প্রেস ইউনিয়ন অব ইসলামিক ওয়ার্ল্ড কেন?

মেহেদী হাসান পলাশ

পেন্টাগন বিশ্বকে শাসন করার জন্য, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে শাসন ও হস্তক্ষেপ করার জন্য এক একটি দশকে ভিন্ন ভিন্ন টার্মিনলজি বা থিওরি দাঁড় করায়। যেমন- বিগত শতাব্দীর শেষ দশকে তাদের টার্মিনলজি ছিল ‘ফান্ডামেন্টালিজম’ বা মৌলবাদ। কিন্তু নব্বই দশকের শেষ দিকে এসে মুসলমানরা সফলভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয় যে, ফান্ডামেন্টালিজমের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। এর জন্ম ও বিকাশ ক্রিস্টিয়ানিটির মধ্যে। তখন তারা নতুন টার্মিনলজি নির্ধারণ করে। অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তাদের নতুন টার্মিনলজি ছিল ‘টেরোরিজম’ বা সন্ত্রাসবাদ। এই দশকে তারা মুসলিম বিশ্বে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে। কিন্তু টানা এক দশক ধরে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ পরিচালনার ফলে মার্কিন অর্থনীতিতে যে ভয়াবহ মন্দা সৃষ্টি হয় তার ভার দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না। ফলে তারা আবার তাদের টার্মিনলজি পরিবর্তন করে নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে নির্ধারণ করে ‘ডিমোক্রেসি’ তথা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব। পেন্টাগনের ব্রেন চাইল্ড এই গণতন্ত্রের তত্ত্বে যুক্তরাষ্ট্র এই দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হস্তক্ষেপ করছে। এই হস্তক্ষেপ কিছুটা পরোক্ষ হওয়ায় এর আর্থিক ব্যয় অনেক কম।
এ থিয়োরিতেই যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রায়নের নামে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গণবিপ্লব সংঘটনে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। তিউনিশিয়া, মিশর, লিবিয়াতে গণবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র এখন সিরিয়াতে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে সে দেশের বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীর বিপ্লবে সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু যে বিশেষ উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে গণবিপ্লবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল তা সফল হয়নি। বরং ফল হয়েছে উল্টো। দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের পতনের পর যখন জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন সে সরকার আরো অনেক বেশি ইসলামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে করে ‘ডিমোক্রসি’ তত্ত্ব এখন পেন্টাগনের ‘ডেড হর্সে’ পরিণত হয়েছে। ফলে এই তত্ত্ব ইতোমধ্যে তারা পরিত্যাগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন সিরিয়া থেকে সম্মানজনকভাবে বিদায়ের পথ খুঁজছে ইরানকে টার্গেট করে সিরিয়া যুদ্ধকে আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ দেয়ার পাঁয়তারা করছে। এ নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ রয়েছে। কিন্তু এ লেখার গতি সেদিকে নয়।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের নামে যে গণবিপ্লব সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে, পাশ্চাত্য গণমাধ্যম তার নাম দিয়েছে অৎধন ঝঢ়ৎরহম বা ‘আরব বসন্ত’। পাশ্চাত্য গণমাধ্যমের অনুকরণে বা প্রভাবে মুসলিম, অমুসলিম বিশ্বের প্রায় সকল গণমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীকুল তাকে ‘আরব বসন্ত’ বলেই ডেকেছে। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, ‘আরব বসন্ত’ বলা হলেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে যে দেশগুলো আরব দেশ নামে পরিচিত আরব বসন্ত সেই দেশগুলোর একটিকেও স্পর্শ করেনি। কারণ আরবের ওই দেশগুলোতে রয়েছে মার্কিনীদের বশংবদ সরকার। কাজেই মিডিয়ার কল্যাণে লিবিয়া, তিউনিশিয়া, মিশর, সিরিয়া প্রভৃতি অনারব দেশগুলোতে সংঘঠিত বিপ্লব বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘আরব বসন্ত’ বলে। মিডিয়া আগ্রাসনের এ এক জলন্ত নজির।
দুই.মালালা ইউসুফজাই- পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তানের এই কিশোরীকে বর্তমানে নতুন করে পরিচয় করে দেয়ার কিছু নেই। তালিবান অধ্যুষিত উত্তর ওয়াজিরিস্তানে নারী শিক্ষা প্রসারের আন্দোলন করে গত অক্টোবরে তালেবানদের গুলিতে মাথায় মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আহত হয় এই কিশোরী। তেহরিকে তালেবান নামের একটি উগ্রপন্থী সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে। এরপর বিশ্ব মিডিয়া বিশেষ করে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলো কিশোরী মামালার উপর তালেবানদের হামলাকে ‘নারী শিক্ষার বিপক্ষে ইসলামের হামলা’ রূপে চিহ্নিত করে ইসলামকে কনডেম করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ইসলাম বিরোধী মিডিয়াগুলোর প্রচারের বন্যায় ভেসে অন্য প্রায় সকল মিডিয়া, এমনকি মুসলিম দেশের মিডিয়াগুলোও এমনভাবে প্রচার শুরু করে যেন, ‘ইসলাম নারী শিক্ষা বিরোধী’। মালালাকা-ের পর জাতিসংঘ তার স্মরণে ‘আন্তর্জাতিক মালালা দিবস’ পালন করেছে। বিশ্বের বড় বড় সব পুরস্কার দেয়া হয়েছে, এমনকি তাকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার জন্য দাবি উঠেছে প্রবলভাবে। পাশ্চাত্যের কর্মকা-ে মনে হয় মুসলিম বিশ্বে মালালাই একমাত্র নারী যে তার শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
অথচ আল্লাহ তায়ালা আল কোরআনে জ্ঞান অর্জনকে নারী পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ করেছেন। ইসলাম যখন নারী শিক্ষার কথা বলেছে পাশ্চাত্য তখন নারীকে দাসী ও ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু মনে করেনি। কাজেই কোনো প্রকৃত মুসলমান নারীকে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না এবং এজন্য কোনো নারীকে আঘাত করতে পারে না। যে মুসলিম কোরআনের নির্দেশ পালন করতে নিজ জীবনকে তুচ্ছ করে জিহাদের পথে নাম লিখিয়েছে, সেই মুসলিম একই কোরআনের নির্দেশ অমান্য করে শিক্ষাগ্রহণের অপরাধে কোনো নারীকে হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত করতে পারে তাও অবিশ্বাস্য।
একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন- ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তানে তালেবান বা জিহাদী নাম সংযুক্ত অনেক সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে যারা মূলত ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন রাষ্ট্র ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত হয়। তারা ইসলাম বিরোধী প্রভুদের নির্দেশে এমন সব সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে যার দোষ ইসলাম বা ইসলামপন্থীদের ঘাড়ে পড়তে বাধ্য এবং এ হামলাগুলো এমনভাবে পরিচালিত হয় যাতে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি ও হেয় করা যায়। কখনো তারা প্রকৃত জিহাদী সংগঠনের মধ্যে অনুচর প্রবেশ করিয়ে, আবার কখানো এ ধরনের কোনো সংগঠনের কোনো নেতা বা উপগ্রুপকে নিয়ন্ত্রণ করে তাদের দিয়েও এমন কাজ করিয়ে থাকে। মালালা ইউসুফজাই’র ওপর হামলাকারী সন্ত্রাসী সংগঠন তেহরিকে তালেবান এমনই একটি সংগঠন। এই সংগঠনটিই ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিপিপি প্রধান বেনজির ভুট্টোর ওপর আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়ি তাকে হত্যা করে। অথচ দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর পাকিস্তানে তখন কেবলমাত্র গণতন্ত্র উত্তোরণের চেষ্টা করেছিল নেওয়াজ শরীফ ও বেনজির ভুট্টোর দল। সংগঠনটির তৎকালীন প্রধান বায়তুল্লাহ মেহসুদ গণমাধ্যমে ফোন করে এই হামলায় দায়দায়িত্ব স্বীকার করেন। বায়তুল্লাহ মেহসুদ ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন। বর্তমানে এই সংগঠনটির প্রধান তার ভাই হাকিমুল্লাহ মেহসুদ হলেও সংগঠনটির মধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে জানা যায়। তেহরিকে তালেবান সংগঠনের কোনো কোনো গ্রুপ ইসলাম বিরোধী বিভিন্ন গোয়েন্দাসংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা ও নির্দেশনায় পরিচালিত বলে অনেকের ধারণা। পাশ্চাত্যের এজেন্টদের ইশারায় মালালা এদেরই কোনো গ্রুপের হামলার শিকার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে মালালা হামলার পর পাশ্চাত্য শক্তি ও এর গণমাধ্যমগুলো মালালা ইস্যুকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তাতে এ ধারণা অনেকের বিশ্বাসে পৌঁছেছে।
বিগত দুই দশকে ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তানে মার্কিন বাহিনীর হামলায় বিপুল পরিমাণ নারী শিশু আহত, নিহত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সেসব হামলায় অনেক শিশু আহত হয়ে শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অনেক শিশু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়েছে। ক্ষেপনাস্ত্র হামলায় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের জন্য কখনো জাতিসংঘ ও পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর এই সহমর্মিতা লক্ষ্য করা যায়নি। সেসব আহত শিশুর চিকিৎসায় নিউইয়র্ক, লন্ডনের কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। সেসব হাজার হাজার শিশুদের জন্য কোনো দিবস বা পুরস্কার ঘোষণা করেনি জাতিসংঘ বা পাশ্চাত্য কোন সংস্থা।
এমনকি মালালা নিজেও কোনোদিন তার দেশে বা প্রতিবেশী আফগানিস্তানে মাার্কিন হামলায় নিহত শিশুদের নিয়ে বা আহত শিশুদের শিক্ষার অধিকার নিয়ে কোনো কথা বলেননি। ড্রোনের আঘাতে বিধ্বস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখতে যাননি। নারী শিক্ষার বিষয়ে মালালা যদি এতই অন্তঃপ্রাণ হতেন তাহলে এসব নির্যাতিত নারী শিশুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, মালালা পাশ্চাত্যের রোপিত ইসলাম বিদ্বেষী একটি চারাগাছ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু পাশ্চাত্যের মিডিয়া তাকে বীর উপাধিতে ভূষিত করেছে। আর কোনো বাছবিচার ছাড়াই মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ মিডিয়া তাকে বীর বলে গ্রহণ করেছে।
তিন.
আক্রমণের প্রকৃতি বিচারে সন্ত্রাসবাদকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। একটি হার্ড টেরোরিজম বা প্রত্যক্ষ সন্ত্রাসবাদ, অন্যটি সফট টেরোরিজম বা পরোক্ষ সন্ত্রাসবাদ। সাইবার টেরোরিজম হলো সফট টেরোরিজম বা পরোক্ষ সন্ত্রাসবাদের একটি পন্থা। বাংলাদেশী ছাত্র শাহরিয়ার আহসান নাফিস সম্ভবত নিজেকে এই সাইবার টেরোরিজমের বিরুদ্ধে একজন সেনাপতি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। তাই সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে পড়াশোনা করতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন এবং পড়াশোনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের মিসোরী স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। কিন্তু সেখান থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিউইয়র্কের একটি টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। দুর্ভাগ্য তার, যে সন্ত্রাসবাদ মোকবেলার ইচ্ছা নিয়ে হয়তো পড়াশোনা করতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ‘স্টিং অপারেশনের’ খপ্পরে পড়ে তিনিই আজ ওয়ার্ল্ড টুইন টাওয়ার হামলার পর মার্কিন সরকারের চোখে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হামলার পরিকল্পনাকারী সন্ত্রাসী। মার্কিন সরকারের ভাষ্যমতে, এফবিআই নাফিসের পেছনে একজন ছদ্মবেশী গোয়েন্দা নিয়োগ করে যিনি নাফিসকে মার্কিন বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি ও জঙ্গীবাদী কর্মকা-ে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি নাফিসকে নিউইয়র্কস্থ মার্কিন ফেডালের রিজার্ভ ব্যাংকে হামলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ছদ্মবেশী গোয়েন্দাটি নাফিসকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে হামলার জন্য এক হাজার পাউন্ড বিস্ফোরক ভর্তি বোমা, যানবাহন, অর্থ এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি সরবরাহ করেন। নাফিস নির্ধারিত দিনে মার্কিন এফবিআই এজেন্টের সরবরাহকৃত বোমা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে একটি ভ্যানে করে বহন করে নিয়ে আসে এবং তাকে সরবরাহ করা মোবাইলে কল দিয়ে সেই বোমা বিস্ফোরণের জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু নাফিস জানতো না তাকে সরবরাহকৃত বোমাটি নকল তারমধ্যে বিস্ফোরণের উপাদান ছিল না। ফলে সে বোমাটি বিস্ফোরণে ব্যর্থ হয় এবং মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনী এসময় তাকে গ্রেফতার করে। এই হল ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর নাফিসকে গ্রেফতারের পেছনের কারণের মার্কিন ভাষ্য। এই ভাষ্য নিয়ে অনেক বিতর্ক করা যায়, অনেক যৌক্তিক প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু এ লেখার গতি সেদিকে নয়।
নাফিস ইতোমধ্যে মার্কিন আদালতে ‘এফবিআই ভাষ্য’ অস্বীকার করেছে বলে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। তবে এ বিষয়ে নাফিসের বক্তব্য কি তা জানায়নি মার্কিন সরকার। এমন কি অত্যন্ত শক্তিশালী মার্কিন গণমাধ্যমও এমন অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনায় প্রধান ভিকটিমের কোনো ভাষ্য প্রকাশ করেনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার নিয়ম মেনে। এ ঘটনার পর আরেক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মার্কিন তরুণ সামিউর জানায়, এফবিআই একইভাবে তাকেও নিয়োগ করেছিল বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম তরুণদের সাথে বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে তাদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার জন্য। তার কাজ ছিল, মুসলিম তরুণদেরকে জঙ্গীবাদে উসকানি দেয়া, যাতে তাদের কারো মনের মধ্যে জঙ্গীবাদের বাসনা থাকলে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু সামিউর বিবেকের তাড়নায় সম্প্রতি এই কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে।
নাফিসের ঘটনার পর খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সহৃদয়বান ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের এই আপারেশন স্টিং-এর সমালোচনা করে বক্তব্য রেখেছে। তারা নাফিসের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে বলেছে, ‘দ্যা কান্ট্রি মেড হিম টেরোরিস্ট’। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের মিডিয়াগুলো এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের এই আপারেশন স্টিং-এর তেমন কোনো সমালোচনা করেনি। কিংবা নাফিসের পক্ষে দাঁড়িয়ে কোনো জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তুলেনি।
পাশ্চাত্যের সকল গণমাধ্যম নাইন ইলেভেনের জন্য মুসলমানদের দায়ী করেছে ঢালাওভাবে। কিন্তু খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসংখ্য বিজ্ঞানী, গবেষক, প্রকৌশলী এ ঘটনার মার্কিন বয়ানকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। আর যার এর বিরোধীতা করেছেন তারা কেউ মুসলিম নন। এমনকি তারা ওয়ার্ল্ড টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার ঘটনাকেই সম্পূর্ণ বাতিল বলে তা অন্তর্ঘাতমূলক ঘটনা প্রমাণ করেছেন। বিভিন্ন গবেষণা পুস্তক ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করে তারা তাদের পক্ষে নানা অকাট্য যুক্তি তুলে ধরলেও পাশ্চাত্যের মিডিয়ায় তা প্রচার করা হয়নি। এমনকি মুসলিম দেশের মিডিয়াগুলোও এইসব বই পুস্তক ও তথ্যচিত্রের প্রচার করেনি তেমন একটা। অথচ এসব গবেষণা, বই লেখা, তথ্যচিত্র নির্মাণ ও বক্তব্য রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সেসব বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা চাকুরিচ্যুতিসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন। সে সকল খবরও প্রকাশ করতে দেয়া হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র মুক্তচিন্তা ও মুক্তবাকে বিশ্বাসী একটি রাষ্ট্র তবে সেসব শুধু তার পক্ষে গেলেই।
চার.
বিশ্বে মুসলমানদের আজকে যে পশ্চাদাবস্থানের কারণ একদিকে যেমন মুসলিম বিশ্বের মধ্যে বিরাজমান অনৈক্য, দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস; অন্যদিকে নিজেদের লক্ষ্য ও ইতিহাস ভুলে যাওয়া, ধর্ম ও সংস্কৃতি থেকে সরে যাওয়া। একথা অনস্বীকার্য যে, মুসলিম বিশ্বের মধ্যে বিরাজমান এই অনৈক্য, দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস সৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের মুসলিম বিরোধী গণমাধ্যমগুলোর বিশাল ভূমিকা রয়েছে। অন্যদিকে পাশ্চাত্য এই গণমাধ্যমগুলোর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার মুসলিম সমাজ আজ বিশ্বে তাদের ইতিহাস, কর্তব্য ও লক্ষ্য হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এই অনৈক্য, দ্বন্দ্ব, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে মুসলিম বিশ্বের মিডিয়াগুলোর যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন ছিল সেই ভূমিকা রাখতে তারা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয়, কিছু ধনী মুসলমান বরং পাশ্চাত্যের এই ইসলাম বিদ্বেষী গণমাধ্যমে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে উল্টো তাদের হাতকে শক্তিশালী করেছে। যেমন ইসলাম বিদ্বেষী মিডিয়া টাইকুন রুপার্ট মারডকের ব্যবসায় মধ্যপ্রাচ্যের এক আলোচিত মুসলিম ব্যবসায়ীর বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামের নামে প্রচারিত ও ইসলাম নামধারী মিডিয়াতে বিনিয়োগ করে অমুসলিম শক্তিগুলো মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। যেমন আল জাজিরা নেটওয়ার্ক। এটিও নিয়ন্ত্রণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ঙওঈ এখন ঙ ও ঝবব-র ভূমিকায় অবতীর্ণ!
মুসলিম বিশ্বের দ্বন্দ্ব অবিশ্বাস সৃষ্টির জন্য বর্তমান বিশ্বে যত মিডিয়া কাজ করছে, তা নিরসনে কাজ করছে না শতকরা দশভাগ মিডিয়াও। অথচ এই দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস নিরসনে, করণীয় নির্ধারণে মিডিয়ার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অন্য কথায় বললে বলা যায়, একমাত্র মিডিয়াই পারে আজকের বহুধা বিভক্ত মুসলিম সমাজকে একত্রিত করতে। মিডিয়াই পারে ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে ঐক্যের জন্য মুসলিমদেশগুলোর সরকার ও সংস্থাগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। সেজন্য যেমন লক্ষ্যানুসারী মিডিয়া হাউস সৃষ্টি প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন মুসলিম গণমাধ্যমকর্মীদের লক্ষ্যানুসারী ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস। দরকার কার্যকর মিডিয়া হাউস প্রতিষ্ঠা, দরকার সংগঠন। কিন্তু সেই দরকারি কাজটি কেউ করেনি এতদিন।
ঠিক এ সময়ই ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সরকারের পক্ষ থেকে এই জরুরি উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নানা টানাপড়েন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে নাজুক অবস্থায় পতিত ইরান যে কর্তব্য কাজ থেকে দূরে সরে যায়নি প্রেস ইউনিয়ন অব ইসলামিক ওয়ার্ল্ড গঠনের উদ্যোগটি তার অন্যতম প্রমাণ। ২০১১ সালের ২৯ অক্টোবর তেহরানের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত লালেহ ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের বলরুমে শুরু হয় প্রেস ইউনিয়ন অব ইসলামিক ওয়ার্ল্ডের। ৩৮টি দেশের ৬০ জন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের ইনফরমেশন এন্ড ইসলামিক কালচার এন্ড গাইডেন্স মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ড. হোসাইনীর সভাপতিত্বে এই সংগঠনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং একই দিন সন্ধ্যায় ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ তার কার্যালয়ে এই সংগঠনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। ইরান সরকার এই সংগঠনটিকে কতোটা গুরুত্ব দেয় তার প্রমাণ প্রেসিডেন্টের এই অংশগ্রহণ। উদ্বোধনী ভাষণে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমেদিনেজাদ বলেন, ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে যখন কোনো পাশ্চাত্য মিডিয়া নিউজ করে তখন তারা নিরপেক্ষতা হারিয়ে ফেলে, কারণ পাশ্চাত্যের মিডিয়াগুলো ইসলাম ফোবিয়াতে ভোগে। নাইন ইলেভেনের পর পাশ্চাত্য মিডিয়ার এই ইসলামিক ফোবিয়া ও বায়াস রিপোর্টিংয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সংগঠন এসকল বিষয় নিয়ে কাজ করবে আশা রাখি।
ইরানের প্রেস, ইসলামিক কালচার এন্ড গাইডেন্স মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মিনিস্টার মি. জাফর মোহাম্মদ জাদেহ’র আমন্ত্রণে ২০১১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রেস ইউনিয়ন অব ইসলামিক ওয়ার্ল্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সে বছর বাংলাদেশ থেকে আমি ও বিএসএস’র নিউজ এডিটর মমতাজ বিলকিস বানু এ সম্মেলনে যোগদান করি। প্রথম সম্মেলেন শেষে ২৯টি দেশের ৩৮ জন সাংবাদিককে প্রেস ইউনিয়ন অব ইসলামিক ওয়ার্ল্ডের ফাউন্ডিং মেম্বার করা হয়। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় এই প্রেস ইউনিয়ন অব ইসলামিক ওয়ার্ল্ডের একজন ফাউন্ডার মেম্বার হিসেবে বাংলাদেশ থেকে একমাত্র আমি মনোনীত হই।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবেই গত বছর অর্থাৎ ২০১২ সালে প্রেস ইউনিয়ন অব ইসলামিক ওয়ার্ল্ডের দ্বিতীয় সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে ২৭ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত তেহরানে অবস্থান করি। এ সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আরো অংশ নেন নয়াদিগন্তের ডেপুটি এডিটর আযম মীর শহিদুল হাসান, মাসিক মদীনার নির্বাহি সম্পাদক আহমদ বদরুদ্দীন খান ও ফ্রি ল্যান্স রাইটার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মার্স্টাসের ছাত্রী তামান্না তানভী বন্যা। তেহরানে পৌঁছার পর বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে আমাকে জানানো হয়, ওআইসি ইতোমধ্যেই এই সংগঠনের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং ইরান সরকারকে এর কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছে।
৩০ অক্টোবর ২০১২, তেহরানের ইনফরমেশন মিনিস্ট্রির সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত প্রেস ইউনিয়ন অব ইসলামিক ওয়ার্ল্ডের দ্বিতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ রেজা রাহিমী, বিশেষ অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হোসাইনী, ডেপুটি মিনিস্টার অব ইসলামী কালচার এন্ড গাইডেন্স ড. জাফর মোহাম্মদ জাদেহ, সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন দ্বিতীয় সম্মেলনের আহ্বায়ক মি. হাঘিগত। এরকম একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে যখন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা সামনে রেখে আসন গ্রহণ করলাম তখনকার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার নয়। শুধু মহান আল্লাহর দরবারে মনে মনে সেজদায় অবনত হয়েছি। যদিও অভিজ্ঞতাটি আমার ২০১১ সালেই হয়েছিল এই ইরানে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ রেজা রহিমী বলেন, আমাদের আল্লাহ এক, রসুল (সা.) এক এবং এক কিতাব আল কোরআন। শুধু প্রাকটিসের মধ্যে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। এই সামান্য পার্থক্য সত্ত্বেও আমাদের এক সাথে কাজ করতে কোনো বাধা নেই। ইরান মুসলিম বিশ্বের সলিডারিটির ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এই সংগঠনকে মুসলিম বিশ্বের সংহতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পাশ্চাত্য চায় না মুসলমানরা তাদের লক্ষ্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হোক। এ সংগঠন সে লক্ষ্যে কাজ করবে বলে আশা রাখি।
তেহরানে অবস্থানকালে আটটি দিন একই হোটেলে একই লবিতে, একই রেস্টুরেন্টে, একই যানবাহনে বিশ্বের ত্রিশ দেশের ৬০ জন সাংবাদিক একই চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছে। আটটি দিন লালেহ হোটেলটি ছিল যেন একখ- মুসলিম বিশ্ব। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিক মহাদেশের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা পাশাপাশি বসে নিজ দেশের ক্রাইসিস, কালচার শেয়ার করেছে। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও তা মোকাবেলার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছি। প্রায় শতেক সাংবাদিক অঙ্গিকারাবদ্ধ হয়েছে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে পাশ্চত্যের তথ্য সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য সরবরাহ দিয়ে লড়াই করার। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য, সংহতি ও আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করার শপথ নিয়েছে অন্তরে। মুসলিম সমাজকে তাদের ভুলে যাওয়া উদ্দেশ্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে তারা বলবে,
‘দেখো একবার ইতিহাস খুলি কত উচ্চে তোরা অধিষ্ঠিত ছিলি?’
[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন