তাপপ্রবাহকে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ ঘোষণার এখনই সময়?

fec-image

গত কয়েক দিন যাবতই বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই প্রচণ্ড গরম চলছে। গতকাল আবহাওয়া অধিদফতর দিনাজপুরে সর্বোচ্চ ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে। এছাড়া দু’দিন আগে থেকেই তাপপ্রবাহের সতর্কতা দিয়ে রেখেছে আবহাওয়া অফিস, যা অব্যাহত রাখার কথা পূর্বাভাসে বলা হয়েছে।

এই মূহূর্তে তাপপ্রবাহ সবচেয়ে বেশি রাজধানী ঢাকা আর উত্তরবঙ্গে। সে তুলনায় তাপমাত্রা কিছুটা কম চট্টগ্রামে। তবে এই মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত তাপপ্রবাহ চলমান থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।

বাইরে কাঠফাটা রোদ আর ঘরে লোডশেডিং মানুষের জীবনকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। তৈরি হচ্ছে নানান স্বাস্থ্যঝুঁকি। কিন্তু তারপরও ঝড়, বন্যার মতো তাপদাহকে সেভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে যেন দেখা হয় না।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের পরিচালক নিতাই চন্দ্র দে মনে করেন, এ বিষয়ে সার্বিকভাবে সবার সচেতনতার অভাব আছে। ওইভাবে এটার প্রভাব আমরা দেখি না। এক্ষেত্রে জীবন ও সম্পকের ঝুঁকি সরাসরি দেখা যায় না। ফলে জনগণ উদ্বিগ্ন কম থাকে, কিন্তু এটার প্রভাব আছে। রেসপিরেটরি সমস্যা বেড়ে যায়, স্ট্রোক হতে পারে, মানুষ মারাও যেতে পারে। তাপপ্রবাহ অবশ্যই বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কারণ এখানে জীবনের ঝুঁকি আছে। আর সরকারও এ ব্যাপারে চিন্তা করছে।

বাংলাদেশে শৈত্যপ্রবাহ ঘিরে নানা পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। কিন্তু তাপপ্রবাহ বা হিটওয়েভের ক্ষেত্রে সেভাবে কোনো প্রস্তুতি বা পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না। তাই যদি এটি দুর্যোগের আওতায় আসে তাহলে এর ঝুঁকি কমিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: বেনজীর আহমেদ।

তিনি বলেন, যেভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি। আর এ থেকে সহসা পরিত্রাণ নেই। সুতরাং যদি এটাকে দুর্যোগ হিসেবে দেখা হয় তাহলে কিছু করার সুযোগ থাকে। যারা রোদে বাইরে কাজ করেন, কায়িক শ্রম বেশি করেন, শিশু বা বৃদ্ধের জন্য তাপমাত্রার আধিক্য জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ।

এ ঝুঁকি কমাতে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো প্রচার প্রচারণার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বিভিন্ন জায়গায় যেমন টয়লেট আছে তেমনি পানি পানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া কাজের সময়-ঘণ্টাও নতুন করে বিবেচনা করা যেতে পারে। আর্লি মর্নিং অফিস হতে পারে, সকাল থেকে ১১টা পর্যন্ত। আবার ২-৩ ঘণ্টা পর থেকে রাত পর্যন্ত। এসব নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসে গিয়েছে। হাই টাইম এটা।

‘ঘূর্ণিঝড় মোখা’ থেকেই তাপপ্রবাহ?
চলমান তাপপ্রবাহের তিনটি কারণের কথা বলছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর। যার একটি ঘূর্ণিঝড় মোখা।

আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম বলেন, সাইক্লোন মোখার কারণে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছিল। ফলে ভারত-বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেশি। মোখার সময় এই পুরো বেল্ট ওভারহিটেড হয়ে যায়। এটা একটা কারণ। মোখার প্রভাবে এখনো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহারে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বিরাজ করছে। আর সে থেকে লু-হাওয়া বইছে বাংলাদেশের দিকে। বজ্রঝড় কমে যাওয়াও তাপপ্রবাহের একটা কারণ। প্রত্যেকবার মে মাসে ১৮ থেকে ২৪ দিন কালবৈশাখীর আনাগোনা থাকে। ফলে হিমালয় থেকে সেভেন সিস্টার্স পর্যন্ত তাপমাত্রা কম থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, বজ্রঝড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

ফলে বৃষ্টিও কম হচ্ছে, মাটি উত্তপ্ত থাকছে। তাপপ্রবাহের আরেকটা কারণ হলো- বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্য। যা বাতাসের আর্দ্রতা বাড়াচ্ছে। একইসাথে বাতাসের গতিবেগও এখন অনেক কম। ফলে মানুষের কষ্ট আরো বাড়ছে।

কবে তাপপ্রবাহ শেষ হবে?
এই তাপপ্রবাহ থামাবে বৃষ্টি। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম জানান, এ মাসের ৯-১০ তারিখে বৃষ্টিতে সিলেট আর চট্টগ্রাম অঞ্চলে তাপপ্রবাহ কমে আসবে। কিন্তু ঢাকা ও উত্তরবঙ্গে তাপপ্রবাহ আরো ১ সপ্তাহ দীর্ঘ হতে পারে।

তাপপ্রবাহ থেকে নিরাপদ থাকতে নানারকম স্বাস্থ্য সতর্কতার কথা বলে থাকেন চিকিৎসকরা। যার অন্যতম হলো- শরীরে পর্যাপ্ত পানির যোগান। তবে সরাসরি ফ্রিজের ঠান্ডা পানি এড়িয়ে চলার পরামর্শ চিকিৎসকদের। এটি হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। একইসাথে আবাসন তৈরীতে তাপ নিরোধক উপাদান ব্যবহারের তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

স্বাস্থ্যঝুকিঁ ছাড়াও ভবিষ্যতে তাপপ্রবাহ থেকে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কাও দেখছেন জানিয়ে ডা: বেনজীর আহমেদ বলেন, অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ থেকে খরায় কিন্তু শস্য উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, আগামী আমন ধান নিয়ে কৃষকরা শঙ্কায়, কিছুদিন আগের বৃষ্টি খরা থেকে বাঁচিয়েছে- কিন্তু যদি মারাত্মক দাবদাহ হয়, তাহলে সেটি আমলে না নিয়ে উপায় নেই। তাপপ্রবাহে এরইমধ্যে বিপর্যস্ত আফ্রিকার অনেক দেশ।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের কিছু রাজ্যেও এ সঙ্কট আছে। আর এরকম কিছু যে বাংলাদেশেও হবে না সেটা বলা যায় না। তাই সচেতনতার পাশাপাশি তাপপ্রবাহ মোকাবেলায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি বাংলা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন