‘রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার নামে শিক্ষিত বাঙালীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে’

10921796_811505502253302_1552811152_n

স্টাফ রিপোর্টার :

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। তিনি বলেন, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার আগে ইউনিভার্সিটি গ্রান্ড কমিশন (ইউজিসি) সহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রাচীন কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে তাদের কাছ থেকে সুপারিশ নিতে হবে।  দেখতে হবে সেখানে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার উপযোগিতা আছে কি-না। সাথে সাথে এটাও দেখতে হবে সেখানকার অধিবাসীরা কি চায়। আঞ্চলিক পরিষদের অনুমতি ছাড়া সেখানে কিছু করায় সরকারের নৈতিক অবস্থানের বরখেলাপ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শুক্রবার (১৬ জানুয়ারি) ১১টায় শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরের সম্মুখে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের পাঠদান কার্যক্রম উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে রাঙামাটি শহরে জাতিগত সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে এবং রাজশাহীতে উপজাতি ছাত্র নেতা বাবলু হেমব্রম-এর খুনীদের বিচারের দাবিতে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে আযোজিত সংহতি সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান।

তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, যেখানে ভাল প্রাইমারী-মাধ্যমিক স্কুল নাই, যেখানে ভাল কলেজ নাই, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে কি হবে? এটা একটা প্রতারণা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বাঙালি ও বাঙালি মুসলমানরা একটা অ্ত্যাধুনিক প্রতারণার ব্যবস্থা করেছে । সুতরাং এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসিদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করতে হবে এবং তারা সুপারিশ করবে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না? এর আগে মেডিকেল কলেজের সমস্ত কার্যক্রম স্থগিত করার দাবি জানান তিনি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ আরো বলেন, পার্বত্য চট্রগ্রামে যে সমস্যা তা মূলত রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত সমস্যা। সরকারের বিশাল ক্ষমতা আছে। সরকার চাইলে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে একাট করে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। কারণ বাংলাদেশ এখন একটি মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছে। সরকারের টাকা আছে বলেইতো করতে চাচ্ছে।

ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পংকজ ভট্টাচার্য অভিযোগ করে বলেন, রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ স্থাপনের নামে শিক্ষিত শরণার্থী শিবির বানানোর চক্রান্ত হচ্ছে । শরণার্থীদের নিয়ে ওখানকার সামরিক জান্তারা পাহাড়িদের জোরপূর্বক সংখ্যালঘূ বানিয়ছে। যেখানে বাঙালী ছিল ২ ভাগ, পাহাড়ি ছিল ৯২ ভাগ। সেখানে আজ বাঙালি ৪৬ ভাগ আর পাহাড়ি ৫৪ ভাগ। এটা একটা নবতর চক্রান্ত। এর পেছনে ফিলিস্তিনের দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

সরকারের উদ্দেশে পঙ্কজ  ভট্টাচার্য বলেন, পার্বত্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছে পাহাড়ের মূল সমস্যা- ভুমি সমস্যা সমাধানের জন্য। অথচ সেখানে ষোলশ প্রতিষ্ঠান পাহাড়িদের জমি দখল করে আছে। এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বাঙালী আজ পাঞ্জাবীর বেশ ধারণ করে উপজাতিদের পদদলিত করবে তা কোনভাবেই মেনে নেওয়া হবে না বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ উদ্দিন খান সংহতি জানিয়ে বলেন, সন্ত লরমা, উষাতন তালুকদারের মতো যারা পার্বত্য চট্রগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন, শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌছে দিয়েছেন তারা আজ মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করছে। তার পেছনে অবশ্যই কারণ আছে। তাদের সমস্যাটা বুঝতে হবে। পাহাড়িদের সমস্যা দেখতে হলে পাহাড়িদের চোখে তা দেখতে হবে। এসময় তিনি পাহাড়িদের সমস্যাকে শুধু উন্নয়নের সমস্যা মনে না করে তাদের মূল চাওয়া-পাওয়াগুলো খতিয়ে দেখার আহবান জানান ।

তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে আরো বলেন, আমরা সাধারণত ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা দেখি। কিন্তু পাহাড়ে জন্মলগ্ন থেকেই জাতিগত সাম্প্রদায়কিতা চলছে। গত ৪৩ বছর ধরে তাদের সমস্যার সমাধান না করে সামরিক কায়দায় নিপীড়ন চালিয়ে তাদের কণ্ঠকে অবদমন করার প্রচেষ্টা চলছে। পার্বত্য চট্রগ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশের গাজা। আজ গাজায় কিছু হলে যেমন আমাদের কষ্ট হয় তেমনি পাহাড়ীদের উপর প্রতিনয়িত যে নির্যাতন চলছে তা আমাদের খুবই মর্মাহত করে। এসময় তিনি পাহাড়িদের উপর অব্যাহত জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংকাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস স্বাগত বক্তব্যে বলেন, রাঙামাটিতে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার নামে শিক্ষিত বাঙালীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। পাহাড়ে জোর করে বাঙালিদের পুনর্বাসিত করে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করা হচ্ছে । এরই অংশ হিসাবে এ মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। আর সে কারণেই পাহাড়িরা তার বিরোধিতা করছে। সেখানে বাঙালিরা পড়াশুনা করবে। তারাই অধ্যাপনা করবে। এর ফলে সেখানে শিক্ষিত বাঙালিরা পুনর্বাসিত হবে। পাহাড়ে যে উগ্র ইসলামীকরণ, উগ্র জাতীয়তাকরণ ও উগ্র বাঙালিকরণ চলছে তারই ধারাবাহিকতায় এ মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এসময় তিনি সকল পাহাড়ি জনগোষ্ঠি নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দেন।

সংহতি সমাবেশে আরো উপস্থিত ছিলেন সংগীত শিল্পী মাহামুদুজ্জামান বাবু; অধ্যাপক সৌরভ সিকদার, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) নেতা রাকেকুজ্জামান রতন, এএলআরডি নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, আইইডি নির্বাহী পরিচালক নুমান আহমেদ খান প্রমুখ। দাবিনামা উত্থাপন করেন এ্যাডভোকেট নিলুফার বানু । সভা সঞ্চালনা করেন উপজাতি সংগঠক দীপায়ন খীসা। উপস্থিত ছিলেন সংগীত শিল্পী আনুশাহ, অধ্যাপক স্বপন আদনান ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন।

এছাড়াও জন উদ্যোগ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আরডিসি, ছ্ত্রা ঐক্য ফোরাম, আদিবাসী অধিকার আন্দোলন, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, আদিবাসী যুব পরিষদ, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, নিজেরা করি, কাপেং ফাউন্ডেশন, আদিবাসী ফোরাম, পার্বত্য চট্টগাম আন্তর্জাতিক কমিশন, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন, মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল, মাহাতো ছাত্র সংগঠন, মাদলসহ বিভিন্ন সংগঠন সংহতি জ্ঞাপন করেন। 

এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর থেকে একটি প্রতিবাদ মিছিল শুরু হয়ে শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরের সম্মুখে এ সংহতি সমাবেশে গিয়ে মিলিত হয়। এবং সমােবশ শেষে পুনরায় একটি মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে গিয়ে শেষ হয়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন