পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির রজতজয়ন্তী উপলক্ষে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে

পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন নিষিদ্ধসহ অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২৫ বছর পূর্ণ হবে ২ ডিসেম্বর ২০২২ । পাহাড়ে প্রায় দুই দশকের সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর কেটে গেছে ২৪ বছর। কিন্তু এখনো এ চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি।

সরকার পক্ষ বলছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি ধারা বাস্তবায়িত হবে। অপর দিকে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পাহাড়িদের ৬টি সশস্ত্র সংগঠনের লড়াইয়ে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড় । এসব সংগঠনের তৎপরতায় পাহাড়ের মানুষের আশা-আকাঙ্খা সবকিছু ধূলিসাতের অস্থির হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। হত্যা, গুম, খুন, অপহরণ, গোলাগুলির মত ঘটনায় আরো শঙ্কিত পাহাড়ের সাধারণ মানুষ।

চুক্তির পর গত ২৪ বছরে ৬টি পাহাড়ি সশস্ত্র গ্রুপ নিজেদের মধ্যে সংঘাত ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ অন্তত ৮ শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী এবং সাধারণ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়াও এদের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পে চাঁদাবাজিসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। সংঘাত সহিংসতা মাঝে-মধ্যে পাহাড়ের সম্প্রতির উপরও আঘাত হানছে। উন্নয়নের গতি বাড়াতে ৬ সশস্ত্র সংগঠন নিষিদ্ধসহ চাঁদাবাজি বন্ধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্বার দাবি সকল মহলের।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পূর্তি ( রজতজয়ন্তী) উপলক্ষে খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও কনসার্টসহ দুই দিনে কর্মসূচির আয়োজন করেছে।

চুক্তির স্বাক্ষরের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হাতে গেরিলা নেতা সন্তু লারমার অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে জন সংহতি সমিতির সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু চুক্তির পর একে একে পাহাড়িদের ৬টি সশস্ত্র সংগঠন জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (প্রসীত), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের লড়াই চলছে।

সম্প্রতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও প্রাণ হারিয়েছে। এছাড়া গত ২৪ বছরে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর আধিপত্য বিস্তার লড়াইয়ে ৮ শতাধিক শতাধিক নিহত ও সহস্রাধিক আহত হয়েছে। ৬টি সশস্ত্র সংগঠনের সহিংসতা মাঝে-মধ্যে পাহাড়ের সম্প্রতির উপরও আঘাত হানছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ছে সন্ত্রাসীরা। উদ্ধার হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। সাধারণ মানুষ চান উন্নয়নের গতি বাড়াতে বাধাগ্রস্ত চাঁদাবাজি বন্ধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার।

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। সরকার পক্ষ বলছে, চুক্তির চুক্তির পর পাহাড়ে শান্তি ফিরেছে। উন্নয়নে গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। পাহাড়ি-বাঙালি সহাবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। অপর দিকে চুক্তির বিরোধীতাকারী বলছে, চুক্তি পাহাড়ের বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালিদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। জাতিতে জাতিতে ভ্রাতিঘাতী সংঘাত সৃষ্টি করেছে। হানাহানি ও চাঁদাবাজি বেড়েছে।

ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক’র কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মিটন চাকমা পাহাড়ে ৬টি সশস্ত্র পাহাড়ি সংগঠনের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে সব সমস্যার সমাধান রয়েছে।’

পার্বত্য নাগরিক পরিষদে খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মজিদ বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সুবিধা থেকে পাহাড়ে বৃহৎ জনগোষ্ঠী বাঙালিদের অধিকার হরণ করেছে। প্রতিদিন নিত্য নতুন বাহিনীর জন্ম হচ্ছে। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে পাহাড়ের মানুষ অশান্তিতে আছে।’

খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর পাহাড়ে শান্তির পরিবর্তে ৬টি অবৈধ অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী সংগঠনের জন্ম হয়েছে। বেড়েছে সংঘাত বেড়েছে। সর্বত্র চাঁদাবাজি চলছে। আগে একটি সংগঠনকে চাঁদা দিলে হতো। এখন ৬টি সন্ত্রাসী সংগঠনকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। পাহাড়ে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন শুধু সাধরণ মানুষ নয়, যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন, তারাও নিরাপদ নয়। ৬ সশস্ত্র সংগঠন নিষিদ্ধসহ চাঁদাবাজি বন্ধ ও অবৈধ অস্ত্র উদ্বারের দাবি জানান।

খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অধিকাংশ ধারাই বাস্তবায়িত হয়েছে। অবশিষ্ট ধারা বাস্তবায়নে উভয় পক্ষকেই সহনশীল হতে হবে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান সম্ভব।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ব্যর্থ চুক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে সাবেক চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভূইয়া বলেন, ‘২৫ বছরে এ চুক্তি পাহাড়ে ভ্রাতিঘাতী সংঘাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বৈষম্যমূলক চুক্তি পাহাড়ে অনেক রক্ত ঝরিয়েছে। কোন নাগরিককে তৃতীয় শ্রেণি, কোন নাগরিককে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছে। চুক্তিতে যে সকল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, এ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্পণ করেছে।’

তিনি এ চুক্তিকে সংবিধান ও সার্বভৌমত্ব বিরোধী আখ্যায়িত করে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি একই ভূখণ্ডে ভিতরে আলাদা দুটি ধারা সৃষ্টি করেছে।সারাদেশের জন্য একটি আইন আর পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য অন্য আইন। পাহাড়ের মানুষ সমতলে গিয়ে জমি কিনতে করতে পারবে। কিন্তু সমতলের মানুষ পাহাড়ে জমি কিনতে পারবেনা। এমন কি পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে কোন জমি কিনতে হলে আঞ্চলিক পরিষদের অনুমতি নিতে হবে।’

ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোস চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি বলেন,‘ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছেন। চুক্তিতে কোন জনগোষ্ঠীর অধিকার খর্ব করা হয়নি। বরং সহাবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। উন্নয়নে গতি বেড়েছে। চুক্তির পাহাড়ে সকল সেক্টরে উন্নয়ন হয়েছে ’

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী বলেন, ‘ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির রজতজয়ন্তী ২৫ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়ন, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্ণাঢ্য র‌্যালি ও কনসার্টসহ দুই দিনের কর্মসূচির আয়োজন করেছে ।হানাহানি বন্ধ হবে ও ফিরে আসবে শান্তি এই প্রত্যাশা পাহাড়ের মানুষের।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অস্ত্র উদ্ধার, পাহাড়, সশস্ত্র সংগঠন
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন