পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা ক্রমশ জটিলতর হচ্ছে

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংকট প্রায় অর্ধ শতাব্দীর পুরনো একটি বিষয়। একটি স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর হতেই এই সংঘাতের সূচনা। চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান এই সমস্যার সৃষ্টি ও দীর্ঘায়িত করার পিছনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তেমনি এই অঞ্চলে বিচিত্র জাতিতাত্ত্বিক ও জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বিশেষত্ব প্রায় অমোচনীয় প্রভাব ফেলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এই রাজনৈতিক ও সামরিক সংকট প্রায় পাঁচ দশকের পুরনো একটি বিষয়। ইতিমধ্যে কর্ণফুলীতে অনেক পানি গড়িয়েছে, বহু রক্তপাত ও সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। বন পাহাড়ের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়েছে। এই ইস্যু নিয়ে বছরে পর বছর ধরে নানা রকম গুটি চালাচালি হয়েছে। আজ অবধি এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির কোনো সুরাহার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

ভৌগোলিক বিবেচনায় বাংলাদেশ মূলত একটি সমতল ভূমি। তবে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এলাকা একটি বন পাহাড়ি অঞ্চল। এই অঞ্চলটি পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে পরিচিত। এটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের একদশমাংশ। প্রায় দুর্গম এই ভূখণ্ডে বাংলাদেশের তাবৎ প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন চাষযোগ্য জমি, পাথর, বৃক্ষ প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদ দেশের মোট সম্পদের ৩৬ শতাংশ। হাজার বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম বৃহত্তর ভারতবর্ষের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুঘল আমলের আগেও এটি ভারতের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। প্রতিবেশী রাষ্ট্র বার্মা বরাবরই আলাদা একটি সত্তা হিসেবে পাশাপাশি রয়েছে। এই পাহাড়ি অঞ্চলে জনবসতি খুবই পাতলা। বিভিন্ন সময়ে নানা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বা উপজাতি এইসব বন পাহাড়ে বসবাস করেছে। এই অঞ্চলে এখন কমবেশি ১২ থেকে ১৪টি উপজাতি আছে। এই এলাকায় যেসব উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি বসবাস করে সেগুলো হচ্ছে চাকমা, মারমা, লুসাই, পাংখো, বনযোগী, বম, মুরং, কুকি, রাখাইন ইত্যাদি। এদের মধ্যে জনসংখ্যাগত দিক থেকে চাকমারা সর্ববৃহৎ ও প্রভাবশালী একটি উপজাতি। তবে অন্যান্য উপজাতির আগমনের পূর্বে এখানে কুকিরা প্রবেশ করে।

যতদূর জানা যায়, অন্যান্য উপজাতিগুলো অল্পবিস্তর চারশত বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছে। ব্রিটিশ শাসনামলেও অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি নিজেদের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ করে। ব্রিটিশ প্রশাসক ও সামরিক কর্তাদের অনেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে অনুসন্ধান করেছেন এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য হাজির করেছেন। এদের মধ্যে কর্নেল লেউইন ও হাচিনসনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বহিরাগত বসতি স্থাপনকারীরা জুম পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করে। তারা তুলা, ধান, শসা, তরমুজ, কচু, কুমড়া প্রভৃতি চাষ করে। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠিগুলো অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে এই ভূখণ্ডে বাইরে থেকে অনুপ্রবেশ করে তারা পাকাপোক্ত বসতি গড়ে তোলে। তাই তাদের কোনো বিবেচনায়ই আদিবাসী বলা যায় না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী সরকার একমাত্রিকভাবে বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের চেতনায় রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে। এমনকি পাহাড়িদেরও বাঙালি হওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। এতে পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠিগুলো প্রতিবাদ জানায়। তারা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি উপেক্ষিত হচ্ছে বলে মনে করে। এরা নিজেদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি দাবি করে। এই অবস্থা অনতিবিলম্বে সশস্ত্র লড়াইয়ে রূপ লাভ করে। পাহাড় অশান্ত হয়ে ওঠে। এই গোষ্ঠিগুলো পাহাড়কে এককভাবে পাহাড়িদের বাসস্থান হিসেবে দাবি করে। হিন্দু-মুসলিম বাংলাভাষী বাসিন্দাদের পাহাড় থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করে ভূখণ্ডের সর্বৈব কর্তৃত্ব নিজেদের কব্জায় নিতে চায়। তারা জুম্মল্যান্ড নামে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে। অন্য কথায় এরা বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

এজন্য তারা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও রাজনৈতিক সংগঠন উভয় গড়ে তোলে। একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র এই পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন করে এবং সামরিক প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য লজিস্টিক দিয়ে আশ্রয় প্রদান করে তাদের পাশে দাঁড়ায়। এইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিরস্ত করতে বাংলাদেশ সরকার সামরিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এসবের মধ্য দিয়ে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় রক্তপাত ঘটে সরকার দেশি-বিদেশি নানা মহলের সহায়তা ও সমর্থন চায়। অন্যদিকে আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসার পথ ধরে অগ্রসর হয়।

অবশেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে পাহাড়িদের সাথে তৎকালীন সরকার একটি শান্তি চুক্তি সম্পাদন করে। এতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মূলধারার জনগণ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই অসম চুক্তিটি যেমন আইনি বিবেচনায় সঠিক ছিল না, তেমনি ছিল রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব খর্বকারী ও অপমানজনক। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেকটি রাষ্ট্রের চুক্তি হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের একটি জনগোষ্ঠীর সাথে রাষ্ট্র কোনো চুক্তি করতে পারে না। অন্যদিকে পাহাড়িদেরও একটা অংশ এই চুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়নি, যা পরবর্তীকালে পাহাড়ে নতুন করে সংঘাত ও বৈরিতা উসকে দেয়। সেই সত্তরের দশক থেকে যে রক্তপাত শুরু হয় তা আজ পর্যন্ত বন্ধ করা যায়নি।

পাহাড়ে তৎপর খ্রিস্টান মিশনারিরা একটি কৌশলী পক্ষ হয়ে অলক্ষে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে ধর্মান্তর করানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। এটা এক ধরনের আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশবিশেষ। মিশনারিরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তারা শিক্ষা বিস্তার, মানবিক সহায়তা, দারিদ্র্য বিমোচন ও প্রভৃতি অযুহাতে জনতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তছনছ করছে। এভাবে জুম্মল্যান্ড ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে পাহাড়ি ও মিশনারিরা যোগসাজ করে অগ্রসর হচ্ছে।

দিনে দিনে পার্বত্য শান্তি চুক্তির ২৫ বছর অতিক্রান্ত হলো। কিন্তু কোনো মীমাংসা হয়নি, বরং শান্তি চুক্তি ভেস্তে গেছে। পাহাড়ে শান্তি আসে নাই, বেড়েছে রক্তপাত, চলছে নিরব যুদ্ধ। এর পাশাপাশি চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি, শান্তিপ্রিয় জনগণের সেখানে বাস করা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। পাহাড়ে রাষ্ট্র তথা সরকারের শাসন নিয়ন্ত্রণ অনেকটা শিথিল হয়ে পড়েছে। একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র পূর্বেকার মতই বিদ্রোহী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও অস্ত্রাদী দিয়ে সাহায্য করছে ওদের, ফলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

অন্যদিকে গোষ্ঠিগুলো তাদের নিজেদের গোষ্ঠিস্বার্থে পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি নতুন উপাদান। দৃশ্যপটে সশস্ত্র কুকি-চিনদের আবির্ভাব হয়েছে। এরা মায়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বরাবর যুৎসই অরণ্য অঞ্চলে ঘাঁটি স্থাপন করে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। তথাকথিত কুকি বিদ্রোহীরা পুরোদস্তুর সামরিক পোশাক প্রশিক্ষণ আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম নিয়ে যুদ্ধংদেহী চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে, একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তারা তৎপর।

এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী অবৈধ যোদ্ধাদের প্রধান নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। এরকম বহু পক্ষের নিরাপদ স্বর্গ হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে তথাকথিত শান্তি চুক্তির আওতাভুক্ত ভূখণ্ডটি। এই ইস্যুটি এখন চারদিক থেকে বাংলাদেশকে চেপে ধরেছে, বাংলাদেশকে অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা সুরক্ষার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ২৫ বছর পরেও পাহাড়ে শান্তির দেখা মেলেনি। তাই, দেশের অখণ্ডতা রক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য চাই প্রকৃত দেশপ্রেমিক একটি সরকার।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন