‘মিয়ানমারে এখন যা হচ্ছে তার প্রভাব পার্বত্য চট্টগ্রামে পড়তে পারে’
পার্বত্য চট্টগ্রামের খুব কাছেই রোহিঙ্গারা অবস্থান করছে। রোহিঙ্গারা এমন একটা জনগোষ্ঠী, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত। যারা তাদের পিতা-মাতা, ভাই-বোনকে হত্যা করতে দেখেছে। যারা নিশ্চিত হয়েছে যে, তাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। শুধু তারা নয়, তাদের পরবর্তী প্রজন্মও কোনো আলো দেখছে না। সেরকম একটা জনগোষ্ঠীকে যদি আমি বলি এক্সপ্লোসিভ (বিস্ফোরক) তাহলে সেটা ভুল হবে না। অর্থাৎ এক্সপ্লোসিভ আমরা পাশে নিয়ে ঘুমাচ্ছি অথবা বসবাস করছি। পরিস্থিতিটা কিছুটা সেই রকম। যেহেতু এরকম একটা হতাশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামের খুব কাছেই আছে, এজন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এটা একটি হুমকি বলে আমি মনে করি। নিরাপত্তা বিঘ্নের জন্য যে কাজগুলো হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিয়ে, ট্রান্স বর্ডার অথবা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে এবং বাইরে, এই কাজগুলোর ইফেক্ট পড়বে। শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরেই থাকবে না। এটার স্পিল ওভার এফেক্ট পার্বত্য চট্টগ্রামে আসার সমূহ আশঙ্কা আছে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেখানে ডিমান্ড থাকবে সেখানে সাপ্লাই হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমরা বর্তমানে যা দেখেছি, বিভিন্ন আর্মড ক্যাডার গ্রুপ আছে, তারা অস্ত্র নিয়ে ঘুরছেন। তাদের অস্ত্রের যে চাহিদা, এই চাহিদাগুলো কিন্তু যোগান দিতে পারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে। রোহিঙ্গারা কোথা থেকে পাবে? এটা বর্ডারের ভিতরে অথবা বাইরে হতে পারে। এমনকি ট্রান্স বর্ডারেও হতে পারে। সুতরাং থ্রেট যেটা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে তৈরি হচ্ছে, তার এফেক্ট এখানেও আসতে পারে।
আরো একটি আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে ড্রাগ। মিয়ানমারের এখন যে অবস্থা সেটাকে নারকো টেরোরিজম বলা যায়। এই নারকো টেরোরিজম ডেফিনেশনের একটা টেক্সট বুক এক্সাম্পল হলো, যেটা মিয়ানমারে বর্তমানে চলছে। শান স্টেট যেটা আছে এখানে ৪৯ শতাংশ হাউজহোল্ড ড্রাগ ব্যবসায়ে লিপ্ত। কেন ড্রাগ ব্যবসায়ে লিপ্ত? দুটি কারণে। মিয়ানমার সরকারের সাধারণ যে কালচার বা কার্যক্রম আছে সেটা থেকেই এই সুযোগটা বৃদ্ধি করে দিয়েছে। আর ড্রাগ ব্যবসা করার ফলে কাঁচা টাকা খুব দ্রুত অর্জন করা যায়। এই দুই কারণে শান স্টেটের ৪৯ শতাংশ জনগণ ড্রাগ ব্যবসায় লিপ্ত। এ ড্রাগগুলো গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের অংশ হিসেবে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা ক্যারিয়ার হিসেবে এখানে আনতে পারে। যেটা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে এফেক্ট ফেলবে।
বর্তমানে কক্সবাজার এবং বান্দরবানের সীমান্ত এলাকায় প্রতিনিয়তই কিছু মানুষ ড্রাগ নিয়ে ধরা পড়ছে। আরেকটি বিষয় যেটা পার্বত্য চট্টগ্রাম, ভারত এবং মিয়ানমারের সাথে জড়িত সেটা হলো, কুকি-চিন প্রসঙ্গ। গত বছরের অক্টোবরে কুকি-চিন সারফেইস হয়েছিল। তারা যে ডিমান্ড করেছে পয়েন্ট অফ ডিপ্রাইভেশন। ডিপ্রাইভেশন ছিল বলেই তারা সাপ্রেসড হয়েছে। বিপদজনক হলো, এই কুকি-চিনের স্বজাতিরা ইন্ডিয়া এবং মিয়ানমারে আছে।
কুকি-চিন যেমন ভারতেও আছে, তেমনি মিয়ানমারেও আছে। এদিকে কুকি-চিন যারা মিয়ানমারে আছে তাদের হাতে অস্ত্র, ড্রাগ এবং অন্যান্য বিষয়গুলো প্রকাশ্যেই আছে। ফলে ওখান থেকে ট্রান্স বর্ডার হয়ে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসবে না, এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। আমাদের বর্ডার রোড এখনো প্রস্তুত নয়। ১৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে ২৭০ কিলোমিটার হয়েছে। এই বর্ডারের অনেক জায়গাই দুর্গম। এ দুর্গম অঞ্চল দিয়ে এগুলো আসতে পারে। এরকম একটা হুমকি রয়ে গেছে। আমি এর সাথে যদি পার্বত্য শান্তিচুক্তির একটি মিলন ঘটাই এভাবে যে, কুকি-চিন তাদের ডিপ্রাইভেশনের কথাটা প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন হলো, কুকি-চিন একটা উপজাতি নয়, বরং ছয়টা উপজাতি মিলে একটি পরিচিতি।
কুকি-চিনদের বঞ্চনা দেখার দায়িত্ব ছিল রিজিওনাল কাউন্সিল, হিল ডিস্ট্রিক কাউন্সিলের। কিন্তু তারা যে ডিপ্রাইভেশনের যে বিষয়গুলো উত্থাপন করেছে, সেটা শান্তি চুক্তির সাথে যাচ্ছে কিনা এটা একটি দেখার বিষয় রয়েছে। অর্থাৎ তাদের যে রিপ্রেজেন্টেশন করার কথা ছিল ট্রাইবাল লিডারদের সেই ট্রাইবাল লিডাররা উপস্থাপন করেছে কিনা সেটাও ভেবে দেখার বিষয় আছে। তাদের যে শিক্ষা এবং অন্যান্য যারা ট্রাইবাল আছে যেমন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা তাদের শিক্ষার হারের সাথে রাত আর দিন তফাৎ। কেন রাত আর দিন থাকবে? উপজাতি যারা লিডার ছিল তারা এই বিষয়গুলা যথাযথভাবে উপস্থাপন করেনি কেন?
শান্তিচুক্তির মূল লক্ষ্য হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ছাড়াও সকল উন্নয়ন। সকল জনগোষ্ঠীর জন্য সুষম উন্নয়ন যাতে হয়, সেটাই শান্তিচুক্তির মূল উদ্দেশ্য। আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, ১৯৭২ সালে যেভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল দুটি বিষয়কে অখণ্ডতা ও শাসনতন্ত্র, এই চ্যালেঞ্জটাকে যেমন আটকানো গিয়েছে একই রকমভাবে পার্বত্য অঞ্চলে অনগ্রসর একটা জাতিগোষ্ঠী এবং এলাকা ছিল এই অনগ্রসর জাতিকে আলোর মুখ দেখানো বা উন্নয়নের মুখ দেখানো। এ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অনেকটাই হয়েছে। কিন্তু এটা বলার সুযোগ নেই, যে উন্নয়ন করেছি এটা যথেষ্ট।
অন্যদিকে মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা ভয়াবহ। বিভিন্ন স্টেটে তাদের যে টাউনগুলো রয়েছে, এর মধ্যে কিছু কিছু টাউন শুধু তাদের দখলে রয়েছে। তাছাড়া বেশিরভাগ জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে এথনিক আর্মড অর্গানাইজেশন্স এবং পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (পিডিএফ)। এখানে দুটি বিষয় খুবই বিপদজনক।
১. এখানে যে পরিমাণ অস্ত্র এসেছে সেই অস্ত্র যে শুধু মিয়ানমারের ভিতরেই থাকবে এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না।
২. স্বাধীনতাকামী বা যারা আলাদা হতে চাচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার কোনো কমান্ড নেই। ফলে তাদের কার্যক্রম একটা যে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে থাকবে সেই নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারি না।
এইটার প্রভাব শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, সমস্ত বাংলাদেশের ভিতরে আসার আশঙ্কা রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামের যে জাতিগোষ্ঠী আছে, তাদের সাথে মিল আছে মিজোরাম, মনিপুর এবং মিয়ানমারের বিভিন্ন স্টেটের মধ্যে। ফলে অশান্ত মিয়ানমার কখনোই বাংলাদেশের জন্য শান্তি বয়ে আনতে পারে না।
সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের করণীয় অনেকগুলো। প্রথমত, কূটনৈতিকভাবে কাজ করা। মিলিটারির কাজ স্থানীয় যারা আছেন, তাদেরও কাজ করার কিছু বিষয় আছে। এছাড়া মিডিয়ায় যারা আছে তাদেরও কিছু কাজ করার বিষয় আছে। প্রত্যেক ক্ষেত্রে এক একজনকে এক এক রকম কাজ করতে হবে। যাতে করে যে অ্যাকশন হচ্ছে মিয়ানমারে তার স্পিল ওভার প্রভাব আমাদের ওপরে না আসে। কূটনৈতিকভাবে প্রত্যেক জায়গায় আমাদের অংশগ্রহণ থাকতে হবে এবং জানতে হবে, কী হচ্ছে? আবার মিলিটারালি এবং ভিজিলেন্স (সতর্কতা) একইভাবে তৈরি করতে হবে। এখানে সকলের দায়িত্ব আছে।
লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।