সাংস্কৃতিক বৈচিত্রমন্ডিত বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল

কালচারাল রিপোর্টার, পার্বত্যনিউজ ডটকম:
নানা সাংস্কৃতিক বৈচিত্রে বৈচিত্রমন্ডিত বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল। বাংলাদেশের এক দশমাংশে অবস্থিত এই অঞ্চলে রয়েছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস। এখানে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র দেশের ও দেশের বাইরের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। তাইতো এখানকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র উপভোগ করতে প্রতিনিয়তই দেশী বিদেশী পর্যটক ভীড় জমায়।

পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়ী-বাঙ্গালীসহ মোট ১৩টির বেশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস করে। এদের প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। এই বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বাংলাদেশের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে আরো সমৃদ্ধ করেছে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন। সরকারও এই বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র যাতে হারিয়ে না যায় তার জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তন্মধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তিন পার্বত্য জেলায় এসব সাংস্কৃতিক ইনষ্টিটিউটের মাধ্যমে পার্বত্যাঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে আরো গতিশীল করার জন্য কাজ করা হচ্ছে। এবং এই ইনষ্টিটিউটের মাধ্যমেই দেশের বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতির সাথে পার্বত্য এলাকার সাংস্কৃতির মিলন ঘটানো হচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, কঁচি কাঁচার মেলা ও খেলাঘর আসরসহ স্থানীয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমুহ এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিকাশে কাজ করছে।

পার্বত্যাঞ্চলে বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের পাশাপাশি চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তংচঙ্গা, বম, পাঙ্খো, লুসাই, খুমী, চাক্, খ্যিয়াং ও  ম্রো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগন বসবাস করেন। তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল।    

চাকমা
চাকমা, পার্বত্য এলাকার জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালীর পর দ্বিতীয় বৃহৎ জনগোষ্ঠী। তাদের রয়েছে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। অসংখ্য গান এবং নৃত্যের সমন্বয়ে চাকমাদের রয়েছে একটি বিশাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

চাকমাদের জুম নৃত্য

জুম নৃত্য পরিবেশন করছেন চাকমা তরুণীরা

জুম পার্বত্যাঞ্চলের একটি জনপ্রিয় চাষাবাদ পদ্ধতির নাম। পাহাড়ের ঢালে বিশেষ পদ্ধতি অনুসরন করে এই চাষাবাদ করা হয়। জনবসতি থেকে অনেক দুরে কোন পাহাড়ে ছোট্ট একটি ঘর করে ফসল না আসা পর্যন্ত জুম চাষীরা অস্থায়ীভাবে পাহাড়ে বসবাস করে থাকেন। ফসল কেটে জুম চাষীরা ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। আর মেতে উঠেন নতুন ফসল তোলার উৎসবে। চাকমাদের জুম নৃত্যে জুম চাষীদের জীবন চিত্র অত্যন্ত নিখুতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জুম নৃত্যে দেখানো হয়েছে কিভাবে সকালে জুম চাষীরা হাতে দা, কাঁচি, মাথায় কারলুং (ঝুড়ি) নিয়ে জুমে যান। জুমে তারা কিভাবে কাজ করেন তা এই নৃত্যের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে।
অর্থাৎ জুম নৃত্যকে এক কথায় জুম চাষীদের জীবন চিত্রের সার সংক্ষেপ বলা যেতে পাবে।

মারমা
মারমা পার্বত্যাঞ্চলে জনসংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় জনগোষ্ঠী। নাচে ও গানে সমৃদ্ধ মারমাদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল। তাদেরও রয়েছে বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক বৈচিত্র।

মারমাদের প্রদীপ নৃত্য

ছবিতে প্রদীপ নৃত্যের একটি দৃশ্যে মারমা তরুণীদের দেখা যাচ্ছে

প্রদীপ নৃত্য মারমাদের একটি জনপ্রিয় নৃত্য। এই নৃত্যে একটি মাটির পাত্রে দীপ শিখা জালিয়ে নৃত্য প্রদর্শন করা হয়। দেবতার সন্তুষ্টির জন্যই এই প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত মাটির পাত্র হাতে নিয়ে কেয়াং বা বিহারে হাজির হয় তরুণীরা। মনের বাসনা পুরনের জন্য কেয়াং এ দীপ শিখা জালিয়ে উপসনায় মগ্ন হন তারা। দীপ শিখা জ্বালিয়ে এই পুজাকে অনুসরণ করে এই নৃত্য প্রদর্শন করা হয় বলে একে প্রদীপ নৃত্য বলা হয়ে থাকে। এই নৃত্য করাকালে যদি কারো প্রদীপ নিভে যায় তাহলে দেবতা তার উপর অসন্তুষ্ট এবং যাদের প্রদীপ নৃত্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত জ্বলবে তারা দেবতার সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করা হয়।
সাধারনত বছরের প্রথম দিকে সাংগ্রাই উৎসবের সময় এই নৃত্য বেশি করা হয়ে থাকে।  

ত্রিপুরা
ত্রিপুরা পার্বত্যাঞ্চলে সংখ্যার দিক থেকে চতুর্থ। তাদেরও রয়েছে ঐতিহ্যিক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল।

ত্রিপুরাদের কাথারক (বোতল) নৃত্য:

কথারক নৃত্য পরিবেশন করছেন ত্রিপুরা তরুণীরা

ত্রিপুরা ভাষায় ‘কাথারক’ অর্থ বাংলায় মঙ্গল। এটি ত্রিপুরাদের একটি পুজার নাম। পারিবারিক শ্রীবৃদ্ধি, ঐশ্বর্য বর্ধন, গ্রহ শান্তি, মানসিক শ্রীবৃদ্ধি, দাম্পত্য শান্তি, বিপদমুক্তিতে ‘কাথারক’ পূজা করা হয়। বিশেষ করে বিবাহ সময়ে ‘কাথারক’ পূজা করা হয়। কাথারক বা মাঙ্গলিক পুজার উপাস্য দেবতা হচ্ছে কার্তিক ও গনেশ।
 ‘কাথারক’ পূজাকে নৃত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় বলেএই নৃত্যকে ‘কাথারক’ বা ‘মাঙ্গলিক নৃত্য’। কাথারক নৃত্য বোতলের উপর দ্বীপ শিখা জ্বালিয়ে নৃত্য পরিবেশন করা হয় বলে অনেকে একে বোতল নৃত্য বলে থাকে।

কাথারক পূজার উপকরনাদি ও তাৎপর্য:
কথারক পুজায় দ্বীপ শিখা- জ্ঞানের প্রতীক, গাদা ফুলের মালা -ভক্তির প্রতীক, কাঁসের থাল -ঐশ্বর্যের প্রতীক, রুপার চন্দ্রহার -বংশের প্রতীক, জলভরা কলসীর ঘট -কর্মের প্রতীক, ঢোল -যশের প্রতীক এবং বাঁশের বাঁশি -প্রেমের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ‘কাথারক’ পূজার মাধ্যমে জ্ঞান, ভক্তি, ঐশ্বর্য, কর্ম, বংশ, যশ ও প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জাগতিক জীবনে সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধি লাভ করে। 

 এছাড়াও তংচঙ্গা, বম, পাঙ্খো, লুসাই, খুমী, চাক্, খ্যিয়াং ও  ম্রো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আলাদা আলাদা বর্ণিল সাংস্কৃতি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে।

ছবির ক্যাপশন
১। জুম নৃত্য পরিবেশন করছেন চাকমা তরুণীরা।
২। ছবিতে প্রদীপ নৃত্যের একটি দৃশ্যে মারমা তরুণীদের দেখা যাচ্ছে।
৩। কথারক নৃত্য পরিবেশন করছেন ত্রিপুরা তরুণীরা।

      

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন