মডেল ম্যাকস বনাম বাংলাদেশের নারী এবং পোশাক শিল্পের অবমাননা

elle-made-in-bangladesh

আশরাফুজ্জামান মিনহাজ

আপাতত আমেরিকান অ্যাপারেলে নগ্নবক্ষা হয়ে ছবির পোজ দিয়ে বিষয়টিকে বেশ কৃতিত্ব হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশি মডেল ম্যাকস। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভাইস’ নামের একটি ম্যাগাজিনে তিনি শরীরের উপরের অংশ একেবারে অনাবৃত করে পোজ দিয়েছেন। তার অনাবৃত বক্ষদেশে ইংরেজিতে লেখা ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা, আলোচনার জন্ম দেয়।

তবে এসব সমালোচনায় থোরাই কেয়ার করছেন ম্যাকস। ডেইলি মেইল অন লাইনে তিনি বলেছেন, “ওই ফটোশুট করে আমি পরিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। এর মাধ্যমে আমি নিজেকে মুক্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা যে যেখান থেকেই আসি না কেন আমাদের মত প্রকাশে স্বাধীনতা থাকা উচিত। সব নারীর এক্ষেত্রে মনোবল থাকা উচিত”।

তার এ বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশের নারীরা কখনোই একমত হতে পারবেন না। বরং বিষয়টি যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়বস্তু এবং পশ্চিমাদের সেই ফাঁদে পা দিয়ে ম্যাকস কি সর্বনাশ করেছেন সে উপলব্ধি আসতে তার ঢের সময় লাগবে। পশ্চিমা সংস্কৃতি বাংলাদেশে অপসংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত। এধরনের সংস্কৃতি নিয়ে তারাও কম বিপাকে পড়ছে না। দুটি উদাহরণ এক্ষেত্রে যথেষ্ট। এ ধরনের অজস্র উদাহরণ পশ্চিমা মিডিয়ায় হরহামেশা আসছে।

ডেইলি মেইল এক প্রতিবেদনে দিন কয়েক আগে ব্রিটিশ নারীদের নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছে, জাতি কি সখের নগ্ন তারকা হতে চলছে? এধরনের প্রশ্ন তুলে ডেইলি মেইল বলছে এক জরিপে দেখা গেছে ৫ জন ব্রিটিশ নারী যাদের বয়স চল্লিশের কম, তাদের অন্তত একজন ক্যামেরার সামনে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করছে এবং ৩০ ভাগ তাদের নগ্ন ছবি তুলছে। তবে চল্লিশের উপরে যাদের বয়স তাদের অন্তত ৬ ভাগ ব্রিটিশ নারী ক্যামেরার সামনে যৌন সম্পর্ক করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। তার মানে ব্রিটিশ নারীরা এখন সময় পেলে তারা ক্যামেরার সামনে নগ্ন হতে বা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে পছন্দ করছেন। ইউগভ এ জরিপ পরিচালনা করে।

images-ববব

মঙ্গলবার ডেইলি মেইলের আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান থেকে ফেরত এসে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এক ক্যাথলিক চিকিৎসক দেখতে পান তার সুন্দরী মেয়েটি যে কি না বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্রী সে পর্ণ ছবিতে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনের বাসিন্দা ডা. কেভিন ও তার ভারতীয় স্ত্রী জানতেন না তাদের কন্যা মিরিয়াম প্রিন্সেস বেলি নক্স হিসেবে পর্ণ অভিনেত্রী হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেছেন। তবে মিরিয়াম বলছে, বছরে তাকে টিউশনি ফি হিসেবে যে ৬০ হাজার ডলার দিতে হত তা যোগানোর জন্যে সে পর্ণ ছবিতে অভিনয় করেছে।

এই হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর সামাজিক বাস্তবতা। কিন্তু ওসব দেশে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের মেয়েরা পরিশ্রম ও মেধার বিকাশ ঘটিয়ে রীতিমত নিজের আসনটি অর্জনে লড়াই করে যাচ্ছেন। আর ম্যাকস গায়ের কাপড় খুলে যে ক্যামেরার সামনে উদোম হয়েছেন তাতে কোনো মেধার পরিচয় দিতে হয়নি। যদিও ম্যাকস বলেছেন, “ক্যামেরার সামনে উদোম হয়ে ফটোশুট করে আমি পরিপূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। এর মাধ্যমে আমি নিজেকে মুক্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা যে যেখান থেকেই আসি না কেন আমাদের মত প্রকাশে স্বাধীনতা থাকা উচিত। সব নারীর এক্ষেত্রে মনোবল থাকা উচিত।”

দুঃখিত ম্যাকস, আপনার মত মনোবল কিংবা মত প্রকাশে স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশের মেয়েরা ক্যামেরার সামনে উদোম হতে চায় না। ব্যক্তিগতভাবে আপনি তা করেছেন, একান্তই তা ব্যক্তিগত। কিন্তু যখন আপনি মনোবল ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলেন তখন বাংলাদেশের মেয়েরা আপনার সঙ্গে একমত হতে পারেন না। কারণ তাদের মর্যাদার মাপকাঠি ক্যামেরার সামনে উদোম হওয়ার মধ্যে নিহিত নয়। একজন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পুলিশ বা যে কোনো পেশাগত কাজে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে তারা দেশে কিংবা বিদেশে মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করেন। আপনার মত ক্যামেরার সামনে উদোম হয়ে নয়।

ম্যাকস জন্মসূত্রে বাংলাদেশের একটি মুসলিম পরিবারের হলেও তার এধরনের নগ্ন আচরণ কখনোই মানবিক নয়। ধর্মে এধরনের নগ্নতাকে কখনোই প্রশ্রয় দেয়া হয় না। মুসলিম শব্দটি ম্যাকস তার পরিবারের পরিচিতিতে ব্যবহার করায় তাকে নিয়ে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। আদতে এটাই হয়ত চেয়েছিলেন ম্যাকস। স্রেফ তাকে নিয়ে হৈ চৈ পড়ুক। যা পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে অর্জন করতে হয় না। ম্যাকসের বর্তমান বয়স ২২ বছর। তিনি বাংলাদেশে জন্ম নিলেও চার বছর বয়সের সময় চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। বড় হয়ে সে লস অ্যানজেলেসে চাকরি খুঁজতে গিয়ে কাজ পেয়ে যান আমেরিকান অ্যাপারেলসে।

এ প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে এখন ডেইল মেইল তাদের অনলাইনে জরিপ শুরু করেছে, পাঠকদের কাছে প্রশ্ন করছে আমেরিকান অ্যাপারেলস বিজ্ঞাপনের নামে যা করছে তা গ্রহণযোগ্য কি না। অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপনে শো’কেসে ডামি মডেলের শরীরে গোপন কেশ সংযুক্ত করে দেয়া আর যাই হোক সুরুচি নয়, বিকৃতির পরিচায়ক। আমেরিকান অ্যাপারেলস তা করায় অনেকে মর্মাহত হয়েছেন। আমেরিকার বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এএসএ বেশ কয়েকবার প্রতিষ্ঠানটির কুরুচিপূর্ণ ও আপত্তিকর বিজ্ঞাপন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। ম্যাকসকে নিয়ে যে নগ্ন বিজ্ঞাপন করেছে প্রতিষ্ঠানটি সে সম্পর্কে ডেইলি মেইলের জরিপে আরো বিশদ তথ্য উঠে আসবে।

ম্যাকস আমেরিকান অ্যাপারেলসে কাজ করেন এবং তিনি লন্ডনের ডেইলি মেইলকে বলেছেন, “এই ছবির মাধ্যমে যে বার্তা দেয়া হয়েছে আমি পরিপূর্ণভাবে তা সমর্থন করি। আমি সব ধর্ম ও সংস্কৃতিকে পছন্দ করি ও ভালবাসি। আমি সৃষ্টিশীল হতে চাই।” সে জন্য নিজেকে মুক্তভাবে প্রকাশ করতে চাই। আমেরিকান অ্যাপারেল শ্রমিকদের ১২ থেকে ১৪ ডলার বেতন দিয়ে থাকে। তাদের দাবি, এটাই বিশ্বে শ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি মজুরি। ফলে এই মজুরির সঙ্গে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মজুরির যে ফারাক রয়েছে তা দেখে মাকস মনে করেন, ভবিষ্যতে তৈরী পোশাক প্রস্তুতিতে আমেরিকান অ্যাপারেল তাদের প্রভাব প্রয়োগ করতে পারবে এবং এ বিষয়ক যে সংস্কৃতি আছে তা পরিবর্তন করতে পারবে।

কিন্তু সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হলে যদি উদোম হয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে হয় তাহলে এধরনের কুরুচিপূর্ণ আচরণ বাংলাদেশের কোনো নারী শ্রমিক আশা করেন না। এই বিজ্ঞাপনে নারীর অবমাননা করা হয়েছে৷ শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকেও অবমাননা করা হয়েছে৷ ব্যবসা করার জন্য এভাবে নারীর অবমাননা মেনে নেয়া যায়না৷ বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের ৮০ ভাগই নারী৷ এটা তাদেরও অবমাননা৷ এই নারীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পোশাক তৈরি করেন৷ নিজেদের পরিবার এবং বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন৷ তাঁরা সংগ্রামী নারী৷ তারা কোনো পণ্য নয়৷ নারীদের যারা পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে। তাদের সবার ধিক্কার জানানো উচিত৷

অথচ ম্যাকস বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে তৈরি পোশাক কোম্পানির মতো নয়, আমেরিকান অ্যাপারেল-এর রয়েছে অত্যন্ত ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। আমরা শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করি। আমরা তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সুবিধা দিই। মাকস আমেরিকান অ্যাপারেল-এর পক্ষে এসব কথা বললেও টপলেস হয়ে মডেল হওয়ায় তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে টুইটারে লিংরান কোং নামে একজন লিখেছেন, আমেরিকান অ্যাপারেল অর্থ বানানোর জন্য বাংলাদেশে সম্প্রতি গার্মেন্টে যে ভয়াবহতা ঘটে গেছে তাকে ব্যবহার করছে। জেজেবেল নামে একজন লিখেছেন, আমেরিকান অ্যাপারেলের ওই বিজ্ঞাপনটি একটি ধান্দাবাজি। তারা মাকস-এর নগ্নতা দেখিয়ে ন্যায্য শ্রমিক অধিকারের কথা বলছে। আমাদের সামনে যেসব নারী আছেন তাদের জন্য ওই বিজ্ঞাপনটি মোটেও কোন কাজে আসবে না। আমেরিকান অ্যাপারেল এমনটিই করে থাকে। মেড ইন বাংলাদেশ বলে এভাবেই আমাদের সঙ্গে ফ্যান্টাসি করা হয়েছে। যেসব হতদরিদ্র, কম বেতনভোগী ও অতিরিক্ত সময় কাজ করা নারী শ্রমিক ঘণ্টায় মাত্র ৩০ সেন্ট মজুরিতে করেন, মাত্র ৫ ডলারে একটি শার্ট তৈরি করেন, তাদের এতে কোন উপকার হবে না।

