পাহাড়ের এই সংঘাত কি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা?

fec-image

উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতা, দ্বন্দ্ব, দ্বিধা-বিভক্তি, চুক্তির পর পুনরায় আবার সশস্ত্র সংগ্রামে ফেরত যাওয়া, গোপনে সশস্ত্র দল ও অস্ত্র মজুদ করা কখনোই চিরতরে বন্ধ হয়নি। হবেও না। পার্বত্য চট্টগ্রাম এই সংস্কৃতির বাইরে নয়। মূলত একই নৃতাত্ত্বিক ধারা অনুসরণ করেই তা চলছে, চলবে। নাগা জনগোষ্ঠির সব উপগোষ্ঠীর সবাই একেবারে নিরস্ত্র হয়ে যায়নি। যাবেও না। সবাই অস্ত্র সংবরণ করেছে মাত্র।

কুকি-চিন বহু আগে থেকেই মিজোরাম ভিত্তিক মাতৃ সংগঠন জো রিইউনিফিকেশন ফোরাম বা জোরাম-এর পতাকাতলে সংগঠিত হচ্ছিল বৃহত্তর কুকি-চিন মাতৃভূমি বা পিতৃভূমিতে ‌’কুকি ল্যান্ড’ নামক খ্রিস্টান লর্ডস ল্যান্ড সৃষ্টিতে। বাংলাদেশে এরা সংখ্যায় খুব কম বলে আমাদের চোখে পড়েনি বা আমরা পাহাড়ের সমস্যাকে চাকমাদের দেওয়া চশমাতে দেখতে অভ্যস্ত বলে অন্যদিকে মনোযোগ ছিল না। তিন দেশে বিচ্ছিন্ন সকলকে নিয়ে তারা যখন বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করছে, তখন আমরা বুঝতে পারছি আসলে এতোদিন তাদের আড়াল করা হয়েছে।

সরকার বা প্রশাসনের বা সার্বিকভাবে জনগণের ব্যর্থতা এদের সাথে কোনো নিবিড় যোগাযোগ সৃষ্টি না করা। এদের কোনো ফ্রুটপ্রিন্ট দেশের কোনো বাহিনীতে নেই, প্রশাসনে নেই, চাকরিতে নেই, উন্নয়নে পিছিয়ে। সবার নজর ছিল চাকমা-মারমা-ত্রিপুরা (চামাত্রি) জনগোষ্ঠির দিকে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে আরও ক্ষুদ্রতর এবং আরও বঞ্চনা বা অসম ভাগবাটোয়ারার মধ্যে পরে গেছে এরা।

পরশী দেশের কাজিনদের হাতে পড়ে এরা সচেতন হয়েছে। এখন আমরা জানতে পারছি ‘ট্যাংথা’ এবং ‘খ্যাংতা’র পার্থক্য। ওরা এখন দাবি করে তারাই লুসাই পাহাড়ের পাদদেশের ‘আদিবাসী’। তাদেরকে ব্রিটিশরা বিতাড়িত করে তাদের ভূমি চাকমা সার্কেল ও বোমাং সার্কেলকে দেওয়া হয়েছে। তাই সে পিতৃভূমি তারা ফেরত চায়, বাকীরা বহিরাগত। পুরো উত্তর-পূর্ব ভারতের সর্বত্র এই বিভাজন। তার সর্বশেষ উদাহরণ মণিপুরের সহিংসতা।

এতো দিন সন্তু লারমা খুব কার্যকরভাবেই কুকিদের এই ঐতিহাসিক দাবিকে আড়াল করে এসেছেন। এরা এখন একই রকম বঞ্চনার দাবি তুললে তিনি সেটাকে সরকারি ইন্ধন বলে আড়াল করতে চান। কিন্তু কুকিরা অত্যন্ত জাত্যাভিমানী ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধা বলে তারা আবার পুনর্জাগরণে মেতে উঠেছে। আর এই জন্য জাতিসংঘের আদিবাসী সংক্রান্ত ঘোষণা মূল প্রেরণা হিসাবে কাজ করছে। সরকারের মদদ বা ‘ডিভাইড এন্ড রুলস’র মতো সস্তা দাগে তাদের চিহ্নিত করা সত্যের বা বাস্তবতার অপলাপ।

হঠাৎ করেই নাথান বম চাকমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে বসায় সন্তু লারমা বিব্রত। তবে তিনি বহুকাল আগেই জানতেন এই ‘কুকি রেনেসাঁ’ মাথাচাড়া দেবেই। তাই ২০০০ সালেই তিনি চুক্তি বাস্তবায়িত হচ্ছে না, আবার পাহাড়ে সন্ত্রাস মাথাচাড়া দেবে আবার পাহাড় উত্তপ্ত হবে বলে হুমকি দিতেন। তিনি জানতে (আফসোস সরকারি মহল জানতো না) ‘তোমাকে বধিবে যে বাড়িছে গোকূলে সে’। তার নেতৃত্বের উপর চ্যালেঞ্জ আসবেই, তাই তিনি দ্রুত চুক্তি বাস্তবায়ন চাইতেন। তার উপলব্ধি ছিল (পাহাড়িদেরও) যে চুক্তি করার পর পরই সকল ক্যাম্প থেকে সব সেনা সুড়সুড় করে ৬টি ক্যান্টনমেন্টে সরে আসবে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে অরক্ষিত রেখে। চুক্তির পরপরই ‘অলিখিত’ চুক্তির ধারা অনুসারে সকল বাঙালি বসতিকারী (ভয়ে) ট্রাক ভরে ভরে আবার সমতলে চলে যাবে।

কিন্তু তার কল্পনার সাথে মিল না পেয়ে চুক্তির পরের বছর থেকেই তিনি হতাশা সূচক কথাবার্তা বলতে থাকেন এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরকারের মদদপুষ্ট বলে আখ্যায়িত করতে থাকেন।

কুকি-চিন আজ সরকার এবং চাকমা উভয়ের জন্য সংকট সৃষ্টি করছে। তবে এই সংকটের পেছনে প্রকৃত মদদদাতা সীমান্তবর্তী দেশ এবং ইউরোপ ভিত্তিক ইভানজেলিস্ট গ্রুপ ও এনজিও সংস্থাগুলো। এমনকি এর পেছনে পপি চাষের ভূমিকা মোটেও ফেলনা নয়।

লেখক: অবসর প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন