টেকনাফে নিজে খুন হয়ে স্বামীকে বাঁচালেন স্ত্রী
মোহছেনা আক্তার (২২)। সে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বালুখালী এলাকার মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী। এ দম্পতির ৪০ দিনের নবজাতক সহ দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। স্বামী পেশায় একজন সিএনজি চালক।
সরেজমিন সংশ্লিষ্ট ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, জুলু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলী। পাঁচ বছর আগে বিয়ে করেন উখিয়া উপজেলার থাইংখালী এলাকার মোহছেনাকে। তাদের ঘরে তিন বছরের আলিফা, ৪০ দিন বয়সের আসমা রয়েছে।
কক্সবাজার টেকনাফ সড়কের বালুখালী থেকে আধা কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড়ের পাদদেশে কাচা ও টিনের বাড়ি মোহাম্মদ আলীর। বাড়িটি নড়বড়ে। দুইটা দরজা ভেঙ্গে চুরমার। সেই সাথে বাড়ির কাঁচা দেয়াল ভেঙ্গে প্রবেশের দৃশ্য চোখে পড়ার মতো। গৃহকর্তা মোহাম্মদ আলীর সাথে তার সৎ ভাইদের দীর্ঘদিনের জমি নিয়া বিরোধ চলে আসছিল বলে দাবি তার। সে কারণেই ভয়ে তার শ্বাশুড়ি সহ কয়েকজন রাখতেন বাড়িতে।
কিন্তু বিধি বাম, গেলো রাতে ১৪ আগস্ট মোহাম্মদ আলী দম্পতি ব্যতীত কেউ থাকেননি বাড়িটিতে। তাদের ঘরের ভেতরে দুই কক্ষ রয়েছে। সাথে বারান্দা ও রান্না ঘর। রাত দেড়টা পর্যন্ত দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে স্বামী স্ত্রী বারান্দায় ছিলেন। স্ত্রী মোহছেনা আক্তার বারবার স্বামীকে ভেতরের কক্ষে ঘুমাতে বলেন। কিন্তু স্বামী স্ত্রীকে ছাড়া ঘুমাতে রাজি নন। ভেতরের রুমে দোলনার মধ্যে নবজাতকের জন্য মশারি টাঙ্গানো সহ বিছানা ঠিকঠাক করেন স্বামী। তারপরেও স্ত্রী ভেতরে যাননি। স্বামীকে জোর করে ভেতরে ঘুমাতে পাঠান। সেই সাথে তাকে পাহাড়া দেয়ার কথাও বলেন স্ত্রী। তা’ছাড়া বারান্দায় নতুন বাচ্চার কান্নায় ঘুম নষ্ট হবে বিধায় জোর করে স্বামীকে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তিনি ভেতরে গিয়ে ফ্যান চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
কিছুক্ষণ পর মোয়াজ্জিনের ধ্বনিতে আযান শোনা যেতো। বাইরে মৌসুমের বৃষ্টি ঝরছে। সাথে দমকা হাওয়া বইছে। ঘুমের দুই ঘন্টা হতে না হতেই রাত সাড়ে ৩ টার দিকে একদল মুখোশধারী দুর্বৃত্ত কাচা দেয়াল ভেঙ্গে রান্নাঘর দিয়ে প্রবেশ করে। এতে মোহছেনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সাহসী এই নারী তাদের সাথে বাক বিতন্ডায় লেগে যান। সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা স্বামী মোহাম্মদ আলীর খোঁজে বারবার ভেতরে ঢুকতে চাইলে স্ত্রী বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তার সাথে ৪০ দিনের কন্যা শিশু আসমাও রয়েছে। প্রথমে মারধর করেন সন্ত্রাসীরা। তাদের একটি আঘাত নবজাতকের পায়ে লেগে শিশুটি পড়ে যায়। তারপরেও সন্ত্রসীদের বাঁধার শিকার হলে উপর্যপুরি ছুরি ও কুপিয়ে আঘাত করে মোহছেনাকে। সেই অবস্থায়ও স্বামীকে দরজা না খুলতে বলেন এই নারী। পরে ভেতরে থাকা স্বামী ঘরের সিলিংয়ের উপরে ওঠে আর্ত চিৎকার শুরু করলে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যান। ততক্ষণে নিথর হয়ে পড়েন মোহছেনা। তারপরেও পালংখালী হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এ দিকে আলিফা ও আসমা জানেনা তার মা কোথায়? তাদের কান্নার চাপ দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চোখে মুখে লেগে আছে।
মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমাকে বাঁচাতে গিয়ে স্ত্রী নিজেই মৃত্যুবরণ করেন। সেই সাথে তার সাথে তার সৎভাইদের দীর্ঘদিনের জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। মূলত তারাই ভাড়াটিয়া রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে এ ঘটনা ঘটায়।’
স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, মোহাম্মদ আলীর সাথে সৎভাইয়ের বসতির জায়গা নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল ঠিক। কিন্তু এ ঘটনার সাথে জড়িতদের কাউকে চিনতে পারেননি। দুর্বৃত্তরা তার স্বামীকে নাগালে না পেয়ে স্ত্রীকে নির্মমভাবে হত্যা করেন।
হোয়াইক্যং ফাঁড়ি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (এসআই) মাহমুদুল হাসান জানান, একদল দুর্বৃত্ত অন্ধকারে বাড়িতে ঢুকে কুপিযে নৃসংশভাবে হত্যা করে। মৃতদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে জড়িতদের অনুসন্ধানে তদন্ত করছে পুলিশ। কেউ পার পাবেনা বলে জানান তিনি।