শুধু বাংলাদেশের নারী নয়, বিভিন্ন দেশের নারীরা চান সমাজে ক্রমশ একটা অনুকরণীয় ভূমিকা রাখতে। সেক্ষেত্রে ম্যাকসের মত নগ্নবক্ষা হয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দেয়ার বিষয়টি তাদের কোনো কাজে আসবে না। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি ঘরে ও বাইরে এমনকি সামাজিক পরিবর্তনে কাজ করছেন সে জন্যে তাদের নিরাপত্তা আরো বেশি দরকার। এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, যে কোনো ধরনের বৈষম্য প্রতিরোধ ও নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করতে ম্যাকসের এ উদাহরণ কোনো কাজেই আসবে না। বরং ম্যাকস যে পথ অনুসরণ করেছেন, তা তাকে পণ্যে পরিণত করেছে। তিনি তার সত্বা ও স্বকীয়তা ও সামাজিক মর্যাদা বিসর্জন দিয়েছেন। সৌদি আরবের মত রক্ষণশীল দেশেও নারীদের জন্যে পৃথক শিল্প শহর গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে থাকবে স্বাস্থ্য কেন্দ্র, স্পোর্টস সেন্টার, শপিং সেন্টার, হোটেল ও গ্যাস ষ্টেশন ইত্যাদি। ম্যাকস যদি তার প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের জন্যে এধরনের সুবিধা আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারতেন তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হত। ম্যাকস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এজন্যে ক্যাম্পেন করতে পারতেন। যা সামাজিকভাবে নারীকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে কাজে লাগত।

ম্যাকস আসলে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের নিয়ে তেমন একটা ভাবেন নি। অনেক নারী শ্রমিক যে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন এবং তারা জানেন না তাঁদের ভবিষ্যত কি? কারণ তাঁদের এখানে শ্রম আইন এবং মজুরি বোর্ড পুরোপুরি কার্যকর নেই৷ তাঁদের অগ্নিনিরাপত্তাও পর্যাপ্ত নয়৷ এমনকি ভবনটিও পুরনো৷ এসব সমস্যা উদোম হয়ে ক্যামেরার সামনে পোজ দিয়ে দূর করা যাবে না।

এজন্যেই কথা সাহিত্যিক এবং নারী নেত্রী সেলিনা হোসেন বলেছেন, ‘‘টপলেস মডেলের শরীরে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লিখে বাংলাদেশেরও অবমাননা করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং জীবনবোধের সঙ্গে এর কোন মিল নেই৷ বাংলাদেশকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘অ্যামেরিকান অ্যাপারেল তাদের ব্যবসার স্বার্থে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী এবং বাংলাদেশকে হেয় করেছে৷ এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না৷ শুধু তাই নয় তারা নারীর অবমাননা করেছে৷ বিশ্ব নারী দিবসের সময়ে এই ধরনের বিজ্ঞাপন প্রমাণ করে তারা নারীদের পণ্যই মনে করে৷”

অ্যামেরিকান অ্যাপারেলের পোশাক যুক্তরাষ্ট্রেই তৈরি হয়৷ অথচ নগ্নবক্ষা মডেলের বুকে লেখা হয়েছে ‘মেড ইন বাংলাদেশ৷’ এই বিকৃত বিজ্ঞাপন প্রত্যাহারে আহ্বান জানিয়েছেন সেলিনা হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অ্যামেরিকান অ্যাপারেল তার মত করে বাংলাদেশকে চিত্রিত করতে পারে না৷ এটা তাদের সংস্কৃতি হতে পারে৷ বাংলাদেশের নয়, নয় বাংলাদেশের নারীর৷

ম্যাকসকে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকদের জীবনযাত্রা বুঝতে হবে। এখানে অনেক নারী শ্রমিকের সংসার চালানো বেশ কষ্টকর। তারা যে বেতন পান তারচেয়ে বেশি কিছু করার সুযোগ নেই৷ কারণ তারা অনেক সময় সর্বনিম্ন বেতনও পান না। থাকতে হয় আরো বেশ কয়েকজন নারী শ্রমিকের সঙ্গে একটি রুম ভাড়া নিয়ে। এই পোশাক কর্মীদের গার্মেন্টস-এ প্রবেশ এবং বের হওয়ার আগে গেটে তল্লাশী চালানো হয়৷ আর ‘ফ্রেশ’ হতে গেলেও বলে যেতে হয়৷ আর ফিরতে যদি একটু দেরি হয়, তাহলে মেলে গালমন্দ৷ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন এঁরা৷ মেশিনপত্রও পুরনো৷ কাজ করতে গিয়ে পুরনো মেশিনপত্রের কোনো ক্ষতি হলে কখনো কখনো জরিমানাও করা হয় তাঁদের৷তারপরও তাদের চোখে রঙ্গীন স্বপ্ন। হয়ত তার আয়ের কিছু বাঁচানো পয়সা দিয়ে বাবার ওষুধ কিনতে হয় কিংবা ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ মেটে। নিজেও অপুষ্টিতে ভুগেও পরিবারের নিরন্ন সদস্যটির মুখে অন্ন তুলে দেয় সে। জীবনের এসব কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি না করে ম্যাকস আমেরিকান অ্যাপারেলসের ফাঁদে পা দিয়ে উদোম হয়েছেন।

ম্যাকসের জানা উচিত, বাংলাদেশের নারীদের বার্ষিক মজুরিবিহীন গৃহকাজের অর্থনৈতিক মূল্য এক লাখ ১১ হাজার ৫৯১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা৷ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে৷ প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় বলা হয়েছে, গৃহকাজের অর্থনৈতিক মূল্য মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশের সমতুল্য৷ ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির আকার ছিল ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকার৷

উন্নয়ন অন্বেষণ দুই পদ্ধতিতে নারীদের মজুরিবিহীন গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্যমান হিসাব করেছে৷ ‘সুযোগ খরচ’ পদ্ধতি এবং ‘বাজার প্রতিস্থাপন খরচ’ পদ্ধতি৷

সুযোগ খরচ পদ্ধতিতে শ্রমবাজারে অন্য বিকল্প থেকে যে আয় পাওয়া যায়, তার অঙ্ক হিসাব করা হয়৷ আর বাজার প্রতিস্থাপন খরচ পদ্ধতিতে গৃহকর্ম করতে বিকল্প কাউকে নিয়োগ দেওয়া হলে কত টাকা ব্যয় হতো, তা হিসাব করা হয়৷ দেশের সাতটি বিভাগ থেকে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে সাতটি জেলা নির্ধারণ করে ৫২০ জন নারীর ওপর এই জরিপ পরিচালনা করা হয়৷ দৈবচয়ন পদ্ধতিতে বেছে নেওয়া এ নারীদের মধ্যে শহরের ৩১৮ জন এবং গ্রামের ২০২ জন৷

গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির মতে, বাংলাদেশে সাধারণভাবে মজুরি এত কম না হলে এবং নারী ও পুরুষের মজুরি বৈষম্য না থাকলে ওই দুই পদ্ধতিতে মজুরিবিহীন গৃহস্থালি কর্মের মূল্যমান আরও বেশি হতো৷

উন্নয়ন অন্বেষণের গবেষণা অনুযায়ী, যেসব নারী চাকরি, ব্যবসা, হস্তশিল্প তৈরি, দিনমজুরি এবং অন্যের বাসায় কাজে নিয়োজিত, তারাও নিজেদের গৃহকর্মের জন্য দৈনিক যথাক্রমে গড়ে ৩ দশমিক ৭১, ৩ দশমিক ৬৯, ৫ দশমিক ২, ৪ দশমিক ৮ এবং ৪ দশমিক ৩ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে থাকেন৷ এ ক্ষেত্রে কাঠামোগত ব্যর্থতা ও প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অনেকাংশে দায়ী৷

নারীর গৃহকাজের আর্থিক হিসাব তার ক্ষমতায়ন এবং সমতার জন্য জরুরি৷ কারণ বাংলাদেশে আয় সক্ষমতার ওপর ক্ষমতায়ন নির্ভর করে৷ নারীরা ঘরের কাজ করে বলে তার কোন আর্থিক মূল্য বিবেচনা করা হয় না৷ আর পুরুষরা বাইরে কাজ করে নগদ অর্থ আয় করায় তা বিবেচনায় নেয়া হয়৷ এই প্রবণতা দূর করা উচিত৷”

ঘরের কাজ বাইরের কাউকে দিয়ে করালে তাতে অর্থ খরচ হয়৷ সেটা বিবেচনা করলেই গৃহকাজের আর্থিক বিষয়টি স্পষ্ট হয়৷তবে এখনই নারীদের গৃহকাজের আর্থিক হিসাবকে জিডিপিতে যোগ করা হয়তো যাবে না৷ তবে ধারাবাহিকভাবে এর হিসাব প্রকাশ হলে ধীরে ধীরে জিডিপিতেও যোগ করা যেতে পারে৷ তবে তা কিভাবে করা যাবে তা গবেষণার বিষয়৷

উন্নয়ন অন্বেষণ শ্রমবাজারে নারীদের আরও বেশি হারে অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে বলছে, জীবনধারণের বাধ্যবাধকতা, ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাহিদা এবং পারিবারিক সহায়তা হ্রাস নারীদেরকে বিভিন্ন আয়বর্ধক কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য করছে৷ ম্যাকসকে ভেবে দেখতে হবে বাংলাদেশের নারীদের একটা মর্যাদাপূর্ণ সংগ্রাম রয়েছে যা তিনি তার আচরণের দ্বারা খাটো করেছেন। উদাহরণ হিসেবে ওয়াসফিয়া নাজরীনের কথা বলা যায়। পশ্চিমা দেশে লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষিত হবার পর এভারেস্ট জয়ী দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী ওয়াসফিয়া নাজরীন এ বছর মার্চে ইউরোপের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট এলব্রুস জয় করেন৷ সেখানে গিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন তিনি৷ ২০১১ সালে স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ ৭টি শৃঙ্গ জয় করার ঘোষণা দেন ওয়াসফিয়া৷ এরই মধ্যে পাঁচটি শৃঙ্গ জয় করেছেন তিনি৷ এজন্যে তাকে জমি বিক্রি করতে হয়েছে। হাতের আঙ্গুলগুলো ফ্রস্ট বাইটে ক্ষয়ে গেছে। ওয়াসফিয়ার এ কঠিন মনোবল ও ত্যাগ এবং কঠিন পরিশ্রম যুগযুগ ধরে বাংলাদেশের নারীকে প্রেরণা যোগাবে, ম্যাকসের উদোম শরীর নয়।

আশরাফুজ্জামান মিনহাজ- গবেষক ও পিএইচডি, ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, কানাডা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

2 Replies to “মডেল ম্যাকস বনাম বাংলাদেশের নারী এবং পোশাক শিল্পের অবমাননা”

  1. Bangladeshi chhele der khola book er chhobi FB tey hameshai dekha jai. Ekhaney ekti prapto boyosko Bangladeshi meye rozgarer proyojobey khola book a chhobi tuiiyechhey. Ota tar personal bepar. Ta niye eto hoichoi keno? Bangladeshi kichhu meye FB tey er chaitey o r o onek kichhu dekhai, ta niye to somalochona hoi na?
    Ei sob faltu kajey eto ta time r space nosto na korey– Bangladesher Garments Industry tey kaaj kora ma-bon ra ki korey r o bhalo poribeshey, r o beshi mojuri petey paren ; seta niye Minhaz saheb jodi gobeshona korten tobey kaajer kaaj hoto. Eta asoley dharma r culturer sentiment uskey diye ek dhoroner sex chorcha. Ei sob faltu jinis amader ignor kora dorkar.

  2. ami hotobak. নারী যেখানে নিজেকে পণ্য করে আর মনে করে এটাই আধুনিকতা। তাহলে বলব ভুল। হে নারীএখনও সময় আছে এভাবে তুমি তোমাকে পন্য কর না. নিজেকে প্রথমে মানুশ ভাবতে শিখ…। আমি আরেক্তা কথা বলতে চাই…পরিবার এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখান থেকে আমরা সব কিছু শিখি। তাই পরিবারের দায়িত্ব মেয়েদের কে এমন শিক্ষা দেয়া উচিত যে সে যেন তার সীমার বাইরে না যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন