তদন্তে বেরিয়ে এসেছে পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারী সবাই রোহিঙ্গা

fec-image

ঘটনাটি ২০১৮ সালের মার্চ মাসের। পাসপোর্টের জন্য আটটি আবেদন আসে কক্সবাজার পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মো. আবু নঈমের অফিসে। প্রতিটি আবেদনের সঙ্গে ছিল পুলিশের ইতিবাচক প্রতিবেদন। তবু সন্দেহ হয় পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের। ফলে আবেদনগুলো স্থগিত রেখে অধিকতর তদন্তের জন্য পাঠানো হয় কক্সবাজারের পুলিশ বিভাগে। পরে কক্সবাজার পুলিশের বিশেষ শাখার সহকারী পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলামের তদন্তে বেরিয়ে আসে, পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারী এই আটজনের সবাই রোহিঙ্গা।

শুধু এই আটজন নন, বিভিন্ন সময়ে এ রকম শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক প্রতিবেদন বলছে, ১৫৪ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে দিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। শুধু কক্সবাজার নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ভুয়া ঠিকানা দিয়ে শত শত রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়িও জমিয়েছেন। এ কাজে তাঁদের সহায়তা করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইনজীবী ও পুলিশ।

দুদকের অনুসন্ধানের তথ্য অনুযায়ী, সন্দেহবশত আবেদন স্থগিত হওয়া আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কক্সবাজার সদর থানার উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই) দ্বীন মোহাম্মদ নোটিশ পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো আবেদনকারী তাতে সাড়া দেননি। পুলিশ খুঁজেও পায়নি। আর তাঁদের পাসপোর্টের আবেদনে সত্যয়নকারী ইউপি চেয়ারম্যানরা দাবি করেছেন, আবেদনপত্রে দেওয়া স্বাক্ষর তাঁদের নয়।

এসব আবেদনের আরেক সত্যয়নকারী ছিলেন নোটারি পাবলিক অ্যাডভোকেট রাখাল চন্দ্র মিত্র। তিনি বলেন, স্থানীয়রা তাঁর কাছে এসব আবেদন নিয়ে আসার কারণে তিনি তা সত্যায়ন করেছেন। ভবিষ্যতে আর পাসপোর্টের আবেদনে সত্যায়ন করবেন না বলেও জানান এই আইনজীবী।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট পাইয়ে দিতে সহযোগিতার অভিযোগে এ পর্যন্ত ১৩টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি মোট ৭২ জন। এর মধ্যে ৩৬ জন রোহিঙ্গা। বাকিরা সবাই জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্মকর্তা, আইনজীবী ও বিভিন্ন দপ্তরের জন্মনিবন্ধন কর্মচারী। এই ১৩টি মামলার মধ্যে পাঁচটির বাদী ছিলেন দুদকের সদ্য চাকরিচ্যুত উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন। চারটি মামলার বাদী সহকারী পরিচালক মো. মাহবুবুল আলম এবং বাকি চার মামলার বাদী আরেক সহকারী পরিচালক সুভাষ চন্দ্র দত্ত।

দুদকের অনুসন্ধানে রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়ার পেছনে যাঁদের নাম উঠে এসেছে, এর মধ্যে পুলিশের ছয়জন কর্মকর্তা, ১০ জন জনপ্রতিনিধি, একজন নির্বাচন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন অফিসের চারজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দুই আইনজীবী রয়েছেন।

অভিযুক্ত সাত পুলিশ কর্মকর্তা হলেন পুলিশ পরিদর্শক এস এম মিজানুর রহমান, পুলিশ পরিদর্শক কাজী দিদারুল আলম (সাবেক ডিআইও), এএসআই জাহিদুল ইসলাম, এএসআই সাজেদুর রহমান, পরিদর্শক প্রভাষ চন্দ্র ধর, পরিদর্শক মো. রুহুল আমিন। তাঁদের মধ্যে মিজানুর রহমান, দিদারুল আলম ও জাহিদুল ইসলামকে দুদক একাধিক মামলায় আসামি করেছে। আইনজীবীদের মধ্যে কক্সবাজারের নোটারি পাবলিক ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আরেক আইনজীবী রাখাল চন্দ্র মিত্র ক্ষমা চেয়েছেন।

রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের পরিদর্শক প্রভাষ চন্দ্র বলেন, ‘এএসআই সাজেদুর রহমানের পাসপোর্টের ভুল প্রতিবেদনের কারণে আমাদের মামলায় জড়ানো হয়েছে। পুলিশ বিভাগ থেকে তদন্ত করে রোহিঙ্গা নারী নুরুন্নাহার বেগমের পাসপোর্ট বাতিলসহ এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ দুদকের মামলায় অভিযুক্ত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে আছেন কক্সবাজারের মহেশখালীর কুতুবজোন ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন, কক্সবাজার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মিজানুর রহমান, কক্সবাজার পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জাবেদ মোহাম্মদ কায়সার নোবেল, কক্সবাজার পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর রফিকুল ইসলাম, কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আশরাফুল হুদা সিদ্দিকী জামশেদ, কক্সবাজার পৌরসভার ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সালাউদ্দিন, কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের (সংরক্ষিত) সাবেক কাউন্সিলর হুমায়রা বেগম, কক্সবাজার পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মাহবুবুর রহমান, কক্সবাজার পৌরসভার সংরক্ষিত (১০, ১১, ১২) ওয়ার্ড কাউন্সিলর নাসিমা আক্তার, কক্সবাজারের ঈদগাঁ উপজেলার ৩ নম্বর ইসলামাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর সিদ্দিক ও ২ নম্বর পোকখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিক আহাম্মদ। তাঁদের মধ্যে রফিকুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, জাবেদ মোহাম্মদ কায়সার ও অফিস সহকারী দিদারুল আলমকে গত বছরের ২৮ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট তৈরিতে সহযোগিতার বিষয়ে জানতে চাইলে পোকখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক আহামদ বলেন, ‘আমি জনপ্রতিনিধি, এখানকার বাসিন্দাদের পাসপোর্টের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করি। এরা এখানে অনেক বছর ধরে বসবাস করে। পরে জানা যায়, তাঁরা অনেকে রোহিঙ্গা নাগরিক।’ সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোন ইউনিয়নের সচিব প্রিয়তোষ দে, কক্সবাজার পৌরসভার অফিস সহকারী দিদারুল আলম ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের জন্মনিবন্ধন সহকারী সুমন কান্তি গুপ্ত, কক্সবাজার জেলার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা (বর্তমানে কুমিল্লার অঞ্চলিক কর্মকর্তা) মোজাম্মেল হোসেনকেও আসামি করা হয়েছে দুদকের মামলায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মামলায় অভিযুক্ত কক্সবাজারের সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি, আমি একটা তদন্ত করেছি, দুদকের পছন্দ হয়নি, তাই আমাকে আসামি করা হয়েছে।’ দুদকের মামলায় অভিযুক্ত আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি নোটারি পাবলিক হিসেবে শুধু সত্যায়ন করেছি। কোনো অন্যায় করিনি।’

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট হাতে দেওয়ার ঘটনায় কয়েকটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক সুভাষ চন্দ্র দত্ত। মামলাগুলো এখন কোন অবস্থায় আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলাগুলোর তদন্ত চলমান। তদন্তের প্রয়োজনে সময়ে সময়ে কক্সবাজারে যাই।’

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পাসপোর্ট, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন