“যুক্তরাষ্ট্রের রাস্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার সহ ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল ২ শতাধিক রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন এবং ডি ৪ ব্লকে পায়ে হেটে র‌্যালীতে অংশগ্রহণ করেন।”

রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন চায় যুক্তরাষ্ট্র

fec-image

কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয়েছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা তাদের মৌলিক দাবি আদায় পূর্বক মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী।

শরণার্থী দিবসে কুতুপালং ক্যাম্পের ডি ৫ ব্লকে ইউএনএইচসির এর থাই এনজিওর অফিস কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সকাল সাড়ে ১১টায যুক্তরাষ্ট্রের রাস্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার সহ ৩ সদস্যের প্রতিনিধি দল ২ শতাধিক রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলেন এবং ডি ৪ ব্লকে পায়ে হেটে র‌্যালীতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি উখিয়ার কুতুপালংয়ের বেশ কয়েকটি ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং এনজিওর কার্যক্রমও দেখেন।

এছাড়াও কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম, ক্যাম্প ইনচার্জ রেজাউল করিম, পাবেল হায়দার, ওবাইদুল্লাহ সহ এনজিও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তারা রোহিঙ্গাদের হাতে প্রদর্শিত প্লে-কার্ড, ব্যানারে লিখিত দাবি সমূহ পড়ে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে আশ্বস্থ করেন রোহিঙ্গাদের। তবে বিশ্ব জুড়ে যখন বাস্তুচ্যূত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, সাথে সাথে বাড়ছে শরণার্থীর সংখ্যাও।

দিবসটি বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। কারণ বাংলাদেশে বর্তমানে অবস্থান করছে ১১ লাখের বেশি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশেল পক্ষ থেকে জোর দাবী জানানো হলেও কারণে-অকারণে মিয়ানমার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করছেনা। যার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে ঝুলে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।

এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে স্থানীয় জনসাধারণ। ১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করলেও, পরে কুটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তারা নিজ দেশে ফেরত যান। এর পরে ১৯৯১ এর পর থেকে বড় আকারে তিন দফায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে।

গত বছরের আগস্টে পরে খুবই স্বল্প সময়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়প্রার্থী। এই দফায় রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢলকে ইউএনএইচসিআর গত এক দশকের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থীদের ঢল হিসেবে চিহিৃত করেছে। বিশ্ব শরনার্থী দিবস সম্পর্কে মিয়ানমারের নাগরিকদের কোন প্রকার ধারণা নেই। কারণ এদের বিশের ভাগ অংশ নিরক্ষর।

কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পে অবস্থানকারী ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে আসা সাবেক মাঝি হাফেজ আহমদ (৫৫)জানান,মিয়ানমারে থাকাকালে তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। স্বশিক্ষিত এ রোহিঙ্গা নেতা কুতুপালং রেজিস্ট্রার্ড ক্যাম্পে আশ্রয়ে আছেন। মিয়ানমারের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রোহিঙ্গা হাফেজ আহমদ মাঝির সঙ্গে সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ হয়।

তিনি জানান, মিয়ানমার সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের কোনোদিন মেনে নেবে না। রোহিঙ্গাদের পক্ষে যারা কথা বলছেন তাদেরও বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ২০১৮ সালের ২১ মার্চ মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট টিন চ’র পদত্যাগ, একইদিনে সংসদের স্পিকার উ উইন মিন্তের স্বেচ্ছায় পদত্যাগের কারণ রোহিঙ্গা ইস্যু।’ রোহিঙ্গা নেতা ডা. ফয়সাল আনোয়ার (৪৯) একজন চিকিৎসক। তিনিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন।

তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের পক্ষে সামান্যতম কথা বলার লোক রয়েছেন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসিতে (এনএলডি)। এই দলটির কিছু নেতা আছেন তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সোচ্চার। সংসদে এনএলডির কর্তৃত্ব থাকলেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গিয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। যারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মুখ খুলছেন তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। এ নিয়ে মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। যে কোনো সময়ে সেখানে আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই এ মুহূর্তে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রায় অনিশ্চিত বললে চলে।’

কুতুপালংয়ের ৭ নাম্বার ক্যাম্পের হেড মাঝি বনভূমিতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নেতা মুহিদুল্লাহ (৩৫)জানান, রোহিঙ্গারা যেসব গ্রামে বসবাস করত, সে গ্রামগুলো নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন স্থান থেকে রাখাইনদের নিয়ে এসে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তাই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকার ফিরিয়ে নেবে এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন উগ্রবাদীরা যে হিংসাত্মক আচরণ করছে তা বিশ্বের কোনো দেশে নেই। যে কারণে তাদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ফেলে এখানে চলে আসতে হয়েছে। তিনি আরও জানান, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে যারা কথা বলছেন, মিয়ানমার সেনারা তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করে দেশ ত্যাগে বাধ্য করছে। তাই প্রত্যাবাসন সম্পর্কে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান এম.গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বৃস্পতিবার শরনার্থী দিবস ঠিক আছে। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়া রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আমাদের মাঝে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। আর অবাধে বিচরণের সুযোগ পাওয়া রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমাচ্ছে।

জানতে চাইলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘মিয়ানমার প্রথমে বলেছিল, শূন্যরেখায় অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু ওই শূন্যরেখায় অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি করে পরিস্থিতি বিমূখ করে রেখেছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। অন্যথায় প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি এ অঞ্চলের পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: প্রত্যাবাসন, যুক্তরাষ্ট্র, রোহিঙ্গাদের
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন