বিপন্ন খিয়াং ভাষা, বর্ণমালা নিয়ে বিরোধে আরও বিপন্ন!

fec-image

২০১৪ সালে বাংলাদেশের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫টি ভাষা বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫টি বিপন্ন ভাষার মধ্যে খিয়াং ভাষা একটি।

বান্দরবান সদর উপজেলা কুহালং ইউনিয়নে গুংগুরু খিয়াং পাড়া; ছবি-উসিথোয়াই মারমা খিয়াং জনগোষ্ঠীর নামের আদি অর্থ হ্যাওচ। ‘হ্যাও’ থেকে ‘হ্যাওচ’ হয়েছে। ‘হ্যাও’ মানে খুব কাছের আর ‘চ’ মানে শিশু। শব্দগত অর্থে ‘হ্যাওচ’ মানে দাঁড়ায় খুব কাছের শিশু। কিন্তু ঠিক কী কারণে একটি জনগোষ্ঠীর নামের অর্থ খুব কাছের শিশু হলো, তার কোনো নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া না গেলেও এই নামকরণের পেছনে দুটি মতবাদ প্রচলিত রয়েছে বলে জানিয়েছেন খিয়াং ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবক ও সংস্কৃতিকর্মী ক্যসাম খিয়াং।

বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের গুংগুরু খিয়াংপাড়ার বাসিন্দা ক্যসামং খিয়াং তাদের খিয়াং জনগোষ্ঠীর প্রথম মৌলিক বর্ণমালার উদ্ভাবক। পেশায় কৃষিজীবী হলেও তিনি খিয়াং সমাজ ও সংস্কৃতি উন্নয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।

ক্যসামং খিয়াংয়ের ভাষ্য, ধারণা করা হয় একসময় প্রাচীন সমাজে লাংগ্যে নামে একটি জনগোষ্ঠীর নাম শোনা যায়। যারা কিনা বর্বরতা ও দস্যুতার জন্য কুখ্যাত ছিল। ঝরাপাতার বসন্তকাল আসলে তারা মানুষ হত্যার জন্য ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তেন। বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে গ্রামবাসীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালাতেন।

‘সেই সময় খিয়াংরা ছিল সংখ্যায় কম ও অসংগঠিত। নিরীহ প্রকৃতির হওয়ায় তারা সব সময় তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতেন। সেই সময়ে নির্যাতন ও হামলার শিকার কেউ একজন নিজেদের “হ্যাওচ” শিশুর মতো নিরীহ ভেবে স্বস্তি খুঁজছিলেন। বলা হয়, তখন থেকে এ শব্দটি মুখে মুখে পরিচিতি পেয়ে যায়। আরও পরে শব্দটি পুরো জাতি পরিচয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে যায়।’

খিয়াং জনগোষ্ঠীর নামকরণ নিয়ে দ্বিতীয় মত সম্পর্কে ক্যসামং খিয়াং বলেন, ‘সেই একই সময়ে মারমা জনগোষ্ঠীও খিয়াংদের নিকট প্রতিবেশী ছিল। সামাজিক সখ্য তেমন গড়ে না উঠলেও জুম চাষাবাদকে কেন্দ্র করে চাষাবাদের ভূমি দুই জনগোষ্ঠী ভাগাভাগি করে ফসল ফলাত। জুমখেতের জন্য জঙ্গল পোড়ানোর সময় নিজের অংশটাকে একটা সুতা দিয়ে চিহ্নিত করে রাখতেন খিয়াংরা।

মারমারা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আগুন দিলেও খিয়াং ব্যক্তির সীমানা অংশে এসে আগুন আপনাআপনি নিভে যেত। এসব কাণ্ডকারখানা দেখে মারমারা রীতিমতো ভয় পাওয়া শুরু করে। খিয়াংদের মধ্যে তখন তান্ত্রিক বিদ্যার বেশ চল ছিল। এ কারণে খিয়াংদের অনেকেই ভয়ে এড়িয়ে চলতেন। প্রতিবেশী মারমারা তাই খুব দায়ে না পড়লে খিয়াংদের আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন না।’

ভয় ও আস্থাহীনতার কারণেই মারমারা খিয়াংদের ‘ঝাল আদা’ হিসেবে আখ্যা দেন। এই আরোপিত নামও খিয়াংদের জাতির নামের পরিচিতি পেয়ে যায়, যোগ করেন ক্যসামং খিয়াং।

পার্বত্য চট্টগ্রামে দুটি জেলায় খিয়াং জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। বেশিসংখ্যক রয়েছে বান্দরবানে সদর উপজেলার গুংগুরু খিয়াংসহ কয়েকটি পাড়ায়। এছাড়া রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় ছড়িয়ে রয়েছে কিছুসংখ্যক খিয়াং। এদিকে রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী ও চন্দ্রঘোনা এলাকায় কয়েকটি পাড়ায় বেশ কিছু খিয়াং গোষ্ঠীর লোকজন বসবাস করে।

খিয়াং সামাজিক নেতারা বলেছেন, তাদের মধ্যে লাইতু ও কুনতু নামে দুই সম্প্রদায় খিয়াং রয়েছে। লাইতু খিয়াংদের বসবাস সমতলের অংশে। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীদের কুনতু খিয়াং বলা হয়। এ ক্ষেত্রে লাইতু খিয়াংরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, অপর দিকে খ্রিষ্টানধর্মাবলম্বীরা হলেন কুনতু খিয়াং। বিভিন্ন সময় নিজেদের করা জরিপে বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি দুই জেলা মিলে সর্বমোট পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো খিয়াং রয়েছে বলে মনে করেন তারা।

ওকেই প্রে পয়েইটি প্রে, নাং পয়েই খেউ নিহওস
ন্ হন; নিক দেখ নি, তুইলা
আওয়ালোজেং চুয়া হনোঙ, য়াপছে নুলুপ মে নিখোসেয়ং
উচুম খ্রিয়োঙ নাংচে খেই পা হু
অয়না খ্রওয়ালোঙোং নাংচে কনতুই
ও কে প্লে- ওই
নাং নেসেয়াই কেইনি খুয়োং, নাং নেমেয়াই হচ আয়োং
নাং নেমেয়াই নি অস্থোংচ তুয়োং
উচুম খ্রিয়োঙ নাংচে খেই পা হু
ময়না খ্রওয়া লোভো নাংচে কুনতুই।
ওকেই প্রে
……………………………….
বাংলা অনুবাদ

ও আমার দেশ সুন্দর দেশ।
তোমার অনুপম সৌন্দর্যে আকাশ, মাটি, পানি ও জলে
ওই দূর নভোনীলে আলোর মাধুরিত
তোমার সাত রঙা ছবি মেঘে এঁকে দিলে
দক্ষিণা বাতাসে তুমি ফুলের সুবাস
চাঁদটি রাতে তুমি পুকুরে জল।
ও আমার দেশ সুন্দর দেশ।
তুমি থাকবে গল্প কাহিনিতে আর পাখিদের গানে গানে
তুমি থাকবে ছোট নদী পানির স্রোতধারা হয়ে
ও আমার দেশ সুন্দর দেশ।

এটি বাংলা বর্ণমালা দিয়ে একটি খিয়াং ভাষার দেশাত্মবোধক গান। গানটি লিখেছেন খিয়াং জনগোষ্ঠীর বর্ণমালার উদ্ভাবক ক্যসামং খিয়াং। কিন্তু নিজস্ব খিয়াং বর্ণমালা দিয়ে এখনো কোনো কিছু রচনা করা হয়নি। কোনো গান ও কবিতা লিখতে হলে বাংলা ভাষার আশ্রয় নিতে হয় তাদের। পনেরো বছর আগে থেকে প্রথম খিয়াং বর্ণমালা তৈরি করা হলেও এখনো তাদের ভাষার বর্ণমালা চর্চা করা যায়নি।

দুটি পক্ষ আলাদাভাবে বর্ণমালা তৈরি করায় কার তৈরি বর্ণমালা গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে এখনো একমত হতে পারেননি খিয়াং ভাষার জনগোষ্ঠী, যার কারণে আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে ১০টি আদিবাসী ভাষার বর্ণমালা থাকলেও আনুষ্ঠানিকভাবে খিয়াং বর্ণমালাকে অর্ন্তভুক্ত করা যায়নি। খিয়াং জনগোষ্ঠীর সব এলাকায় নিজেদের উদ্যোগেও পরিচালিত কোনো একটি বর্ণমালাকে সর্বজনীন করা যায়নি।

ফলে খিয়াং ভাষার চর্চা শুধু মৌখিকভাবে রয়ে গেছে। গান ও কবিতা লেখা হলেও তা মূলত বাংলা ভাষাকে আশ্রয় করে। ফলে নিজেদের প্রতিদিনকার জীবনে ভাষার সংকট দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করছেন এই ভাষা গোষ্ঠীর লোকজন। তবে খিয়াং বর্ণমালা তৈরির কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, যত দ্রুত সম্ভব তারা একমত হয়ে বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ ও নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে সর্বগ্রহণযোগ্য একটি বর্ণমালা বেছে নিতে চায় সব পক্ষের লোকজন।

এদিকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫টি ভাষা বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫টি বিপন্ন ভাষার মধ্যে খিয়াং ভাষা একটি।

বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের গুংগুরু খিয়াংপাড়ার বাসিন্দা ক্যসামং খিয়াং তাদের খিয়াং জনগোষ্ঠীর প্রথম মৌলিক বর্ণমালার উদ্ভাবক। ১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার চলখাগড়িয়া উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সে সময় মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি তিনি।

পরে কৃষিকাজে জড়িত হলেও মনোযোগ দেন খিয়াং জাতির সমাজ-সংস্কতির উন্নয়নকাজে। বাংলা ভাষা দিয়ে খিয়াংদের গান ও কবিতাও লেখা শুরু করেন তিনি। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস, আরাকান রাজ্যের রাজওয়ং নামে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক বই এবং ভাষাসম্পর্কিত লেখা বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে পরবর্তীতে মনোযোগ দেন খিয়াং বর্ণমালা তৈরির কাজে।

প্রথম খিয়াং বর্ণমালার উদ্ভাবক ক্যসামং খিয়াং বলেছেন, খিয়াং বর্ণমালা নিয়ে তিনি ১৯৯৯ সাল থেকে কাজ শুরু করেন। পাঁচ বছর পর ২০০৪ সালে খিয়াং বর্ণমালা পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া সম্ভব হয়। ইউএনডিপির মাধ্যমে ২০০৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাষা নিয়ে কাজ করতে আসা ইংল্যান্ডের নাগরিক জন ক্রিপ্ট নামে একজন ভাষা ও বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ তার তৈরি বর্ণমালা তৈরির কাজ তত্ত্বাবধান করেছিলেন। এটা নিয়ে গবেষণাও করেন।

‘প্রতিটি অক্ষরের মুখের উচ্চারণ ও ধ্বনি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। আমার মুখের উচ্চারণ ধারণ করে আরও গবেষণার জন্য তিনি ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। পরে এটা খিয়াংদের মৌলিক বর্ণমালা বলে জানান। এটা চর্চা শুরু করলে খিয়াং ভাষা সহজে হারিয়ে যাবে না বলেও মতামত দেন তিনি।’

ক্যসামং খিয়াং বলেন, এই ভাষা ও বর্ণমালা বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এমন মতামত পাওয়ার পর নিজের উদ্যোগে বর্ণমালা শেখানোর ব্যবস্থা করি। ঘরের উঠানে শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে খিয়াং বর্ণমালা পরিচিতি করানো হয়। সপ্তাহে কখনো তিন দিন, কখনো দুদিন করে বর্ণমালা পরিচিতি করানোর পাঠ চলে।

‘বয়স্ক ব্যক্তিরা বর্ণমালা শেখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও তাদের বিভিন্ন কাজের ব্যস্ততার কারণে শিখতে পারেননি। পরে শিশুদের নিয়ে কিছুদিন চললেও নিজের সাংসারিক কাজকর্ম ও ব্যস্ততার জন্য সে ধারাবাহিকতাও রক্ষা করা যায়নি। এ বর্ণমালা আয়ত্ত করা গেলে মৌলিক খিয়াং ভাষায় কথা বলা যেত। এত দিন মারমা, বম, বাংলা ও ইংরেজি যেসব শব্দ খিয়াং ভাষায় ঢুকে গেছে, সেগুলো আলাদা করা যেত।’

খিয়াং বর্ণমালার উদ্ভাবক ক্যসামং খিয়াং জানান, খিয়াংরা নৃতাত্ত্বিকভাবে তিব্বতি-বার্মা মঙ্গোলয়েড এবং তিব্বতি-চীন ভাষার পরিবারে উত্তর চিন উপশাখার ভাষা পরিবারের অর্ন্তভুক্ত। খিয়াং ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব এবং রূপতত্ত্ব বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটি সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বাধীন একটি ভাষা। কিন্তু আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের নানা কারণে এই ভাষার ওপর বিভিন্ন ভাষার প্রভাব ও আধিপত্য স্থাপিত হয়েছে।

এদিকে বান্দরবান সদর উপজেলার গুংগুরু খিয়াংপাড়ার বাসিন্দা পাঁচজনের নেতৃত্বে আরেকটি খিয়াং বর্ণমালা তৈরি করা হয় ২০১৭ সালে। বর্ণমালা তৈরি এই দলের রয়েছেন তিনজন স্কুল শিক্ষক, একজন উন্নয়নকর্মী ও অপরজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের তৈরি বর্ণমালার মধ্যে রয়েছে ২৩ ব্যঞ্জনবর্ণ ও ১১টি স্বরবর্ণ।

আগের তৈরি বর্ণমালা সামান্য পরিবর্তন করে আরেক দফা বর্ণমালা তৈরি করা দলের একজন ঞোজাইউ খেয়াং। পেশায় শিক্ষক ঞোজাইউ খিয়াং বর্তমানে বান্দরবান জেলার খিয়াং ভাষা ও বর্ণমালা কমিটির সভাপতিও।

ঞোজাইউ খেয়াং বলেন, আমরা পাঁচজনের দল মাসের পর মাস রাতদিন পরিশ্রম করে করে বর্ণমালা তৈরি করেছি। এ বর্ণমালা সহজে বোঝা সম্ভব এবং খেয়াং ভাষায় সহেজ মনের ভাব প্রকাশ করা যায়। বই ছাপিয়ে পাড়ার বেশ কয়েকজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে খিয়াং শিশুদের পড়ানো হচ্ছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও আমাদের তৈরি বর্ণমালা পড়ানো হয়েছে।

পরে অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে বন্ধ হয়ে গেছে এ উদ্যোগ। তবে ভবিষ্যতে এসব বর্ণমালার বই নতুন করে ছাপিয়ে বান্দরবানের প্রত্যেক খিয়াং জনগোষ্ঠীর এলাকায় নিজেদের উদ্যোগে পাঠদানের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান ঞোজাইউ খিয়াং।

বান্দরবান সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নে গুংগুরু খিয়াং জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী ঘর
রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ও চন্দ্রঘোনা এলাকার অংশ নিয়ে গঠিত খিয়াং ভাষা কমিটির সভাপতি থোয়াইসাপ্রু খিয়াং বলেছেন, ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনে ১৯৮৪ সালের দিকে রোয়াংছড়ি খামতাংপাড়ার এ ব্যক্তি বম ও লুসাইদের আদলে রোমান হরফে একটি বর্ণমালা তৈরি করেন। তারা নিজেদের প্রয়োজনে এ বর্ণমালা ব্যবহার শুরু করে। পরে আমাদের সামাজিক সংগঠন খিয়াং সোশ্যাল কাউন্সিলে এ বর্ণমালার বই তুলে ধরে খামতাংপাড়ার পাস্তর সুইহ্লা খিয়াং।

‘যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, কিছু বর্ণমালা ভুল রয়েছে। তখন সংশোধনের কথা ওঠে। কিন্তু বহু বছর ধরে কোনো সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু একটা বর্ণমালাকে এভাবে ফেলা রাখা যায় না। যে কয়টা বর্ণমালা খিয়াং উচ্চারণে আসে না, সেগুলো সংশোধন করে নিজেদের সুবিধামতো সাজানো হয়েছে।’

পরে আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে চন্দ্রঘোনার কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠকে নিয়ে খামতাংপাড়া এবং ক্যক্চুপাড়ার গ্রামপ্রধান ও পাড়াবাসীদের নিয়ে আলোচনায় বসি। তখন তারা কিছু বর্ণমাল সংশোধনে সম্মত হন।

‘ঠিক এক বছর পর ইউএনডিপির পক্ষ থেকে স্থানীয় একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার মাধ্যমে খিয়াং ভাষার বর্ণমালা নিয়ে কাজ করা হয়। তখন খিয়াং জনগোষ্ঠীর সব লোকজন নিয়ে একটা সভা করা হয়। তখন রোমান হরফের বর্ণমালা দিয়ে বই পর্যন্ত ছাপা হয়েছে।’

তখন এ প্রকল্পের অধীন রাজস্থলী উপজেলার কয়েকটি বিদ্যালয়ে রোমান হরফের বর্ণমালা পড়ানো হতো। প্রকল্পভিত্তিক হওয়ায় দুই বছর চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে রোমান হরফ দিয়ে খ্রিষ্টানধর্মাবলম্বীদের খিয়াংদের ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেল পর্যন্ত অনুবাদের কাজ চলছে। কিন্তু বর্ণমালার সংশোধনকাজ অসম্পূর্ণ রেখেই।

এখন অবস্থা এ রকম: বর্ণমালা বই ছাপিয়ে ও ধর্মীয় গ্রন্থ অনুবাদের কাজ এত দূর অগ্রসর হওয়ার পর আর পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এক জাতির দুই প্রকার বর্ণমালা নিয়েই যার যারটা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। নতুন প্রজন্ম যেটা ভালো লাগবে ভবিষ্যতে সেটা গ্রহণ করবে, বলেন থোয়াইসাপ্রু খিয়াং।

বান্দরবান ক্ষুদ্র সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং মারমা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বান্দরবানে বসবাসরত ১১টি আদিবাসী ভাষার মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির কারণে খিয়াং বর্ণমালা এখনো অর্ন্তভুক্ত হয়নি। মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরাদের আগে থেকে বর্ণমালা থাকায় বর্ণমালা ও ভাষা শিক্ষা প্রচলন রয়েছে। অপরাপর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীদের সীমিত আকারে হলেও শিশুরা নিজের মাতৃভাষার বর্ণমালা শিখতে পারছে।

কিন্তু খিয়াং জনগোষ্ঠীর মূলত বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলাকেন্দ্রিক দুই বর্ণমালা নিয়ে দ্বন্দ্বে পড়ায় কোনো একটি পক্ষের বর্ণমালা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। একটি জাতির দুই বর্ণমালা থাকতে পারে না। গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনীন বর্ণমালা নিয়ে আসলে বর্ণমালা শিক্ষার কার্যক্রম শুরু করা যাবে।

সূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন