মিয়ানমারে জান্তার ভয়ে সন্তানদের ত্যাজ্য করছেন শত শত বাবা-মা

fec-image

মিয়ানমারে জান্তা সরকারের ভয়ে নিজের সন্তানদের ত্যাজ্য করে দিচ্ছেন দেশটির শত শত বাবা-মা। দেশটিতে যারা জান্তাবিরোধীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে এই ত্যাজ্য করার ঘটনা বেড়ে চলেছে। গত বছরের নভেম্বর মাসে এমন ঘোষণা দেয় জান্তা সরকার। এরপর থেকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রতিদিনই গড়ে প্রায় ছয় থেকে সাতটি পরিবার তাদের ছেলে, মেয়ে, ভাতিজি-ভাতিজা, ভাগ্নি, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করছে। যারাই মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন তাদের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিন্ন করছেন স্বজনরা।

গত নভেম্বর মাস থেকেই নিজেদের সমালোচকদের দমনে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে সেনাবাহিনী। বিরোধিতাকারীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।

কেউ বিরোধীদের আশ্রয় দিলে তার উপরেও নেমে আসছে নির্যাতন। ফলে মিয়ানমারের শত শত অভিবাবক তাদের সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন। এমন অন্তত ৫৭০টি বিজ্ঞপ্তি পর্যালোচনা করেছে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স।

এক রিপোর্টে জানানো হয়, দেশটির সাবেক গাড়ি বিক্রয়কর্মী লিন লিন বো বো সামরিক শাসনের বিরোধী সশস্ত্র একটি গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন। গত নভেম্বরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন দৈনিক দ্য মিররে দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে লিন লিন বোর বাবা-মা বলেন, আমরা লিন লিন বো বোকে ত্যাজ্য ঘোষণা করছি। কারণ সে কখনই তার বাবা-মায়ের ইচ্ছা শোনেনি। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বর্তমানে থাইল্যান্ডের সীমান্তের কাছের একটি শহরে বসবাস করছেন লিন লিন। ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ বলেন, তার মা তাকে বলেছিলেন যে, সৈন্যরা বাড়িতে এসে তল্লাশি চালানোর পর তাকে অস্বীকার করেছেন তিনি। কয়েক দিন পর সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তটি পড়ে তিনি কেঁদেছিলেন বলে জানিয়েছেন। লিন লিন আরও বলেন, চাপের কারণে পরিবার এটা করতে বাধ্য হয়েছে বলে আমার কমরেড আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু আমি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছি। রয়টার্স লিনের বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা মন্তব্য জানাতে অস্বীকার করেছেন।

বৃটেনের মানবাধিকার সংস্থা বার্মা ক্যাম্পেইন ইউকের সিনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার ওয়াই নিন উইন্ট থন জানান, ১৯৮০’র দশকের শেষের দিকে এবং ২০০৭ সালের বিশৃঙ্খলার সময় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বিরোধী কর্মীদের পরিবারকে নিশানা বানানোর কৌশল ব্যবহার করে। গত বছরের ১লা ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেই কৌশল আবার ব্যবহার করা হচ্ছে। এছারাও পরিবারের সদস্যদের প্রকাশ্যে ত্যাজ্য ঘোষণার দীর্ঘ ইতিহাস আছে মিয়ানমারে সংস্কৃতিতে। জান্তার চাপ মোকাবিলার এটি একটি উপায়। তবে অতীতের তুলনায় এবার গণমাধ্যমে এ ধরনের বিজ্ঞপ্তি বেশি দেখা যাচ্ছে বলে জানান ওয়াই নিন উইন্ট থন। বলেন, পরিবারের সদস্যরা অপরাধে জড়ানোর ব্যাপারে ভয় পান। তারা গ্রেফতার হতে চান না। তারা সমস্যায়ও পড়তে চান না।

এ নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর এক মুখপাত্রের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও রয়টার্সের প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। তবে গত নভেম্বরে এ ধরনের বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারে দেশটির সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জ্য মিন তুন বলেন, যারা সংবাদপত্রে এ ধরনের ঘোষণা দিচ্ছেন, তারা যদি জান্তার বিরোধীদের প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ গঠন করা হতে পারে।

গত বছর জান্তা সরকার মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করার পর রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ তরুণ। তবে তাদের অনেকেই এখন সামরিক বাহিনীর সহিংস দমন-পীড়নে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আবার অনেকে দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোতে যোগ দিয়েছেন। এমনই একটি সংগঠন পিপলস ডিফেন্স ফোর্স। তারা দেশটির ক্ষমতাচ্যুত বেসামরিক সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছেন দেশটির গণতন্ত্রকামী আন্দোলনকারীরা। স্থানীয় পর্যবেক্ষক গোষ্ঠী অ্যাসিস্ট্যান্স এসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারস বলছে, গত বছর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী অন্তত দেড় হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের বেশিরভাগই অভ্যুত্থানবিরোধী। এছাড়া গ্রেফতার করা হয়েছে আরও প্রায় ১২ হাজার মানুষকে। তবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নিহত এবং গ্রেফতারের এই পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত বলে জানিয়েছে।

সাংবাদিক সো পিয়ায় অং রয়টার্সকে বলেন, বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে দাঙ্গা পুলিশকে লাঠিচার্জ এবং ঢাল ব্যবহারের চিত্রধারণ করেছিলেন তিনি। এই ভিডিও তিনি স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডেমোক্র্যাটিক ভয়েস অব বার্মায় সরাসরি সম্প্রচার করেছেন। এরপর কর্তৃপক্ষ তার খোঁজে আসে এবং তিনি মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেন। পরে স্ত্রী এবং শিশু কন্যাকে নিয়ে থাইল্যান্ডে পালিয়ে যান তিনি। গত নভেম্বরে তার বাবা তাকে ত্যাজ্য করেন। তার বাবা টিন অং কো রাষ্ট্রায়ত্ত দৈনিক মিয়ানমার আলিনে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, আমি আমার ছেলেকে অস্বীকার করছি। কারণ সে বাবা-মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অমার্জনীয় কাজ করেছে। তার ব্যাপারে আমার কোনো দায়-দায়িত্ব থাকবে না। সো পিয়ায় অং বলেন, আমি যখন পত্রিকাটি দেখলাম যেটি আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলেছে, তখন আমি কিছুটা দুঃখ পেয়েছি। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি যে, আমার বাবা-মায়ের ওপর চাপের ভয় ছিল। বাড়ি বাজেয়াপ্ত অথবা গ্রেফতার করা নিয়ে তাদের উদ্বেগ থাকতে পারে। তার বাবা টিন অং কো এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

তবে এই বাবা-মা’রা মন থেকে তাদের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা হারাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই রয়টার্সকে জানিয়েছেন যে, এটি শুধু করা হয়েছে সাময়িকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে। একজন বলেন, আমার মেয়ে যা বিশ্বাস করে তাই সে করেছে। কিন্তু এ জন্য আমরা যদি সমস্যায় পড়ে যাই, তাহলে আমি নিশ্চিত সে দুশ্চিন্তা করবে। আমরা কেনো তাকে ত্যাজ্য করেছি তা সে বুঝতে পারবে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন