নারী-শিশুসহ প্রায় ১৬শ ভিকটিম উদ্ধার: ২৫০ দালালের বিরুদ্ধে মামলা: শতাধিক দালাল আটক: তবু থামছেনা সমুদ্রপথে মানবপাচার

মানবপাচার

স্টাফ রিপোর্টার:
সমুদ্র পথে থামছেনা অবৈধ মানব পাচার। এরা টেকনাফ উপকূলকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে এ পথে মালয়শিয়া পাচার অব্যাহত রেখেছে। তবে পাচার চক্রের সাথে কক্সবাজার জেলার কয়েক শতাধিক দালাল জড়িত রয়েছে।

তন্মধ্যে টেকনাফ উপজেলা থেকে প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে গডফাদার ও পাচারকারী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে। এদের মধ্যে ৩১ জনকে গডফাদার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এ চক্র সহজ সরল দেশী-বিদেশী লোকজনকে প্রলোভন দিয়ে বস্তা বন্দী করে ট্রলারযোগে পাচার করে যাচ্ছে। চিহ্নিত পাচারকারীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন উপকূল দিয়ে পাচার অব্যাহত রয়েছে বলে এমনটি অভিযোগ এলাকাবাসীর।

তবে পাচারচক্র মালয়েশিয়ায় চাকরীর নামে নিরীহ লোকজনকে মুত্যুর মুখে ঠেলে দিচেছ। গত কয়েক বছরে উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কয়েক শত লোক সাগরে প্রাণ হারিয়েছে। হাজার হাজার লোক বিভিন্ন দেশের কারাগারে বন্দী মানবেতর জীবন-যাপন করছে বলে জানা গেছে।

এদিকে গত কয়েক বছরে মানব পাচার শুরু হলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন চলতি বছরে প্রায় ১৬শ জনকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে। তস্মধ্যে সোমবার বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী গভীর বঙ্গোপসাগরে অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬শ লোকসহ একটি থাই জাহাজ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমানে উদ্ধার জাহাজটি চট্রগ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এছাড়া মানব পাচারের ঘটনায় বিদেশী নাগরিকসহ ২৫০ জন দালালের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তন্মধ্যে শতাধিক দালালকে আটক করা হয়। এ সব ঘটনায় মানব পাচার আইনে ৫১টি মামলা করা হয়েছে। এর পরও বন্ধ হচ্ছে না মানব পাচারের মত নিষ্ঠুর বাণিজ্য। বরং দিন দিন বিভিন্ন জেলার লোকজন পাচার কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ পাচার চক্রের সাথে কক্সবাজার জেলার কয়েক শতাধিক দালাল জড়িত রয়েছে। এদের মধ্যে ৩১ জনকে গডফাডার হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তবে মানব পাচার চক্রের প্রধানরা অধিকাংই মিয়ানমারের নাগরিক। এরা কক্সবাজার, টেকনাফ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় অবস্থান করে। তাছাড়া স্থানীয় কিছু নতুন নতুন দালাল গজে উঠে চক্রের সদস্যদের সাথে সাখ্যতা গড়ে তুলে নিরীহ লোকদের প্রলোভন দিয়ে বিনা টাকায় মালয়েশিয়ার পাচারের ফাঁদ পেতে সাগরের ট্রলারে উঠিয়ে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে। এ সব লোকজনকে থাইল্যান্ড নিয়ে আটকে নির্যাতন চালায। পরে তাদের পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। যাদের টাকা দিতে সমস্যা রয়েছে তাদের উপর চলছে মানষিক নির্যাতন। এ চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেক মা-বাবা সন্তান হারা হয়ে পড়েছে।

মানব পাচারকে কেন্দ্র করে টেকনাফে গড়ে উঠেছে কয়েকটি অপহরণকারী চক্র। এরা দেশের বিভিন্ন এলাকার মালয়েশিয়ায় যেতে আগ্রহী স্থানীয় নিরীহ লোকদের অপহরণ করে বস্তা হিসাবে দালালদের কাছে বিক্রি করে থাকে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনকে অপহরণ করে অন্য দালালের হাতে তুলে দেয়। এই চক্রের সদস্যরা যে কোনো লোককে অপহরণ করে জনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে দালালের কাছে পৌঁছে দেয়। ফলে লাভজনক এই অপহরণ ব্যবসায় নেমে পড়েছে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট।

এরা প্রথমে ওতপেতে থাকে টেকনাফ নতুন বাস টার্মিনাল পুরাতন বাস স্টেশন ও লেঙ্গুর বিল সড়ক, সাবরাং ডেইল পাড়া, নয়াপাড়া বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে। তবে টেকনাফ আসা বিভিন্ন যানবাহন পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই সিএনজি, মোটরসাইকেল ও নোহা মাইক্রো বাসে করে মালয়েশিয়াগামীদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। তবে অপহরণের শিকার হচ্ছেন মালয়েশিয়া যেতে না চাওয়া লোকজনও। এক্ষেত্রে টেকনাফে কাজের সন্ধানে আসা ব্যক্তিদের জোরপূর্বক অপহরণ করে দালালদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। দালালরা তাদের নির্যাতন চালিয়ে জোরপূর্বক তুলে দেয় মালয়েশিয়াগামী ট্রলারে। পরে থাইল্যান্ড পৌঁছার পর পরিবারকে মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করতে হয়।

এ পথে অপহরণ হওয়া এক যুবক জানান, গত শুক্রবার সাবরাং বাজারে কাজ করতে যাওয়া চকরিয়া উপজেলার রহমত উল্লাহ নামক এক যুবককে অপহরণকারী চক্র নিয়ে গিয়ে দালালদের হাতে বিক্রি করে দেয়। পরে তাকে উদ্ধারে তার পরিবার তৎপর হয়ে উঠে। তবে দালালরা তাকে সাগরে অবস্থানরত ট্রলারে উঠিয়ে দেয়। মঙ্গলবার সকালে সাগর থেকে দালাল চক্রের সদস্যরা তাকে নিয়ে আসে তার ভাইয়ের হাতে তুলে দেয়।
উদ্ধারকৃত রহমত উল্লাহ জানান, সাগরের সিটা নামক এলাকায় আমি ৮/১০টি মত জাহাজ দেখেছি। তবে আমাকে যে জাহাজে উঠিয়ে দেওয়া হয় সেখানে প্রায় সাড়ে ৪শ লোক রয়েছে। তবে প্রত্যেক জাহাজে কম বেশী লোকজনের দেখা পাওয়া যায়। তবে আল্লাহ তাকে রক্ষা করেছে বলে জানান।

চলতি বছরের এ পর্যন্ত সাগর পথে মালয়েশিয়া পাচারের ঘটনায় স্থানীয় বিভিন্ন প্রশাসনের অভিযানে প্রায় ১৬শ জন ভিকটিমকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় থানায় ৫১ টি মামলা করা হয়। এতে ২৫০ পাচারকারীকে আসামী রে মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় শতাধিক দালালকে আটক করা হয়। এ পাচার চক্রের উল্লেখযোগ্য কয়েক জন সদস্য হলো- সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ বাজার পাড়া এলাকার ধলু হোসেন, বেলাল, ডাঙ্গর পাড়া এলাকার মোঃ ফিরোজ, হোসন আলী, মোঃ কাশিম প্রঃ পোয়া মাঝি, হাজী পাড়ার মুজিব উল্লাহ, দক্ষিণ পাড়ার নূর হাকিম মাঝি, মাঝর পাড়ার মোঃ শফি প্রঃ বাইন্যা, নয়াপাড়া কচুবনিয়া এলাকার আব্দুল হামিদ, গুরা মিয়া, নূরুল ইসলাম বাগু, হারিয়াখালী এলাকার সাদ্দাম হোসেন, জিয়াবুল হক, হাফেজ উল্লাহ, কাটাবনিয়ার জাহাঙ্গীর, আলমগীর, আবুর কাসেম বাদ কোম্পানী, জাফর আলম, কুয়াইনছড়ি পাড়া এলাকার এজাহার মাঝি, মুন্ডার ডেইল এলাকার আক্তার কামাল, সাইদ কামাল, সাকের মাঝি, টেকনাফের দীল মোহাম্মদ দিলু, ফিরোজ, হামিদ, শফিক, নয়াপাড়া শরনার্থী ক্যাম্পের আমান উল্লাহ আমান, ডাঃ কবির, মোঃ আলম, আনোয়ার সাদেক, মোঃ সিরাজসহ আরো অনেকেই রয়েছে।

এরা মানব পাচারের মত নিষ্ঠুর কাজ করেও প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। প্রশাসনের নাগের ডগায় কিভাবে এলাকায় ঘোরাফেরা করে তা স্থানীয় মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।

স্থানীয়রা জানান, সাগর পথে মালয়েশিয়া যাত্রী অধিকাংশ উঠতি বয়সের যুবক। ইতিমধ্যে নারী ও শিশুদেরকেও পাচার করা হচেছ। স্থানীয় চিহ্নিত দালালরা দেশী-বিদেশী লোকজনকে উপকূলে জড়ো করে রাতে ইঞ্জিন বোটে করে সাগরে অবস্থানরত বড় ট্রলারে তুলে দিচেছ। প্রতিবছর পাচারকারীরা নিরীহ লোকজনকে ফুসলিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে সাগরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচেছ। তবে পাচারকারীরা স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীর ইন্ধনে এ কাজ চালিয়ে যাচেছ। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে ভয়াবহ অবস্থার আশংকা করা হচেছ।

বিজিবির ৪২ ব্যাটলিয়ান অধিনায়ক লে. কর্ণেল মো. আবু জার আল জাহিদ জানান, মানব পাচার প্রতিরোধে সীমান্ত পয়েন্ট ও চেকপোষ্টে বিজিবি তৎপর রয়েছে। ইতিমধ্যে পাচার রোধে সাবরাং উপকূলের খুরের মুখ নামক স্থানে অস্থায়ী বিজিবি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে তাদের অভিযান অব্যাহত রাখা হয়। এ বছরে ৪৪ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। তবে পাচার রোধে আইন শৃংখলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও জনগনের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি মোক্তার হোসেন জানান, মানব পাচার রোধে এলাকায় পুলিশের জোরদার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যার কারণে আগের তুলনায় পাচার অনেকটা কমে গেছে। তবে তিনি আরো জানান, চলতি বছরে থানায় বিভিন্ন সংস্থা ৫১টি মামলায় ২৫০ দালালের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এর মধ্যে শতাধিক দালালকে গ্রেফতার করা হয় অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন।

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন