পাহাড়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একাধিক আস্তানা, বাংলাদেশিদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়

fec-image

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা সমুদ্র আর পাহাড় ঘেরা এবং রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা। এর মধ্যে রয়েছেন বাঙালি এবং উপজাতিও। একসময়ের শান্তিপূর্ণ এই অঞ্চলে সর্বত্র এখন অপহরণ আতঙ্ক। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারাও অপহরণের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। টেকনাফের পাহাড়-জঙ্গলে আস্তানা গড়ে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, গত ছয় মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সদরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৭২ জন অপহরণের শিকার হন। এর মধ্যে ৪০ রোহিঙ্গা ও ৩২ জন বাংলাদেশি। সব চেয়ে বেশি অপহরণের শিকার হন বাহারছড়ার বাসিন্দারা। ৭২ জনের মধ্যে ৪০ জন মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীদের স্বজনরা।

পাহাড়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একাধিক গ্রুপ
পুলিশের দাবি, ইয়াবা, সোনা চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায় জড়িত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা পেতো ৮-১০টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নেয়। সেইসঙ্গে স্থানীয় লোকজনের ঘরবাড়ি লুটপাট ও অপহরণ বাণিজ্যে নামে। এর ফলে আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, উপজেলার বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, হ্নীলা ও সদর ইউনিয়নে কয়েকটি পাহাড় আছে। এসব পাহাড়ে আস্তানা গড়েছে ১০-১২টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তাদের অপহরণ থেকে রক্ষা পাচ্ছে না শিশু, ছেলেমেয়ে, স্কুলছাত্র এমনকি অটোরিকশাচালকরা। যেকোনো সময় অপহরণের শিকার হন। ফলে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে সন্ধ্যার পর সন্তানদের ঘরের বাইরে যেতে দেন না। কেউ কেউ সন্তানদের বিশেষ পাহারায় বিদ্যালয়ে পাঠান। অপহরণের ঘটনায় থানায় জিডি ও অভিযোগ দিয়েও প্রতিকার মিলছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

থানায় শুধু সাত মামলা
পুলিশের তথ্যমতে, গত নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় সাতটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৪৬ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পাশাপাশি অভিযান চালিয়ে এপ্রিল মাসে তিনটি অস্ত্রসহ আরও ২৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সন্ত্রাসীরা মেরে ফেলবে এই ভয়ে থানায় যান না অপহরণের শিকার পরিবারের সদস্যরা। কেউ সাহস করে মামলা দিলেও কাজ হয় না।

টেকনাফের পাহাড়-জঙ্গলে আস্তানা গড়ে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা
তবে অপহরণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারের চেষ্টা চালানো হয় জানিয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি আব্দুল হালিম বলেন, ‘সম্প্রতি অপহরণের শিকার কয়েকজনকে উদ্ধার করেছি। সেইসঙ্গে অপহরণে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’

ওসি বলেন, ‘অপহরণকারীদের ধরতে আমরা তৎপর। তবে অনেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরলেও আমাদের জানায় না। সহযোগিতা করতে চায় না। কিছু ঘটনা মাদক সংশ্লিষ্ট। সবমিলিয়ে স্থানীয়দের সহযোগিতা পেলে সব অপরাধীকে ধরতে পারবো।’

মুক্তিপণ দিয়ে ফেরা
সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল বাহারছড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জাহাজপুরার বাছা মিয়ার ছেলে রহিম উদ্দিন (৩২) ও মো. সরোয়ারের ছেলে কলেজছাত্র রেদোয়ানকে (২০) অপহরণ করা হয়। ৩৬ ঘণ্টা পর তাদের উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ২ মে রাতে নুরুল আমিন (৪০) নামে একজনকে অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেফতার করা হয়। ২৬ এপ্রিল নয়াপাড়া ক্যাম্পের তিন শিশু অপহরণের শিকার হয়। পরে পরিবার মুক্তিপণ দিলে ছেড়ে দেয় সন্ত্রাসীরা। এর আগে ৩ মার্চ দুই শিশুকে অপহরণের আট ঘণ্টা পর ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে আনে পরিবার।

গত ৮ জানুয়ারি হ্নীলা ইউনিয়নের লেচুয়াপ্রাং এলাকায় ক্ষেত পাহারা দেওয়ার সময় চার কৃষককে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পরে ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরেন।

গত ১৮ ডিসেম্বর জাহাজপুরা এলাকায় খালে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন আট ব্যক্তি। তারা ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফেরেন।

ছদ্মবেশে অপহরণ
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ইউপি সদস্য বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা দিনে ছদ্মবেশে বিভিন্ন এলাকায় চলাচল করে। জানার চেষ্টা করে কাকে অপহরণ করলে বেশি টাকা পাওয়া যাবে, সেভাবে টার্গেট করে অপহরণের ঘটনা ঘটায়।’

বাহারছড়ার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. হুমায়ুন বলেন, ‘এই ইউনিয়নে অর্ধলাখের মানুষের বসবাস। অধিকাংশ জেলে এবং কৃষিকাজ করেন। সবাই অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে দিনেও ঘর থেকে বের হন না।’

বাহারছড়া ইউনিয়নের এক নারী সদস্য এবং ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চৌকিদার মো. ইসহাক অপহরণ চক্রের সঙ্গে জড়িত বলেও উল্লেখ করেন হুমায়ুন। তিনি বলেন, ‘অপহরণে জড়িত থাকায় বর্তমানে কারাগারে ইসহাক। তবে নারী সদস্য এখনও গ্রেফতার হননি। বারবার অভিযোগ করার পরও অপহরণরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি পুলিশ। এ অবস্থায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছি আমরা।’

সবাই আতঙ্কে
নিয়মিত টেকনাফ স্থলবন্দরে কাজে যাওয়া লেদা এলাকার বাসিন্দা মো. আনিস বলেন, ‘সবসময় অপহরণ আতঙ্কে থাকি। একসঙ্গে ৮-১০ শ্রমিককে দলবেঁধে যাতায়াত করতে হয়। দমদমিয়া থেকে স্থলবন্দর এলাকা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। দিনেও এই সড়কে অপহরণের ঘটনা ঘটে। তবে এখন সড়কে পুলিশি টহল দেখা যায়।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিয়মিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাতায়াতকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অপহরণের ভয়ে আগের তুলনায় ক্যাম্পে যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছি। দিন দিন মানুষের মাঝে ভয়ভীতি বাড়ছে।’

মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা কয়েকজন জানিয়েছেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের সহায়তায় পাহাড়গুলোতে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে। অপহরণ, মাদক বেচাকেনা ও মানবপাচার তাদের প্রধান কাজ। অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে। গত এক বছরে শতাধিক ব্যক্তিকে অপহরণ করেছে তারা। বেশিরভাগ মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছেন।

রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকা তৈরি
ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েকটির তালিকা তৈরি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেগুলো হলো—গিয়াস গ্রুপের গিয়াস ডাকাত, আলম গ্রুপের শাহ আলম, ছলেহ গ্রুপের ছলেহ ও আলমগীর, জাহেদ গ্রুপের জাহেদ হোসেন, শফি উল্লাহ গ্রুপের শফি ও আবু হুরাইরাহ গ্রুপের আবু। তালিকায় অপহরণ চক্রের সদস্য হিসেবে নাম আছে—আবুল বশর, মকবুল আহম্মদ, মো. রুবেল, আব্দুর রহমান, মো. ফিরোজ, আবু ছিদ্দিক, মো. হোসেন ওরফে মাছন, আয়াতুল তমজিদ, সিরাজুল মাঝি ওরফে বার্মাইয়া সিরাজ, মো. ইসমাইল, জয়নাল, ফরিদ আহমদ, ওসমান, ফরিদ আহমদ, মো. হাছন, শহিদ উল্লাহ, মো. রয়াজ, মিজানুর রহমান, নুর মোহাম্মদ, মনির আহাম্মদ ও মোহাম্মদ আলী।

এর মধ্যে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, মানবপাচার ও অপহরণসহ নানা অপরাধে গত শুক্রবার রাতে ছলেহ ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এর আগে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে আবু হুরাইরাহ।

জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা বলছেন, অপহরণ নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনদুপুরে অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এসে যে কাউকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি আস্তানায় আটকে মুক্তিপণ আদায় করছে। অপহৃতদের জীবিত রক্ষা করতে ধারদেনা, গরু-ছাগল ও ভিটেমাটি বিক্রি করে মুক্তিপণ দিচ্ছে পরিবার। মুক্তিপণ না দিলে চলে ভয়াবহ নির্যাতন। পুলিশ অভিযান চালালে অপহৃতদের গুলি করে ফেলে রেখে যায়। কেউ জীবিত ফিরে আবার কারও লাশ পাওয়া যায়।

যা বললেন ফিরে আসা ব্যক্তিরা
এপ্রিল মাসের শেষ দিকে অপহরণকারীদের হাত থেকে বেঁচে ফেরা মো. ফয়সাল এখনও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন। অপহরণ ও নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ফয়সাল বলেন, ‘মুক্তিপণের জন্য কী পরিমাণ নির্যাতন করেছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। এখনও ভয়ে আঁতকে উঠি। পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ভয়ঙ্কর। মৃত্যু কাছ থেকে দেখেছি। তাদের কাছে ভারী অস্ত্রশস্ত্র আছে, বড় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। র‌্যাব-পুলিশ অভিযান চালানোর আগেই খবর পেয়ে যায় তারা।’

‘পুলিশ উদ্ধার অভিযান চালালে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। হাত-মুখ ও চোখ বেঁধে রেখেছিল আমাদের। টার্গেট যেকোনো উপায়ে মুক্তিপণ আদায়। তারা বারবার বলেছিল, “অভিযানের কারণে মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করবো তোদের”। পরে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছি’ বলছিলেন ফয়সাল।

সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ
পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং, টেকনাফ স্থলবন্দর সংলগ্ন দমদমিয়া ও জাদিমুড়া এলাকায় অপহরণ কর্মকাণ্ড বেড়েছে। এসব এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘এসব এলাকার পাহাড়-জঙ্গল পরিষ্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। পাশাপাশি সিসিটিভি ক্যামেরা ও পুলিশের চৌকি স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে অপহরণের ঘটনা কমে যাবে। পাহাড়ি এলাকার চাষিদের দলবেঁধে কাজে যাওয়ার কথা বলেছি।’

স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে পাহারা
হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমার এলাকায় অপহরণের ঘটনা বেড়ে গেছে। ফলে দমদমিয়া ও জাদিমুড়া এলাকায় স্বেচ্ছাসেবীদের দুটি দল রাতে পাহারা দিচ্ছে। এরপরও অপহরণরোধ করা যাচ্ছে। ছদ্মবেশে এসে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এসব কাজে কিছু স্থানীয় বাসিন্দাও জড়িত।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপহরণ, পাহাড়, বাংলাদেশ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন