ইরাক যুদ্ধের প্রত্যাবর্তন

28749_nikolash

নিকোলাস ডি ক্রিস্টোফ:

এটা কি ২০১৪ সাল নাকি ২০০৩? 
ইরাকে সামরিক হস্তক্ষেপের আহ্বানের কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সেখানে ড্রোন হামলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। এসব কথা শুনে আমার মনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। ২০০৩ সালে আমরা ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছি। এটা হতে পারে সেনা শক্তির জন্য একটি সতর্কতা যে, এমন পদক্ষেপ কখনও কখনও প্রকৃত পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। আমেরিকান জার্নালে প্রকাশিত এক রিপোর্টে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ইরাক যুদ্ধে ৪৫০০ মার্কিনি নিহত হয়েছে। পক্ষান্তরে ৫ লাখ ইরাকি প্রাণ হারিয়েছেন।

সরকারি অর্থায়ন বিষয়ক হাভার্ডের এক বিশেষজ্ঞ লিন্ডা বিলমিস আমাকে বলেছেন যে, ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মোট খরচের অংক হতে পারে ১০০ হাজার কোটি ডলার। এ অর্থ গড়ে প্রতিজন মার্কিনির ৩৫ হাজার ডলার ট্যাক্সের সমান। এই অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত শিশু প্রি-স্কুল সম্পন্ন করতে পারতো, সারাবিশ্বে যত এইডস রোগি আছেন তাদের বেশির ভাগই চিকিৎসা নিতে পারতেন এবং সারাবিশ্বের সমস্ত শিশু স্কুলে যেতে পারতো আগামী ৮৩ টি বছর। এর পরিবর্তে ওই নিষ্পল যুদ্ধে আমাদের অর্থের খরচ হয়েছে মোবিয়াস স্ট্রিপের মতো। এর মাধ্যমে আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম আমাদেরকে আবারও যেন সেখানেই ফিরিয়ে নিয়ে এলো। আমাদেরকে অবশ্যই বিনয় শিখতে হবে। হ্যাঁ, সামরিক অস্ত্র তো হাতে আছেই এবং মাঝেমধ্যে তা ব্যবহারের বিষয় হয়ে পড়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মৌলিক একটি বিষয় হলো হতাশার: তা হলো সমাধানের চেয়ে সমস্যা আছে বেশি। চিকিৎসকদের মতো সরকারকে উচিত সঠিক নীতি নির্ধারণ করা- তার প্রথমটা হলো কোন ক্ষতি করা যাবে না।  

ইরাকে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দূত পল ব্রেমার বিমান হামলার পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। কিছু স্থল সেনা মোতায়েনের পক্ষে কথা বলেছেন। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠাও তার মতো সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে।  আরও বিস্ময়ের বিষয় হতে পারে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর ডিয়ানে ফেইনস্টেইনও একই মত দিয়েছেন। তিনি সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারওমেন। বলেছেন, আমি মনে করি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদেরকে এখন আইসিসের বিরুদ্ধে সরাসরি একশন নেয়া। ইরাকের উত্তরাঞ্চলে সুন্নি জঙ্গিরা ব্যাপকভাবে তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করছে- এ বিষয়ের ওপর তাকে উদ্ধৃত করে এ কথা লিখেছে ওয়াশিংটনের পত্রিকা দ্য হিল।

সর্বশেষ বিস্ময়ের নাম হলে ডিক চেনি। তিনি ও তার মেয়ে লিজ ইরাক যুদ্ধ নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতামত কলামে এক নিবন্ধ লিখেছেন। সেখানে তারা যে রেকর্ড উপস্থাপন করেছেন তা ভুল। ডিক চেনি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ২০০২ সালে যখন নিশ্চিত হওয়া গেল যে ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছেন  এবং ২০০৫ সালে ইরাকি বিদ্রোহীরা শেষ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। এই যন্ত্রণা শেষ করে দিতে ব্যর্থতার জন্য এখন আমরা বারাক ওবামাকে ব্যর্থ বলে মন্তব্য করছি। ইরাক সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা হস্তক্ষেপ আহ্বান করেছে। এতে আমার আতঙ্ক হলো, আমরা বড় একটি গৃহযুদ্ধের মধ্যে লিপ্ত হবো। যেটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত লেবাননে, ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত সোমালিয়ায়। দেখুন, এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে না পারা একটি খারাপ ধারণা হতে পারে। কিন্তু হস্তক্ষেপ করা আরও খারাপ একটি বিষয়। আমরা স্বীকার করতে চাই যে, সামরিক পদক্ষেপ সঠিক।

কিন্তু ইরাকে এই মুহূর্তে মারাত্মক সমস্যা বিরাজ করছে। কিন্তু এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ কি আসলেই উত্তম পদক্ষেপ হবে? জবাব হলোÑ মোটেও না। নিউইয়র্ক টাইমসে আলিসা জে. রুবিন ও রড নর্ডল্যান্ড এ সপ্তাহে প্রতিবেদনে লিখেছেন যে, সুন্নি আরব ও কুর্দী নেতারা মালিকিদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছে। সেখানে সুন্নিরা তাদের সেনাদল দিয়ে আইসিসকে পরাস্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে। একতা বজায় রাখার জন্য সেটা আদর্শ উপায় হতে পারত। মধ্যপন্থী সংযত সুন্নিদের দিয়ে আইসিস সুন্নিদের দুমড়ে মুচড়ে ফেলা। একই প্রক্রিয়ায় প্রশমিত হত বিভক্তিগত উত্তেজনা। তা না করে মালিকিরা ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ইরাকের অনেক সুন্নি আইসিসকে অপছন্দ করে। পাশাপাশি তারা মালিকিদের আরও বেশি ঘৃণা আর অবিশ্বাস করতে শিখেছে। ইরাকে এই বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে সরকারকে সুন্নি ও কুর্দীদের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হবে।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ মেনে নিতে হবে। আর মধ্যপন্থী সুন্নি সম্প্রদায়কে শক্তিশালি করতে হবে। এগুলো যদি বাস্তবায়ন হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আইসিসি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার অনুমোদন দেয়ার মাধ্যমে একতাবদ্ধ ইরাকি সরকারকে সমর্থন দেয়া যুক্তিযুক্ত হতে পারে। সেটা ব্যতিরেকে আমাদের অবস্থান শুধুমাত্র মালিকিদের আপোসহীস মনোভাবের সহযোগি হিসেবেই প্রতীয়মান হবে- গৃহযুদ্ধে এক পক্ষকে সহায়তা দেয়া। লন্ডন কনফারেন্সে জেনারেল ডেভিড পেত্রাউস যেমন বলেছেন, শিয়া মিলিশিয়াদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনী হতে পারে না। দুঃখজনকভাবে মনে হচ্ছে মালিকিরা ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে, একতাবদ্ধ অবস্থানের পরিবর্তে তারা নিজেদের শিয়া ঘাঁটি স্থাপনের গতি বাড়িয়ে তুলেছে।

ইরাকি সরকারের উচিৎ শুভেচ্ছামূলক পদক্ষেপ হিসেবে সুন্নি বন্দীদের মুক্ত করে দেয়া। তার পরিবর্তে পুলিশের হাতে বন্দিদের হত্যা করা হয়েছে। সামরিক বাহিনী হতে পারে শক্তিশালি, অপরিহার্য মাধ্যম। যেমনটা আমরা কসোভো আর কুর্দিস্তানের ওপর নো ফ্লাই জোনে দেখেছি। কিন্তু ইরাক যুদ্ধ থেকে ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে যে শিক্ষা আমরা পেয়েছি তা হলো, আমাদের সামরিক সামর্থ্য অসামান্য আর কখনওবা উন্মত্ততা সৃষ্টিতে সক্ষম হলেও, সব সমস্যার সমাধান তারা হতে পারে না।

সূত্র- মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আইসিআইএল, আইসিআইসি, ইরাক
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন