একদিকে বর্বরতা, অন্যদিকে মানবিকতা

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

নিজ মাতৃভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত তারা। শুধু বাস্তুচ্যুতই নয়, গুলি করে নির্মমভাবে হত্যার পর মরদেহ জ্বালিয়ে দেয়া, বাড়িঘরে আগুন দেয়া, নিরস্ত্র ও নিরীহ রোহিঙ্গাদের ধরে ধরে ধারল অস্ত্র দিয়ে অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিচ্ছিন্ন করা, ছোট ছোট শিশুদের আছড়ে মারা, ধর্ষণ, লুট- এহেন কোনো অপরাধই নেই যা সংঘটিত হয়নি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা।

কাঁটাতারের ওপারে দেশটির সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে গত ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে চার লাখ ২২ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। ঠিক উল্টো পাশে ভিন্ন এক চিত্র দেখছে আতঙ্কিত আশ্রিতরা।

নিজ দেশের সেনাবাহিনীর নির্মম বর্বরতা, অন্যদিকে ভিন দেশের সেনাবাহিনীর পরম স্নেহ-আদরে কাছে টেনে নেয়া- বিষয়টি বিস্মিত করেছে অধিকাংশ রোহিঙ্গাকে। তারা বলছেন, প্রথম প্রথম একটু ভয় পেয়েছিলাম, সেনাবাহিনী তো। কিন্তু বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের আদর-ভালোবাসায় আমরা মুগ্ধ। পরম যত্নে তারা আমাদের খাদ্য-চিকিৎসা-আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

কাইয়ুম নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘নিজ দেশের সেনাবাহিনীই আমাদের ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। তাদের বন্দুকের গুলি থেকে নারী, এমনকি নিষ্পাপ শিশুরাও রক্ষা পায়নি। আর বাংলাদেশের সেনা সদস্যরা…, তারা খুবই মানবিক। আমাদের সাহায্যে তারা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।’

‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মানবিক এ আচরণ কখনওই ভোলার নয়’- উল্লেখ করে আফেয়া খাতুন বলেন, ‘তাদের কারণে (বাংলাদেশের সেনা সদস্য) নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছি।’ স্বামীহারা এ রোহিঙ্গা জানান, সাতদিন আগে পাঁচ মাসের শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে এক কাপড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। প্রথম কয়েকদিন খোলা আকাশের নিচে থাকার পর অপর এক রোহিঙ্গার পলিথিনের ছাউনিতে আশ্রয় পেয়েছি। ঠিক মতো ত্রাণের খাবার জোগাড় করতে পারিনি। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আসার পর নিয়মিত খাবার পাচ্ছি। শিশুর খাবার ও কিছু কাপড়ও পেয়েছি। আগে ধস্তাধস্তি করে খাবার সংগ্রহ করতে হতো। এখন সেটা করা লাগছে না।

‘সেনাবাহিনীর ওই ভাই আমার বাবুকে কোলে নিয়ে আদর করেছেন। খাবার দিয়েছেন, আমার সব দুঃখ ভুলে গেছি। আমার দেশের সেনাবাহিনী যদি বাংলাদেশের ভাইদের মতো হতো’- আক্ষেপ প্রকাশ করেন আফেয়া খাতুন।

প্রসঙ্গত, গতকাল শনিবার দুপুর থেকে কক্সবাজারের উখিয়ায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন ও ত্রাণ বিতরণে কাজ শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। সরকার উখিয়ায় যে দুই হাজার একর জমি নির্ধারণ করে দিয়েছে সেখানে তারা ১৪ হাজার শেড তৈরি করবে। এসব শেডের প্রতিটিতে ছয়জন করে ৮৪ হাজার পরিবারকে বসবাসের সুযোগ করে দেয়া হবে।

শেড নির্মাণের পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমও পরিচালনা শুরু করছে সেনাবাহিনী। সরেজমিনে দেখা গেছে, উখিয়া বাজার থেকে দুই কিলোমিটার দূরে উখিয়া ডিগ্রি কলেজ। সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী। সেনা সদস্যদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে ব্রিফিং করছেন কর্মকর্তারা।

দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ত্রাণ কোন ক্যাম্পে নেয়া হবে সে নির্দেশনাও দিচ্ছেন তারা।

সড়ক ও ক্যাম্পজুড়ে চোখে পড়ে সেনা সদস্যদের কার্যক্রম। কেউ ত্রাণের টোকেন লিখে দিচ্ছেন, কেউ কেউ নিবন্ধন কার্যক্রম চালাচ্ছেন, ত্রাণের লাইন ঠিক করছেন। আগে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হত। বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলাও দেখা যায়। কেউ ত্রাণসামগ্রী পাচ্ছিল আবার কেউ বঞ্চিত হচ্ছিল। প্রাণহানিরও ঘটনা ঘটে। কিন্তু শনিবার থেকে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেয়ার পর সর্বত্র শৃঙ্খলা ফিরে আসে।

শনিবার দুপুরে ৩৬ বীর, ২৪ বেঙ্গল ও ৬৩ বেঙ্গল নামে তিনটি দল রোহিঙ্গাদের আশ্রয় স্থল উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী আসে। সেনাদের ক্যাম্প কমান্ডার মেজর মুহাম্মদ রাশেদ আকতার বলেন, আমরা প্রথমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করি। অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন ও বিচ্ছিন্ন ত্রাণ বিতরণ এবং রোহিঙ্গাদের অহেতুক জটলা সরিয়ে দিয়ে নির্বিঘ্ন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করি।

তিনি আরও বলেন, কন্ট্রোল রুমে জমা হওয়া দ্রুত পচনযোগ্য খাবারগুলো আলাদা করে বিতরণের জন্য নেয়া হয়েছে। বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আওতায় আসা রোহিঙ্গারাই এসব ত্রাণের আওতায় আসছে। এর মাধ্যমে বায়োমেট্রিকের সুবিধার মেসেজ রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছি। যাতে নিবন্ধন প্রক্রিয়াটা দ্রুততার সঙ্গে শেষ হয়।

কাজের সুবিধার্থে উখিয়া ডিগ্রি কলেজের পরিত্যক্ত একটি কক্ষ কোম্পানির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে কুতুপালং, বালুখালী ও থ্যাংকখালী পর্যন্ত প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সড়কের মাঝে দাঁড়িয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও তল্লাশি কাজ পরিচালনা করতে দেখা যায় বিজিবি সদস্যদের।

প্রসঙ্গত, গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া রাখাইন সহিংসতায় গত এক মাসে অন্তত চার লাখ ২৯ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাবা-মা-হারা শিশুর সংখ্যা ১৪শ’। শুধু ঘরবাড়িতে হামলা কিংবা লুটপাট নয়, সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইনরা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালিয়েছে বলে পালিয়ে আশা রোহিঙ্গাদের অভিযোগ।

গত শুক্রবারও রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন গ্রামে রোহিঙ্গা বসতিতে আগুন জ্বলতে দেখা যায় । আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এমন তথ্য দিয়েছে। তারা বলছে, রোহিঙ্গারা যাতে আর ফিরতে না পারে সেজন্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে।

সূত্র: আদনান রহমান, জাগোনিউজ২৪.কম

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন