দিক। ওই দিকে বান্দরবানে নতুন করে জন্ম নেয়া কেএনএফ-ও চাইছে চুক্তি। তাদেরও ক্ষমতা দিতে হবে। এই মুহূর্তে পাহাড়ের যে অস্থিরতা তার পেছনেও আছে এই ক্ষমতার লোভ।

৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়ার পর থেকে সারাদেশের স্থানীয় পরিষদগুলো ভেঙ্গে দিয়েছে। কিন্তু তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ এখনো অটুট আছে, যেকোনো সময় নতুন পরিষদ গঠিত হবে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান উপদেষ্টা হওয়ায় সেখানেও নতুন নিয়োগ হবে। তাছাড়া শরণার্থী টাস্ক ফোর্স চেয়ারম্যানও নিয়োগ হবে। পাহাড়ে ব্যাপক কানাঘুষা আছে, এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজেদের লোক বসাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জেএসএস এবং ইউপিডিএফ। সেই ক্ষেত্রে নিজেদের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিতে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষকে নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উসকানি দিয়ে সংঘর্ষ বাঁধানো হচ্ছে। আর এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাতে বাতাস দিচ্ছে পরাজিত শক্তি আওয়ামী লীগ এবং তার প্রভূ ভারত। পাহাড়ের সমস্যা সমাধান করতে হলে এসব গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে এবং তা মোকাবিলায় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অখ-তা রক্ষা সর্বোপরি পার্বত্যাঞ্চলের বাসিন্দাদের শান্তির স্বার্থে দৃঢ় হাতে ‘দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের লালনে’ প্রেসিডেন্ট জিয়ার ফর্মুলা অনুসরণ করতে হবে।

সন্ত্রাসীদের কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। কারণ, যত ছাড় দেয়া হবে, ততই তারা পেয়ে বসবে। ছাড় দেয়া বন্ধ করতে হবে। সারাদেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান চলছে। পাহাড়েও সেটা জোরদার করতে হবে। প্রয়োজনে সেখানকার সকল গ্রুপের সন্ত্রাসীদের অস্ত্র জমা দিয়ে আত্ম সমর্পণের সময় বেঁধে দিতে হবে। সময়সীমা পার হলে কম্বিং অপারেশন চালাতে হবে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে। এতে তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের লাগোয়া রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিতে পারে। সেটা বন্ধ করতে সীমান্ত সিল করতে হবে। প্রয়োজনে সীমান্ত এলাকার রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে প্রয়োজনীয় ভূমি ডিফরেস্ট করে সমতল থেকে এক লাখ ভূমিহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করতে হবে। আরো একটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া যায়, কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের শিবিরগুলোতে ১২ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে, যা সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে কোনোভাবেই ভারসাম্যপূর্ণ নয়। তাই সরকার কিছু কিছু করে ভাসানচরে নিয়ে রাখছে। কিন্তু তাতেও সংকুলান করা যাচ্ছে না। তাই, এক লাখ রোহিঙ্গাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রিজার্ভ ফরেস্টের কোনো একটি এলাকায় সরিয়ে নেয়া যায়। এতে একদিকে কক্সবাজারের পরিবেশ-পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে, অন্যদিকে পাহাড়ের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের সরকারের উপর চাপ প্রয়োগের কৌশলও ব্যর্থ হবে।

[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন