প্রতিটি ক্রান্তিকালে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষা করেছে : মির্জা ফখরুল


বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা করার ব্যাপারে আমরা একমত। এখানে অনেকেই বলতে চেষ্টা করেছেন- জনগণের মধ্যে কিছুটা বিভেদ আছে, বিভাজন আছে। আমি মনে করি বিভেদ, বিভাজন জনগণের মধ্যে নেই। আমার মনে হয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে, সেটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মানুষ সব সময়ই ঐক্যবদ্ধ থেকেছেন প্রয়োজনের সময়। প্রতিটি ক্রান্তিকালে, প্রতিটি সংকটে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তা রক্ষা করেছে। বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে।’
রবিবার (৬ জুলাই) রাজধানীর গুলশানে রেনেসাঁ হোটেলে আয়োজিত ‘জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য’ শীর্ষক সংলাপ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন মির্জা ফখরুল। ফাউন্ডেশন ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিস (এফএসডিএস) এই সংলাপের আয়োজন করে।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, জনগণকে ক্ষমতায়িত ও জনগণের সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করতে হবে। যদি সেটা করতে পারি— তাহলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আমাদের অন্যান্য বিষয়গুলো সহজ হয়ে আসবে।
তিনি বলেন, সেই তিতুমীরের সময় থেকে যদি শুরু করেন একেবারে চব্বিশ পর্যন্ত আসেন, প্রতিটি সময় বাংলাদেশের মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে ঐক্যবদ্ধ ভাবে। তাদের প্রত্যেকটি জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার জন্য। ৫২-র ভাষা আন্দোলন বলেন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন বলেন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ বলেন, সর্বক্ষেত্রে মানুষ এক হয়ে লড়াই করেছে, তাদের নিজের জীবন বিসর্জন করে। সুতরাং এটাকে আমি একটা বড় সমস্যা বলে আমি মনে করি না। বাংলাদেশের মানুষ তারা ঐতিহাসিকভাবে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকেন। জনগণকে ক্ষমতায়িত ও জনগণের সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করতে হবে। যদি সেটা করতে পারি তাহলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত হবে, নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য বিষয়গুলোর সমধান হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা এখনো পর্যন্ত গণতান্ত্রিক চর্চা করতে পারিনি। গণতান্ত্রিক চর্চা করতে গিয়ে পদে পদে বাধা পেয়েছি। সেই জায়গায় আমাদের একমত হতে হবে। আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে আমরা সে জায়গাটায় পৌঁছাব। সেজন্য নেতিবাচক চিন্তা না করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দ্রুত ফেরত যেতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান মির্জা ফখরুল।
মির্জা ফখরুল আরো বলেন, বাংলাদেশের মানুষ তর্ক করছে, বিতর্ক করছে, আলোচনা করছে। তার মধ্য দিয়ে তারা একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে। আমার বিশ্বাস এই আলোচনার মধ্য দিয়েই, তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই সেই জায়গায় গিয়ে পৌঁছাব, সেখান থেকে সত্যিকার অর্থে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মাণ করার জন্য একটা সঠিক পথ খুঁজে বের করতে পারব।
তিনি বলেন, আমাদের ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। এগুলো যদি শক্তিশালী পারি, তাহলে আমরা জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব। অন্যান্য বিষয়গুলোকেও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব। আসুন আমরা নেতিবাচক চিন্তা না করে সবাই এক পথ ধরে খুব দ্রুত যাতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে যেতে পারি। প্রশ্নটি হলো গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটানো এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা চালু করা। আমরা রাষ্ট্র মেরামতের কথা অনেক আগেই বলেছি। আমরা ২০১৬ সালে আমরা রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলেছি। আমরা ২০২৩ সালে ৩১ দফার কথা বলেছি। যেখানে পুরো রাষ্ট্র সংস্কারের কথা রয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এই জায়গাটিতে এক হওয়ার দরকার। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, আমরা অন্তত এক জায়গায় আসি যে, আমরা গণতন্ত্রে ফিরে যাব এবং সত্যিকার অর্থেই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।
সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তাঁর বক্তব্যে বলেন, জাতীয় ঐক্য যদি আমরা সৃষ্টি করতে পারি, তাহলে এটার সাথেই আসলে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি আসবে এবং সেটা তখন সহজ হবে। আমরা অনেক ডিবেট করতে পারি। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে কেন আমরা একমত হতে পারব না, যদি এদেশের নাগরিক হই, দেশপ্রেমিক হই। বর্তমানে সরকারও চেষ্টা করছেন জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টির জন্যে। কমিটি হয়েছে, তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ করেছেন। আমি দেখি না স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ঐক্যের ক্ষেত্রে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করবে।
তিনি বলেন, জনগণের ক্ষমতা যদি জনগণের হাতে দিতে হয় তাইলে এদেশে একটি সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ এবং একদম স্থায়ী নির্বাচন ব্যবস্থা এখানে সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থায় নানা রকমের মতামত এখন উঠছে। উঠতে পারে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন মতামত থাকতে পারে। আমি মনে করি, গণতন্ত্রের ব্যাপারে বুদ্ধিজীবীদের মতামত আছে, রাজনীতির মতামত আছে এবং একটা আঞ্চলিক রিজিওনাল গুরুত্ব থাকে, তাই আমাদের এখানে এভাবে ওভাবে নির্বাচন হবে, এটা না বলে; আমরা বলেছি, আগে জনগণের হাতে আমরা ভোটের অধিকার দেব। তারা নিজ হাতে, নিজ ব্যালটে, নিজে স্বাধীনভাবে একজন ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে।
সংলাপে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও পার্বত্যনিউজের সম্পাদক মেহেদী হাসান পলাশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রধান শক্তি এই দেশের ১৮ কোটি জনগণ। ১৮ কোটি জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তি বিশ্বের যেকোনে আগ্রাসন মোকাবেলায় সক্ষম। ‘৫২, ‘৭১,’ ৯০ ও ২০২৪- এই ঐক্যের অর্জন। কিন্তু আজকে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের উত্তরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। তা মূলত অনৈক্যের ফসল। এই অনৈক্যের প্রধান দায় সরকারের। কেননা সরকার নিজে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় খোলা, মানবিক করিডোর, বন্দর, রোহিঙ্গা ইস্যু, স্টারলিংক চালু করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রভৃতি ইস্যুগুলো, যা জাতীয় নিরাপত্তার সাথে সরাসরি জড়িত। এই ইস্যুগুলোতে সরকার জনগণ, রাজনৈতিক দল ও নিরাপত্তা নিয়ে কোনোরূপ আলোচনা ছাড়াই একতরফা এগিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার বলছে এসব ইস্যুতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতের ভিত্তিতে কাজ করার। কিন্তু সরকার সেই আলাপ-আলোচনার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে জনমতের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি ভারতের উপ সেনাপ্রধান বলেছেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে চায়না ও তুরস্ক লাইভ ইনপুট দিয়েছিলো। যেটা পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতি ও নিরাপত্তার দেশে এ ধরনের সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে লাইভ ইনপুট দেয়ার মতো কেউ নেই। সরকারেরও এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।