মাতৃভাষা যখন মৌলিক অধিকার

fec-image

মানুষের ভাষা ধারণাটি বুঝাতে সচরাচর দুটি পরিভাষা ব্যবহৃত হয়। একটি হচ্ছে ‘ভাষা’ এবং অন্যটি ‘মাতৃভাষা’। তবে এ দুটি পরিভাষার মধ্যে কিছু গুণগত পার্থক্য রয়েছে। প্রথম অভিধা ‘ভাষা’ বলতে আক্ষরিক অর্থে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত একটি সংজ্ঞাপন-মাধ্যমকে নির্দেশ করা হয়, যার মৌখিক রূপ রয়েছে। এই মৌখিক মাধ্যমটি যখন অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়, তখন এর লিখিত রূপেরও বিকাশ ঘটে। এই ‘ভাষা’ অভিধাটি দিয়ে পৃথিবীর যে কোনো ভাষাকে যেমন বুঝায়, তেমনি কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত মায়ের ভাষাকেও নির্দেশ করতে পারে।

অন্যদিকে, ‘মাতৃভাষা’ পরিভাষাটি ওপরের সংজ্ঞাটিকে সমর্থন করলেও তা দিয়ে শুধু মানুষের সেই ভাষারূপটিকে বুঝানো হয়ে থাকে, যেটি সে প্রথম ভাষা হিসেবে জন্মের পর অর্জন করে থাকে। এক্ষেত্রে একটি বিষয় বিবেচ্য। মানুষ সবসময় যে তার প্রথম ভাষাটি মায়ের কাছ থেকেই শিখে তা কিন্তু নয়, সে এটি বাবা, দাদি-নানি, খালা বা অন্য স্বজনের কাছ থেকেও শিখে নিতে পারে। তাই ‘মাতৃভাষা’ পরিভাষাটি অনেকটা প্রতীকী অর্থে প্রথম অর্জিত ভাষিক রূপকেই নির্দেশ করা হয়।

‘মাতৃভাষা’ অভিধাটির আরও কিছু গুণগত তাৎপর্য রয়েছে। ‘মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার’- এই শ্লোগানটির মধ্য দিয়ে মায়ের ভাষাকে অন্যতম অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। মূলত ১৯৪৮ সালে প্রথম মাতৃভাষাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত (Universal Declaration of Human Rights) এর মাধ্যমে। আমরা জানি, মানুষের জীবনের সঠিক ও পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা প্রয়োজন। কারণ, এই পাঁচটি বস্তুগত ও জ্ঞানগত উপাদান ছাড়া কোনো মানুষই নিজেকে যথার্থ অর্থে বিকশিত করতে সমর্থ হয় না। ওপরে উল্লিখিত জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার বিষয়ক ঘোষণায়ও মায়ের ভাষাকে ভাব প্রকাশের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, মায়ের ভাষা ব্যতীত মানুষ নিজের আবেগ, অনুভূতি, ভাবনা-কল্পনাকে অন্যের কাছে সঠিকভাবে প্রকাশ করতেও সক্ষম হয় না। পৃথিবীতে মায়ের ভাষা ছাড়া এমন একটি দিনও কি কল্পনা করা যায়? অবশ্যই না। তাহলে যে পৃথিবীর মানুষের ব্যক্তিগত ভাব প্রকাশসহ সকল বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানগত কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

মানুষের মায়ের ভাষার আরও কিছু গুণকীর্তন করা যাক। মাতৃভাষাই কোনো ভাষাগোষ্ঠীর জাতীয়তাবাদ নির্ধারণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। মায়ের ভাষার সাহায্যেই মানুষ তার সৃজনশীলতার চূড়ান্ত বিকাশ ঘটায়। কারণ, এ ভাষাতেই রচিত হয় কালজয়ী সব সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন আখ্যান। মায়ের ভাষা মানুষের বোধগত বা প্রজ্ঞানগত সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচিত হয়। সর্বোপরি, মায়ের ভাষার দৈনন্দিন অনুশীলন মানেই হচ্ছে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে লালন এবং ধারণ করা।

মাতৃভাষার মৃত্যু মানে সংশ্লিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর হারিয়ে যাওয়াকেই বুঝায়। এই কথাটি আরেকটু তির্যকভাবে বলেছেন ডেনিশ ভাষাবিজ্ঞানী টুব স্ফুটনাভ কাঙ্গাস। তাঁর মতে (উদ্ধৃত, Hough ২০১৭), কোনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের যদি তাদের মাতৃভাষা বাদ দিয়ে অন্য কোনো ভাষা দিয়ে শিক্ষিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়, তাহলে সেটি শুধু মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধই নয়, বরং এক ধরনের গণহত্যাও বটে। তাহলে চিন্তা করুন, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মায়ের ভাষার মৌলিক অধিকারকে অবজ্ঞা করে আমরা কী ভয়ঙ্কর অপরাধই না করে ফেলি!

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে , পৃথিবীব্যাপী যে সাত হাজারেরও বেশি মাতৃভাষা আছে এগুলোর মধ্যে স্বল্প সংখ্যকই দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠছে। অন্যদিকে, এর বিরাট অংশই হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা জানতে চেষ্টা করি মাতৃভাষার মৃত্যু বা হারিয়ে যাওয়া বলতে কী বুঝায়? মাতৃভাষার হারিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট ভাষার চর্চাকারীদের মৃত্যু হওয়া। তবে ভাষিক বিশ্বে এটি একটি অনিবার্য বাস্তবতা, যাকে কিছুতেই এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া আরও কিছু কারণে মাতৃভাষার মৃত্যু ঘটতে পারে। বিশেষ করে, কোনো দেশের ভাষিক সংখ্যালঘুরা যদি পড়াশুনা, ব্যবসা-বাণিজ্য বা বৃহত্তর গোষ্ঠীর সাথে একীভূত হওয়ার কারণে নিজের মাতৃভাষাকে ছেড়ে দিয়ে মূলধারার ভাষাটিকে গ্রহণ করে, তাহলেও মায়ের ভাষার মৃত্যু ঘটতে পারে।

মানুষের দৈনন্দিন ভাবপ্রকাশসহ সৃজনশীলতার উৎকৃষ্ট বিকাশ যার মাধ্যমে ঘটে, সেই মায়ের ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কারণ, মায়ের ভাষার মাধ্যমে মানুষ প্রতিনিয়ত যে কথা, উপকথা বা যে গল্পরূপ সৃজন করে তা তার স্বপ্ন ও কল্পনা ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া মানুষের ভাষিক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার প্রধান উপায় হচ্ছে সব মাতৃভাষার চর্চা ও লালন করা। এটি মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখারও একটি অন্যতম কৌশল। পাশাপাশি, মানুষের মগজের কার্যকক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মাতৃভাষার চর্চার বিকল্প নেই। সে কারণেও মাতৃভাষাচর্চাকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়।

মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার অনেকগুলো উপায় আছে। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, বিলীয়মান বা মৃত্যু ঘটতে যাওয়া ভাষাগুলোর উপাত্ত সংগ্রহ করা। সংগৃহীত এসব উপাত্তের সাহায্যে লিখিত ব্যাকরণ যেমন তৈরি করা যায়, তেমনি অভিধান রচনা করাও সম্ভব। আবার মাতৃভাষার মধ্যে যেগুলো অবিকশিত বা সীমিত বিকশিত, সেগুলোকে রক্ষা করার অন্যতম কৌশল হচ্ছে এদের অবয়বগত উন্নয়ন সাধন করা। উদাহরণস্বরূপ, এসব ভাষা লেখার জন্য লিপি প্রবর্তন করা একটি আশু কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত। নতুন লিপি প্রবর্তিত এসব স্বল্প বিকশিত মাতৃভাষার শব্দ সংখ্যা বাড়িয়ে তার প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য দরকার জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র ও বিষয়ের পরিভাষা প্রণয়ন করা। পাশাপাশি, অনুবাদের মাধ্যমেও স্বল্প বিকশিত এসব মাতৃভাষার প্রকাশভঙ্গিকে সহজেই উন্নত ও চৌকস করা যায়। এখানে অনুবাদ বলতে উন্নত ভাষার সাহিত্যকর্ম, উন্নত আখ্যান, দর্শন বা বিজ্ঞানভাবনাকে কম বিকশিত ভাষায় রূপান্তর করাকেই বুঝানো হচ্ছে। বিষয়টি এর বিপরীতক্রমেও ঘটতে পারে।
উল্লিখিত কাজগুলো ছাড়াও মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা তথা বিকশিত করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে, এগুলোর লিপি এবং পরিভাষা প্রণয়নের পাশাপাশি বিদ্যালয়ে বহুভাষাশিক্ষা প্রবর্তন করা। বহুভাষা শিক্ষা চালুর প্রথম ধাপে সংশ্লিষ্ট মাতৃভাষাটিকে শ্রেণিকক্ষে একটি ভাষা কোর্স হিসেবে চালু করা যায়। পর্যায়ক্রমে সেই ভাষাটিকে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে সেই মাতৃভাষার সাহায্যে সাহিত্য রচনার পাশাপাশি গণিত, বিজ্ঞান, ধর্ম, ইতিহাস ইত্যাদি গ্রন্থ ও রচনা করা যেতে পারে ।

তবে মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা বা তা সংরক্ষণের বিষয়টি অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণও বটে। প্রথমত, মাতৃভাষা বিষয়ক গবেষণা সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সরকারি বা বেসরকারি অর্থ বরাদ্দ লাভ করা। অর্থ প্রাপ্তির পাশাপাশি বিপদাপন্ন বা মৃতপ্রায় মাতৃভাষার উপাত্ত সংগ্রহের জন্য দক্ষ গবেষকের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। সেজন্য উচ্চশিক্ষাস্তরে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন ধরনের কোর্স চালুর আবশ্যকতা রয়েছে। এছাড়াও মাতৃভাষা সংরক্ষণ ও নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে দেশবাসীর মানসিকতার পরিবর্তন করাও দরকার। প্রতিটি ভাষাই, তা সে যতই ক্ষুদ্র বা বড় হোক না কেন, সব বিষয়ই প্রকাশের ক্ষেত্রে সমান সম্ভাবনাময়- এই সত্যটিকে উপলব্ধি করতে হবে।

উল্লিখিত বিষয়সমূহকে বিবেচনায় রেখেই ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এবং তাঁরই প্রত্যক্ষ সহায়তায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই সংস্থাটি তাঁরই নেতৃত্বে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করে ২০১০ সালে। এই এক যুগেরও বেশি সময়ে মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পুরোপুরি বাস্তবায়িত করতে না পারলেও, অর্জন একেবারে কম নয়। আশা করা যায়, সবার সহযোগিতা পেলে অদূর ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সমগ্র পৃথিবীতে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।

লেখক: মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট (আমাই)।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন