প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের নির্যাতনে আরসার একাধিক ‘টর্চার সেল’

fec-image

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক মিয়ানমারের সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) একাধিক টর্চার সেল রয়েছে। মূলত প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের শাস্তির নামের নির্যাতন চালাতে তৈরি করা হয়েছে এসব টর্চার সেল। যেখানে অনেক কমিউনিটি নেতাসহ সাধারণ রোহিঙ্গাদের সালিসের নামে চালানো হয় নির্যাতন। রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদক ও আধিপত্যসহ নানা অপরাধ সংঘটনের নিরাপদ আস্তানা হিসেবেও ব্যবহার হতো এসব টর্চার সেল।

বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) মধ্যরাতে উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকার মধুরছড়া পাহাড়ের গহীনে এমন একটি টর্চার সেলের সন্ধান পেয়েছে র‌্যাব।

সন্ধান পাওয়া ওই টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে সংগঠনটির শীর্ষ দুই কমান্ডারকে। যাদের মধ্যে একজন ওই টর্চার সেলটির প্রধান এবং গত নভেম্বরে বান্দরবান জেলার ঘুমধুম সীমান্তে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানের সময় হামলা চালিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এর জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা হত্যাকান্ডসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত অনেক হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত।

শুক্রবার (২৭ অক্টোবর) দুপুরে র‌্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়ন কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন, উখিয়া উপজেলার ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মৃত নুরুজ্জামানের ছেলে মো. ওসমান ওরফে সালমান মুরব্বী (৫০) এবং ৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সৈয়দ হোসেনের ছেলে মো. ইউনুস (২৪)।

র‌্যাব জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার সালমান আরসা’র শীর্ষ কমান্ডার, আরসা’র ওলামা বডি ও টর্চার সেলগুলোর প্রধান। যিনি গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এর কর্মকর্তা হত্যাকান্ডসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ও আলোচিত হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আর ইউনুস সন্ধানপ্রাপ্ত টর্চার সেলটির নিয়ন্ত্রক ও সালমানের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কমান্ডার।

অভিযানে উদ্ধার হয়েছে, ০১ টি ৯ এমএম বিদেশী পিস্তল ও পিস্তলের ৪ রাউন্ড গুলি, ৪টি একনলা ওয়ান শুটার গান, ২টি এলজি, ৫ রাউন্ড ১২ বোর কার্তুজ, ১টি কুড়াল, ৩টি বিভিন্ন সাইজের প্লাস, ১টি কাঠের লাঠি, ১টি স্টিলের লাঠি, ১টি করাত, ১টি চাকু, ১টি লোহার রড, ১টি লোহার দা, ১টি হ্যাংগিং হুক, ১টি সিসর, ৪টি তালা, ৩টি বড় লোহার পেরেক, ২টি লোহার শিকল, ১টি রশি, ১টি কুপি বাতি এবং সুইসহ সুতার ১টি বান্ডেল।

সংবাদ সম্মেলনে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, র‌্যাব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী সংগঠন আরসার কর্তৃক খুন, অপহরণ, ডাকাতি, মাদক, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্রিক কোন্দলসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপ লক্ষ করে যাচ্ছে। যার সূত্র ধরে ধারাবাহিক অভিযান চলতে। ইতিমধ্যে র‌্যাবের অভিযানে আরসা’র শীর্ষ সন্ত্রাসী ও সামরিক কমান্ডার, গান কমান্ডার, অর্থ সম্পাদক, আরসা প্রধান আতাউল্লাহ’র একান্ত সহকারী এবং অর্থ সমন্বয়ক সহ মোট ৭৩ জন আরসার সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। গ্রেপ্তারদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সন্ত্রাসী গোষ্টিটির শীর্ষ সন্ত্রাসী সহ অন্যান্য সদস্যদের গোয়েন্দা নজরদারী রাখা হচ্ছে।

আর এই ভিত্তিতেই বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব অভিযান চালায় বলে জানিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, ৪ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে সালমান মুরব্বীকে গ্রেপ্তারের পর তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মধুরছড়ার পাহাড়ের গহীনে মিলে টর্চার সেলটি। ওখানে মো. ইউনুসকে গ্রেপ্তারের পর অস্ত্র, গুলি ও অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, সালমান মুরব্বী ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এসে থাইংখালীর ১৩ নম্বর ক্যাম্পে বসবাস শুরু করে। ২০১৮ সালে সে আরসার ওলামা কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য ও কমান্ডার মৌলভী মোস্তাক আহম্মদ এবং মৌলভী আবু রায়হান এর সাথে সাক্ষাতের মাধ্যমে আরসায় যোগদান করে। পরে অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে নানা দায়িত্ব পালন করে। বর্তমানে আরসার ওলামা বডির প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব পায় সালমান। তার নির্দেশনায় মৌলভী লাল মোহাম্মদ এর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি গ্রুপ তৈরী করা হয়। যারা মুলত রোহিঙ্গা তরুণ ও যুবকসহ সাধারণ রোহিঙ্গাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে অথবা জোরপূর্বক আরসায় যোগদান করায়।

গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক তথ্যের সূত্র ধরে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১৯ সালে আরসা প্রধান আতাউল্লাহর নির্দেশনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার আধিপত্য এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিরবিচ্ছিন্নভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতরে ও ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড় ও গহীন জঙ্গলে একাধিক টর্চার সেল স্থাপন করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে কয়েকটি জোনে বিভক্ত করে সালমান মুরব্বীর নেতৃত্বে মাষ্টার কামাল, মাষ্টার ইউনুছ, জাফর আলম, মৌলভী যুবায়ের, মাষ্টার আবুল হাশিম, মাষ্টার সলিম সহ আরও আরসার কমান্ডাররা একাধিক টর্চার সেল পরিচালনার করে আসছে বলে তথ্য মিলেছে। ইতিমধ্যে র‌্যাব এসব টর্চার সেলের সন্ধানে কাজ শুরু করেছে বলে জানান তিনি।

গ্রেপ্তার ২ জনকে আইনগত প্রক্রিয়ার জন্য উখিয়া থানায় সোপর্দ করার প্রক্রিয়া চলবে বলে জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন