ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকার আন্তঃনদী ব্যবস্থাপনা নিয়ে ডিআইইউ-তে সেমিনার অনুষ্ঠিত


জলবায়ু পরিবর্তন এবং জল-রাজনীতির জটিল প্রেক্ষাপটে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা অববাহিকায় কার্যকর আন্তঃনদী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ কৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে (ডিআইইউ) শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ এই সেমিনারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড্ডাস্থ সাঁতারকুল ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারটির ইংরেজিতে শিরোনাম ছিল-“Climate Change and Hydropolitics: Bangladesh’s Role, Challenges, and Strategies in Transboundary River Governance in the Brahmaputra-Jamuna Basin”.
সিএইচটি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক, পিস মহিলা কল্যাণ সংগঠন এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন সেলের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা অভিন্ন নদীর পানি বন্টন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুট কোর্টে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত এ সেমিনার চলে।
সেমিনারের আহ্বায়ক এবং সিএইচটি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক ও পিস মহিলা কল্যাণ সংগঠনের আহ্বায়ক সাইং সাইং উ নিনি অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং আয়োজনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, চেয়ারম্যান বিওটি ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং সভাপতিত্ব করেন প্রফেসর ডক্টর জাহিদুল ইসলাম, ভাইস চ্যান্সেলর ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন গবেষক সাইং সাইং উ নিনি, সিএইচটি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ও আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডক্টর রমিত আজাদ প্রফেসর ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, স্পিকার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রেজাউল করিম রনি সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সমালোচক। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রোভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. গনেশ চন্দ্র সাহা, রেজিস্টার প্রফেসর মো. রফিকুল ইসলাম, প্রফেসর ডক্টর আব্দুল্লাহ আল মঞ্জুর হোসেন, ডীন, ফ্যাকাল্টি অফ ল, প্রফেসর মোহাম্মদ শাহ আলম চৌধুরী, প্রফেসর ডক্টর মোহাম্মদ শরিফুল আলম ডিপার্টমেন্ট অফ পলিটিকাল সায়েন্স এন্ড ডিরেক্টর রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন সেল, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. জাহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে তিনি আন্তঃনদী ব্যবস্থাপনার একাডেমিক এবং গবেষণার দিক তুলে ধরেন। প্রফেসর ডক্টর জাহিদুল ইসলাম বলেন,”মেডগ ড্যাম” নির্মাণের মাধ্যমে চীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের পথে এগোচ্ছে। অন্যদিকে, ভারতও কৌশলগত অবস্থান থেকে এই উপমহাদেশে সর্বকালের সর্ববৃহৎ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এই দুই প্রকল্পই আমাদের জাতীয় জল নিরাপত্তা, কৃষি উৎপাদন, পরিবেশ ও নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
একটি দায়িত্বশীল জাতি হিসেবে আমাদের উচিত বহুমাত্রিকভাবে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও প্রাকৃতিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে। তিনি আরো বলেন, “এই ধরনের সেমিনার বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও আলোচনার নতুন দ্বার উন্মোচন করে, যা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান ও সুপারিশসমূহ জাতীয় নীতি নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে।”
প্রধান অতিথি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আন্ত-নদী বা অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন আছে। উজানের দেশগুলো ভাটির দেশগুলোর সাথে আলাপ না করে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। ভারতের নতুন প্রস্তাবিত Upper Siang Multipurpose Dam Project বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। তিনি আরো বলেন, “ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মতো বৃহৎ নদী অববাহিকার সঠিক ব্যবস্থাপনা আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য অপরিহার্য। পরিবর্তিত জলবায়ু এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় আমাদের কূটনৈতিক এবং কারিগরি উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে।
সেমিনার আহবায়ক সাইং সাইং উ নিনি বলেন, চীন তিব্বতের ইয়ারলুং সাংপো নদীতে ৬০ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মেডগ সুপার ড্যাম নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে; অন্যদিকে, ভারত জল-রাজনীতির অংশ হিসেবে ভারতের অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং নদীর উপরে একটি বাঁধ নির্মাণ করছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ বিষয়টি অনেকে জানে না। ভারতের এবার নির্মাণ প্রকল্পটি সবচাইতে বেশি ক্ষতি করবে বাংলাদেশের। প্রভাব পড়বে লাখো লাখো জনজীবনের উপর। ভারতের বাঁধ নির্মাণের মূল কারণ হচ্ছে ভারতের পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ভারতের ১৩.২ বিলিয়ন ডলার শিয়াং আপার মাল্টিপারপাস প্রজেক্ট যা নয় বিলিয়ন ঘন মিটার পানি ধারণ করবে।
নতুন এই বাঁধটি ৯.২ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ধারণ করার ক্ষমতা রাখে এবং ধারণা করা হচ্ছে, ১১ হাজার মেগা ওয়াট ইলেকট্রিসিটি উৎপাদন করবে। এবারের বাঁধটি নিম্ন প্রবাহের দেশগুলোকে রীতিমত মহাবিপদে ফেলবে। ব্রহ্মপুত্রের ৮% এলাকা বাংলাদেশে মধ্যে রয়েছে অথচ এই নদীটি প্রতি বছর ৬৫ % বেশি পানি সরবরাহ করে যা বাংলাদেশের জীবনরেখা হিসেবে পরিচিত। এই জলাপ্রবাহে ২১৮টিরও বেশি প্রজাতির মাছ রয়েছে এবং এর মধ্যে ইলিশ অন্যতম। বাঁধ নির্মাণের ফলে এদের মাইগ্রেটরি মাইক্রেটরি প্যাটার্ন, জলজ এবং কৃষিজ ক্ষেত্রে নেতিবাচক, সর্বোপরি, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ চরম ক্ষতির মুখে পড়বে।
তিনি আরো বলেন, “নদী অববাহিকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর জীবনযাত্রার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সর্বাধিক। তাদের কথা মাথায় রেখেই আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজাতে হবে।”
বক্তারা বলেন, ভারতের প্রস্তাবিত নতুন এই বাধ বাংলাদেশের জন্য একটা মহাবিপদ সংকেত। ভয়ংকর পরিবেশ বিপর্যয় এড়াতে বাঁধের বিপরীতে বাঁধ না দিয়ে সকলকে আলোচনার টেবিলে আসা উচিত, যাতে সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা মানব উন্নয়নের স্বার্থে করা যায়। বাঁধের বিপরীতে বাঁধ এই ধরনের কৌশলগত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন আন্ত-সীমান্ত পানি সম্পদকে যুদ্ধের অস্ত্র তথা পানি বোমা হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা ও প্রবণতাকে বাড়িয়ে তুলবে। ভাটির দেশগুলোর সাথে তথা নিম্নপ্রবাহের দেশগুলোর সাথে আলাপ না করে এই ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জলসম্পদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার চূড়ান্ত ইঙ্গিত দেয়।