মিরসরাই প্রকল্পের আড়ালে ভারতীয় সামরিক অনুপ্রবেশের শঙ্কা

fec-image

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কৌশল বাস্তবায়নে মিরসরাই কাজে লাগাতে চায় ভারত। মিরসরাই পেয়েও আবার হাত ছাড়া হয়ে গেলে নিশ্চিত ধ্বসে পড়বে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কৌশল। তাছাড়া আঞ্চলিক রাজনীতিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নেও ভিন্ন পরিকল্পনার ছক কষতে হবে ভারতকে।

এদিকে শেখ হাসিনার পতনের পর ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার রয়েছে মিরসরাই ইস্যুতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে। ভৌগলিক নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার স্বার্থে এই চুক্তি দেশের জন্য হুমকি বলে মনে করছে দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ। তারা বলছেন, ভবিষ্যতে মিরসরাই থেকেই সাইবার আক্রোমণ, গোয়েন্দাগিরি ও সামরিক অনুপ্রবেশ ঘটাবে ভারত।

দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব জটিলতা ও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু প্রশাসনিক বা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় নয়, বরং এর গভীরে রয়েছে নীতিগত পক্ষপাত, আঞ্চলিক কৌশলগত ঝুঁকি এবং জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষার এক গভীর সংকট।

এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রোকন উদ্দিন একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই প্রকল্পে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কার্যত সীমিত রাখা হয়েছে। মূল নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা একতরফাভাবে ভারতীয় বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। এমনকি চুক্তির শর্তাবলিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ কনট্রাক্ট, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ভারত থেকেই আনতে হবে। ফলে বাংলাদেশের স্থানীয় ঠিকাদাররা, প্রযুক্তিবিদরা, কিংবা নির্মাণ খাতে জড়িত সংস্থাগুলো কোনো বাস্তব অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে পারেনি। এতে একদিকে যেমন স্থানীয় সক্ষমতা ও মানবসম্পদের অবমূল্যায়ন ঘটছে, অন্যদিকে এ অঞ্চলে একটি একচেটিয়া প্রভাব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হচ্ছে, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সুদূরপ্রসারী হুমকি হয়ে উঠতে পারে।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রতার এক ক্ল্যাসিক উদাহরণ হয়ে উঠেছে। প্রায় আট বছর পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এখনো জমির একটি বড় অংশ পড়ে আছে অনাবাদি ও অব্যবহৃত অবস্থায়। স্থানীয় জনগণ, যারা প্রথম দিকে এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ব্যবসার সুযোগের স্বপ্ন দেখেছিল, তারা এখন হতাশ। তাদের আশা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চরম অনিশ্চয়তায় রূপ নিয়েছে। এর ফলে কেবল স্থানীয় অর্থনীতিই স্থবির হয়ে পড়েনি, বরং প্রকল্প-সম্পৃক্ত এলাকায় সামাজিক উত্তেজনাও তৈরি হয়েছে।’

সচেতন নাগরিকদের অনেকে মনে করছেন, প্রকল্পটির বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, পক্ষপাতমূলক নীতি এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে চুক্তিটি বাতিল করা অথবা ন্যূনতম পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত। কেননা আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারত একটি আধিপত্যবাদী অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের উচিত হবে কৌশলগত সম্পদ ও ভূখণ্ডে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখা।

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, এক অজানা আতঙ্ক এখন মিরসরাইয়ের চারপাশে। এলাকাবাসীর জমি তো গেছেই, একই সাথে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা। মিরসরাইয়ের মানুষ জানে না কবে আসবে ভারতের আদানী গ্রুপ। অবরুদ্ধ জমিতে এখন আর ঢুকতে পারে না কেউ ।

২০১৫ সালের ৬ জুন। হাসিনার আমন্ত্রণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসেন ঢাকায়। সোনালী অধ্যায় নামে প্রচারণা চালানো হয় টেলিভিশনে। সড়কের দু’ ধার ছেয়ে যায় ব্যানার, ফেস্টুনে। গণভবনে অনুষ্ঠিত হয় গোপন বৈঠক। বৈঠকে ভারত বাংলাদেশে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল চায়।

মোদির প্রস্তাবে রাজি হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আনন্দচিত্তে ভারতীয় প্রস্তাব মেনে নেন তিনি। ভারতের চাপে শেখ হাসিনা এই প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য হন। কেউ কেউ বলছেন এটি ছিলো ভারতের প্রতি শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্বের প্রমাণ। যা রাষ্ট্রীয় আত্মসমাপর্ণ বলে উচ্চারিত হচ্ছে।

ভারতকে প্রথমে রামপালে ১০০ একর জমি দেয়া হয়। কিন্তু ভারতীয় প্রশাসন রামপালের জমি যথেষ্ট মনে করেনি। তাতে তাদের স্ট্রাটেজিক প্রয়োজন মিটবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয় শেখ হাসিনাকে। তাদের চাই বঙ্গোপসাগর ঘেষা জমি। যেখানে সরাসরি জেটি স্থাপন করে সেভেন সিস্টার্সে পণ্য পাঠানো যাবে। তখন ভারতের এমন প্রস্তাবের মানে কেউ বুঝে উঠতে পারেনি।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, বাংলাদেশের মানচিত্রে মিরসরাই এক কৌশলগত জোন। এর অবস্থান এমন যে, এখানে ভারত সামান্য সামরিক দখল তৈরি করতে পারলেই পুরো দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবানসহ পুরো পার্বত্যাঞ্চল আলাদা হয়ে পড়বে।

মিরসরাইয়ে যে এলাকাটিতে ৯০০ একর জমি আদানিকে দেওয়া হয়, সেটির এক পাশে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ উপকূল। আরেক পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে। আদানির এ প্রকল্প থেকে ভারতের ত্রিপুরার দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার।

এই জমি ভৌগলিক কৌশলগত দিক থেকে এমন একটি পয়েন্টে অবস্থিত যা চট্টগ্রাম বন্দর, সেনানিবাস, কক্সবাজার বিমান ঘাঁটি, পার্বত্য এলাকায় রসদ সরবরাহের কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে কাজ করে। সুতরাং এই অঞ্চল অন্য কোনো রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আওতায় চলে গেলে তা শুধু ভৌগলিক নিরাপত্তা নয়, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার হুমকি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলছেন, দেশ বিরোধী এই চুক্তি বাতিল হোক। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা কেবল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রশ্ন নয়, এই ৯০০ একর জমি ভারতীয় আধিপত্যের এক সুপরিকল্পিত বাঙ্কার। ভবিষ্যতে এখান থেকেই হতে পারে ভারতের সাইবার আক্রোমণ, গোয়েন্দাগিরি ও সামরিক অনুপ্রবেশ।

দিন যতই গড়াচ্ছে ততই মিরসরাই চুক্তি নিয়ে এবং ৯০০ একর জমি নিয়ে ততই গভীর হচ্ছে দুই দেশের অদৃশ্য লড়াই।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ, ভারত, মিরসরাই প্রকল্প
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন