টেকনাফের শিশু আলো হত্যা মামলায় ৬ জনের মৃত্যুদণ্ড

fec-image

কক্সবাজার টেকনাফের শিশু আলী উল্লাহ আলো (৭) চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলায় ৬ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।

বুধবার (১১ মে) বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটের সময় আদালতে এ রায় প্রদান করেন। দীর্ঘ প্রায় ১ ঘন্টা রায় পড়ে শোনানোর পর ৬ আসামির বিরুদ্ধে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করে রায় প্রকাশ করেন।

মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিরা হলেন পলাতক সুমন মিয়া ,নজরুল ইসলাম, সৈয়দুল আমিন প্রকাশ লম্বাইয়া, হাজতি ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান, ইয়াকুব, ইছহাক কালু।

রায়ের দিন পলাতক ২ আসামি মহিব উল্লাহ ও হাজতি আসামি দিদার মিয়ার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের বেকসুর খালাস প্রদান করেছেন আদালত । এ সময় হাজতে থাকা ৪ আসামি  এবং মামলার বাদী মো. আবদুল্লাহও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, ২০১১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬ টার দিকে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের গোদার বিল এলাকার রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ও ফারজানা পারভীন সুইটি’র ৭ বছরের শিশু ছেলে মো. আলী উল্লাহ আলোকে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ’র কর্মচারী সুমন আলী বাড়ির সামনের কাচারি ঘরে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করার উদ্দেশ্যে ডেকে নিয়ে যায়। পরে পাখির বাসা দেখানোর কথা বলে আলী উল্লাহ আলোকে তার পিতার কাচারি ঘরের সিলিং এ তুলে হাত-পা বেঁধে মুখে জোর করে কচটেপ লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় আলো চিৎকার করলে আসামি সুমন আলী ও অন্যান্য আসামিরা তাকে অপহরণ করার বিষয় বাড়ির লোকজন হয়ত জানতে পেরেছে মনে করে আলোকে চালের সিলিং এর উপর জবাই করে হত্যা করে।

এ ঘটনায় খুন হওয়া মো. আলী উল্লাহ আলো’র পিতা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বাদী হয়ে ৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৪  থেকে ৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে টেকনাফ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার টেকনাফ থানা মামলা নম্বর : ১৩/২০১১ ইংরেজি, জিআর মামলা নম্বর ৩৭০/২০১১ (টেকনাফ) এবং এসটি মামলা নম্বর ২০৮২/২০১৮ ইংরেজি। ধারা ৩০২/১০৯/১১৪/৩৪ দঃবিঃ।

এ মামলায় আসামি ইয়াকুব, ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান, সুমন মিয়া ঘটনা স্বীকার করে আদালতে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।

মামলাটি পর্যায়ক্রমে টেকনাফ থানার এসআই মাহবুবুর রহমান, এসআই হারুনর রশীদ এবং টেকনাফ থানার ওসি (তদন্ত) স্বপন কুমার মজুমদার তদন্ত করে আদালতে গত ২০১২ সালের ৩০ জুন (৩০/০৬/২০১২ ইংরেজি) চার্জশিট দাখিল করেন। এ চার্জশিটের বিরুদ্ধে বাদী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ ২০১২ সালের ৩০ ডিসেম্বর আদালতে নারাজী আবেদন করলে বিজ্ঞ আদালত বাদীর নারাজির আবেদন গ্রহণ করেন এবং ২০১৪ সালের ৪ মার্চ মামলাটি সিআইডিকে অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।

আদালতের নির্দেশে পর্যায়ক্রমে সিআইডি’র চট্টগ্রামের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হ্লা চিং প্রু, সহকারী পুলিশ সুপার এস.এম সাহাব উদ্দিন আহমদ এবং সর্বশেষ সিআইডি চট্টগ্রাম মেট্টো জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির সরকার তদন্ত করে এজাহারভুক্ত ৫ জনসহ মোট ৮ জন আসামির নাম উল্লেখ করে গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪/১০৯/১১৪ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন।

সম্পূরক চার্জশিটে এজাহারভুক্ত ৫ জন আসামি যথাক্রমে নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার কোদ্দ নারায়ণপুরের মৃত আফতাব আলীর ছেলে সুমন আলী (২৬), ঠাকুরগাঁও জেলার নিশ্চিন্তপুরের মৃত শামছুল হকের ছেলে ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান (২৯), কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের শ্রীপুরের মৃত আসলাম মিয়ার ছেলে ইয়াকুব (৩৪), টেকনাফের গোদার বিল গ্রামের আলী হোসেনের ছেলে মো. ইসহাক প্রকাশ কালু (৩১), টেকনাফের মহেশখালীয়া পাড়ার মৃত নবী হোসেনের ছেলে নজরুল ইসলাম (২৮)।

তদন্তে প্রাপ্ত এজাহার বহির্ভূত আরো ৩ জন আসামি যথাক্রমে মিয়ানমারের মংডু থানার ধনচি পাড়ার মৃত আবদুর রহিমের ছেলে রোহিঙ্গা ছৈয়দুল আমিন প্রকাশ লম্বাইয়া (৪৭), টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ মাঝের পাড়ার মৃত মৌলভী আবদুল জলিলের ছেলে মহিবুল্লাহ (৪৫), টেকনাফ পৌরসভার লেঙ্গুরবিলের জাফর আহমদের ছেলে মো. দিদার মিয়া (৩৫)।

মামলাটি টেকনাফের আমলী আদালত থেকে বিচারের জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রেরণ করলে জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০২০ সালের ২৪ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারকার্য শুরু করেন। বিচারিক আদালত মামলায় ২৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও তাদেরকে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা জেরা করেন। এরপর আলামত প্রদর্শন, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট যাচাই, ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন যাচাই, আসামিদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, যুক্তিতর্কসহ সকল আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে মামলাটি আজ (১১মে বুধবার) রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন। কক্সবাজার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল পূর্ব নির্ধারিত তারিখ আজ বুধবার (১১ মে) প্রকাশ্য আদালতে রায় প্রদান করেন।

আসামিদের মধ্যে বর্তমানে হাজতে আছে ইয়াছিন প্রকাশ রায়হান, ইয়াকুব, ইছহাক কালু ও দিদার মিয়া। তাদেরকে বুধবার (১১ মে) সকাল সাড়ে ১০টার সময় আদালতে আনা হয় এবং রায় প্রচারের সময় এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। সুমন আলী, নজরুল ইসলাম, সৈয়দুল আমিন আদালত থেকে জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে। অপর আসামি মহিব উল্লাহ জামিনে থেকেও আজকে আদালতে না এসে সময়ের আবেদন করেন।

রায় ঘোষণা করার পর রাষ্ট্র পক্ষের প্রধান কৌশলী পিপি এড. ফরিদুল আলম বলেন, এ রায়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অপরাধ যেই করুক শাস্তি তাকে পেতেই হবে। টেকনাফের বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ’র শিশুপুত্র চাঞ্চল্যকর আলো হত্যা মামলার রায়ে তিনি সন্তুষ্ট।

আসামি পক্ষের নিয়োজিত আইনজীবী সেলিম উদ্দীন রাজু বলেন, তিনি ও তার মক্কেল এ রায়ে অসন্তুষ্ট, তারা এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।

রাষ্ট্র পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন পিপি এডভোকেট ফরিদুল আলম, বাদী পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন এডভোকেট আমির হোসেন, এডভোকেট দীলিপ দাশ ও এডভোকেট আমিন উদ্দিন প্রমুখ।

আসামিদের পক্ষে এডভোকেট শাহজালাল চৌধুরী, এডভোকেট নুরুল মোস্তফা মানিক, এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম-৪ (স্টেট ডিফেন্স), এডভোকেট সেলিম উদ্দিন রাজু প্রমুখ মামলাটি পরিচালনা করেন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: টেকনাফ, মৃত্যুদন্ড, শিশু আলো
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন