বান্দরবান সীমান্তে মাইন বিষ্ফোরণে ৩ বছরে ১৭জনের প্রাণহানি: আহত ২০

fec-image

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শূন্যরেখাসহ বাংলাদেশ অভ্যান্তরে বার বার বিষ্ফোরণ ঘটছে স্থল মাইন। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে এসব মাইন পুতেছিল মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এমনটি জানিয়েছেন সীমান্ত এলাকার মানুষ। ইমপ্রোভাইজ এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি’র কারণে সীমান্তে প্রায় সময় প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশী সাধারণ নাগরিকসহ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা।

গত তিন বছরে ১৭জনের মৃত্যু ও ২০জন আহত হওয়ার খবর স্থানীয়রা দিতে পারলেও এই সংখ্যা প্রায় ৩০জনের কম নয় জানিয়েছেন সরকারী একটি সূত্র। একইভাবে আহতের সংখ্যা ৪০এর কাছাকাছি।

বিশেষ করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম বাইশফাড়ি থেকে শুরু করে, তুমব্রু, রেজু-আমতলী, নিকুছড়ি, চাকঢালা, সাপমারাঝিরি আশারতলী-বড়ছনখোলা, ফুলতলী, লেমুছড়ি, পাইনছড়ি সীমান্তে এই ধরনের মাইন বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে সবচেয়ে বেশি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ২০১৭সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের পর বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পার্বত্য জেলা বান্দরবান অংশ ও জিরো পয়েন্টের আশ্রয় নেয় অন্তত ৫০হাজার রোহিঙ্গা। তখন থেকেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিজিপি শূণ্যরেখাসহ কিছু কিছু এলাকায় বাংলাদেশ অভ্যান্তরে ঢুকে বেআইনীভাবে অসংখ্য মাইন স্থাপন করে।

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দারা জানান- রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার বিদ্রোহীদেও দমনের জন্য সীমান্ত এলাকায় স্থলমাইন পুঁতে রেখেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হরহামেশা এসব মাইন বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

এদিকে বিভিন্ন সময় দুই দেশের পতাকা বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে বিজিবি মাইন স্থাপনের ঘটনায় কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানালেও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বেআইনী এই কাজ থেকে সরে আসেনি। বরংচ সম্প্রতি সময়ে নিজ দেশের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তৎপরতা ঠেকাতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তারা মাইন স্থাপন করেছে।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলাা তমব্রু সীমান্তের কোণারপাড়া জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা আক্তার আহম্মদ জানান, মাইন বিস্ফোরণে যারা আহত হচ্ছে তাদের শরীরের বেশিরভাগই উড়ে যায়। যারা ভাগ্যক্রমে বেচে যায় তারা পঙ্গু হয়ে যায়। মিয়ানমারের সৈন্যরা রাঁতের আধারে এসব মাইন পেতেছে।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, শূন্যরেখায় প্রায়সময় মাইন বিষ্ফোরণে মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি গরু-ছাগল ও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িতরা প্রাণ হারিয়েছে।

উল্লেখ্য, সর্বশেষ চলতি বছরের ২৩অক্টোবর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ‘স্থল মাইন বিস্ফোরণে’ নিহত হন মোহাম্মদ জাবের (১৩) নামে এক রোহিঙ্গা। সে কুতুপালং লম্বাশিয়া ১-ডব্লিউ ক্যাম্পের ব্লক-ডি/৪-১৪ এর বাসিন্দা মো. এমদাদ হোসেনের ছেলে।

এর আগে ১৯অক্টোবর নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে ২টি স্থল মাইন ধ্বংস করে সেনাবাহিনীর বোমা ডিসপোজাল দল। সীমান্তের নাইক্ষ্যংছড়ির ৪৫-৪৬ নম্বর পিলারের মাঝামাঝি বাংলাদেশ অভ্যন্তরের জামছড়ি এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম গত ২৯ জুলাই এ স্থল মাইন ২টি উদ্ধার করেছিল।

স্থানীয়দের তথ্য মতে, চলতি বছরের ১৬মার্চ নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রæ সীমান্তের ৩৯-৪০ নাম্বার পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে মাইন বিষ্ফোরণে নিহত হন রোহিঙ্গা নাগরিক মনির উল্লাহ (২৫)। সে ঘুমধুম শূন্য রেখার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত কালা মিয়ার ছেলে।

২০১৯ সালের ৩সেপ্টেম্বর ঘুমধুম সীমান্তের তুয়াইংগা ঝিরি নামক স্থান থেকে মো: শাহাজাহান এর লাশ উদ্ধার করা হয়। তিনি মাইন বিষ্ফোরণে প্রাণ হারান। উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের জি ব্লকের বাসিন্দা রুস্তম আলীর ছেলে তিনি। একই বছর ১০ সেপ্টেম্বর ঘুমধুম সীমান্তের ৩৭-৩৮নং পিলারের মধ্যস্থানে মাইন বিষ্ফোরণে আহত হন ঘুমধুমের বাইশফাড়ি এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়েরের ছেলে মো. হাসান (৩২)।

২৩ সেপ্টেম্বর উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে আবদুল মজিদ (৩২) নামে এক যুবক নিহত হন। তিনি কুতুপালং ডি ক্যাম্পের আবদুল মালেকের পুত্র। ২৯ নভেম্বর ঘুমধুম সীমান্তের ৩৯নং পিলার এলাকায় স্থলমাইন বিস্ফোরণে রোহিঙ্গা যুবক হামিদ হোসেন (৩১) নিহত হন। তিনি উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের আব্দুল করিমের ছেলে। একই ঘটনায় আহত হন, একই ক্যাম্পের হাবিব উল্লাহ এবং মো: জুয়েল হক।

২সেপ্টেম্বর রেজুপাড়া সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে নিহত হন রোহিঙ্গা যুবক মোহাম্মদ হামিদ (৩০)। তার পিতার নাম আব্দুল করিম। তিনি কুতুপালং ১নং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের ব্লক-৪ এ অবস্থানরত রোহিঙ্গা নাগরিক।

২০১৮ সালের ৩ফেব্রুয়ারী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের চাকঢালা মিয়ানমার সীমান্তের ৪২ ও ৪৩ নাম্বার সীমানা পিলারের পশ্চিমপাশে বন্যাঝিরি এলাকায় মাইন বিস্ফোরণে আওয়ামী লীগ নেতা বদিউর রহমান (৪৫) দু’পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর ২০১৭ সালের ৪ডিসেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ৪২-৪৩পিলার এলাকায় স্থল মাইন বিস্ফোরণে ফরিদুল আলম (১৬) নামে এক শিশুর পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ওই শিশু নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চাকঢালা ইউনিয়নের হামিদিয়া পাড়া বদিরনীর ছড়া এলাকার ইব্রাহিম খলিলের ছেলে। ২ সেপ্টেম্বর চাকঢালা সীমান্তের ৪৩ নম্বর পিলারের কাছে মাইন বিস্ফোরণে নূরে আলম (২৫) নামে রোহিঙ্গা নাগরিকের মৃত্যু হয়।

তিনি নাইক্ষ্যংছড়ির চাকঢালা বড়ছনখোলা আশ্রয়কেন্দ্রের তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা। তার বাবার নাম মোহাচ্ছের আলী। ৩অক্টোবর চাকঢালা সাপমারাঝিরি সীমান্তের জিরো লাইনে মাইন বিস্ফোরণে নূরুল ইসলাম (২২) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন। ১২ সেপ্টেম্বর কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় স্থলমাইনের বিস্ফোরণে নিহত হন রোহিঙ্গা নাগরিক মোস্তাক আহমদ।

১০ সেপ্টেম্বর ৩৭-৩৮নং পিলার এলাকায় স্থলমাইন বিস্ফোরণে ৩ রোহিঙ্গা নিহত হন। সাবেকুন্নাহার, আবদুল করিমসহ অজ্ঞাত আরো একজন। আহত হন ঘুমধুমের বাইশফাঁড়ি এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়েরের ছেলে মো. হাসান (৩২)। ১২ সেপ্টেম্বর নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের চাকঢালা বড়ছনখোলা ও আশারতলির ৪টি পয়েন্টে পৃথক সময়ে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে এক বাংলাদেশী সহ ২ রোহিঙ্গা নাগরিক নিহত হন। এসময় এক রোহিঙ্গা ব্যক্তির পাশাপাশি ৩টি মহিষও আহত হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন, মায়নমারের টাইরঢেবা এলাকার রোহিঙ্গা কৃষক ছৈয়দ আহমদ (৫৫) এবং ফকিরা বাজার এলাকার বাসিন্দা মোক্তার আহমদ (৪৫)।

এছাড়াও আহত হন আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা বদিউর রহমানের পুত্র হাকিম উল্লাহ (৪৫) মায়ানমারের পালংঝিরি এলাকার বাসিন্দা মীর আহমদের পুত্র আব্দুল কাদের (৪৮)।
প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সাল থেকে সীমান্ত এলাকায় এধরণের মাইন বসাতে শুরু করে মিয়ানমার। মাঝখানে কিছুদিন তারা এই কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকলেও ২০১৭ সাল থেকে আবারো বেআইনী এই কাজে জড়িয়ে পড়ে।

এই প্রসঙ্গে সীমান্ত সংশ্লিষ্ট আইন শৃংখলা বাহিনীর বক্তব্য পাওয়া না গেলেও নাইক্ষ্যংছড়ি থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন- মাইন বিষ্ফোরণের ঘটনাগুলোর জন্য থানায় ইউডি (অস্বাভাবিক মৃত্যু) বা অপমৃত্যু মামলা হয়ে থাকে। তবে সীমান্তে মাইন বিষ্ফোরণে মৃত্যুর পরিসংখ্যান তাৎক্ষণিক জানা যায়নি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন