‘২০১৬ সালে ২৩ আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে’

গাইবান্ধার এসপিকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হচ্ছে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা- ড. মিজানুর রহমান

দদদদদদ

নিজস্ব প্রতিনিধি, ঢাকা:
‘দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিধি-নিষেধ থাকা সত্ত্বেও ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্রগ্রাম এবং সমতল অঞ্চল মিলে কমপক্ষে ২৩ আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক ও নৃশংস ঘটনা গাইবান্ধায় পুলিশের গুলিতে ৩ আদিবাসী সাঁওতালের হত্যাকাণ্ড’।

রবিবার ডেইলি স্টার ভবন মিলনায়তনে বাংলাদেশ আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৬’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন। মানবাধিকারের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৬ গতবারের চেয়ে অনেক গুণগত ও উৎকর্ষ মানের তবে একজন ব্যক্তিরও যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় তাহলে সেটি সকল জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথ প্রশস্ত করেছে’।

তিনি বলেন, ‘আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষা করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে না।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলেন, এদেশের আদিবাসীরা জনগণ থেকে অজনগণে পরিণত হচ্ছে। তাদের সংখ্যাশূন্য করা হচ্ছে। আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষা করতে না পারলে দেশের সার্বিক মানবাধিকারপরিস্থিতির কোন উন্নয়ন হবেনা। একজন ব্যক্তিরও যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় তাহলে সেটি সকল জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথকে প্রশস্ত করছে’।

তিনি বলেন, ‘আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, বঙ্গবন্ধুর চোখে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি সেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী ভেদাভেদ ছিলনা। আজকে কেন তাহলে আদিবাসীদের অন্য চোখে দেখা হচ্ছে।আদিবাসীদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কেন রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম সেটির বাস্তবায়ন না হলে আমাদের সোনার বাংলাদেশ রচিত হবেনা’।

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রেই বলা হচ্ছে সমতা, সামাজিক ন্যায়চিার, মানবসত্ত্বার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা। এবং এই তিনটির সমন্বিত রূপকেই আমরা মানবাধিকার বলছি। এখন এই মর্যদা রক্ষায় রাষ্ট্র কি তার সঠিক দায়িত্ব পালন করছে। করছে?

রাষ্টের জনগণকে রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে সেই পুলিশরাই সাঁওতালদের ঘরে আগুন জ্বালাচ্ছে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘গাইবান্ধার এসপিকে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হচ্ছে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতারণা। রাষ্ট্রের উচিত যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার সাথে জড়িত তার বিচার, তদন্ত শেষ না পর্যন্ত তাকে তার কর্মথেকেও সাময়িক অব্যাহতি দেয়া উচিত এবং তদন্ত শেষ হলে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’।

তিনি আরও বলেন, ‘একজন নাগরিকও যেন মনে না করে রাষ্ট্র তার প্রতি বিমাতা স্বরূপ আচরণ করছে এবং তার যা প্রাপ্য সেই প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করছে না। এ উপলব্ধি প্রত্যেক নাগরিকের মধ্যে থাকতে হবে। শুধুমাত্র তা হলেই একটি রাষ্ট্র মানবাধিকার বান্ধব রাষ্ট্রে পরিণত হবে’।

অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে নারী অধিকার কর্মী খুশী কবীর বলেন, ‘আমাদের দেশের মানবাধিকার নিঃসন্দেহে ভালো যাচ্ছেনা। কারণ এখানে মুক্ত চিন্তার মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষাকে রাষ্ট্র গ্রহণ করতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে আমাদেরকে উত্তোরণ হতে হবে। গাইবান্ধার যে এসপি সাঁওতালদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী এবং যিনি তদন্তের আওতাধীন আছেন তাকে কিভাবে খাগড়াছড়িতে বদলি করা হয়’। সরকারকে এর উপযুক্ত যুক্তি বা কারণ জানানোর জন্য তিনি আহ্বান জানান।

তিনি আরও বলেন, ‘ভাষার মাসে আমরা যদি শুধু বাংলা ভাষা নিয়ে গর্ব করি এবং অন্যদিকে এদেশেরই আদিবাসীদের ভাষাকে যদি রক্ষা না করি তাহলে তা আমাদের জন্যই লজ্জাজনক হবে বলে মনে করি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের যে তাৎপর্য সেটি আমরাই লঙ্ঘন করছি’।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘সরকার বলছে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে কিন্তু আমরা বুঝবো দেশ তখনি মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে যখন একজন সাঁওতাল বা একজন খাসিয়া বলবে আমরা ভাল আছি। তাহলেই আমরা বুঝবো দেশ এগিয়ে যাচ্ছে’।

তিনি আরও বলেন, ‘বাগদা ফার্মে যে ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে তা আমরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখেছি কিন্তু সরকার বা কোন দল এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের জন্য কিছুই করেনি। তবে উচ্চ আদালত সরকারকে বারবার প্রশ্ন করে একটি সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে’।

অক্সফামের সিনিয়র পলিসি অফিসার মেহবুবা ইয়াসমিন বলেন, ‘আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট এদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকারের সত্যিকারের চিত্র বুঝতে আমাদের সহায়তা করছে। এ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে আমরাআদিবাসীদের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতীকরণে করনীয় সহজে ঠিক করতে পারি’।

সভাপতির বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, ‘বাগদা ফার্মের ঘটনায় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আদিবাসীদের আশ্বাস দিলেও তিনি এখনো কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এভাবেই আমরা দেখছি আদিবাসীদের উপর নির্যাতনেরঘটনায় কেউ সঠিক গুরুত্ব দিচ্ছেনা। আদিবাসীরা অভিযোগ করলেও সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছেনা’।

গাইবান্ধার উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশ যখন আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করলো তখন অনেক আদিবাসীকে তড়িৎ গ্রেফতার করা হলোকিন্তুআদিবাসী থমাস বাস্কে যখন মামলা করলো তখন কাউকেই ধরা হলোনা’।

তিনি আরো বলেন, ‘আদিবাসীরা এভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে এবং ন্যায়বিচার না পেয়ে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হেচ্ছ। তাই আদিবাসীদের মানবাধিকার রক্ষায় সরকার যেখানে নির্লুপ্ত সেখানে আদিবাসীদেরকেই রাজপথের সংগ্রামকরতে হবে। আদিবাসীদের মাঝেও ধর্মের নামে যে বিভাজন তৈরির চক্রান্ত চলছে সে বিষয়ে সকলকে সচেতন হতে হবে;।

কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন রবীন্দ্রনাথ সরেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন চৈতালি ত্রিপুরা ও সঞ্চালনা করেন ফাল্গুনী ত্রিপুরা এবং এ রিপোর্টটি সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেন কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও মানবাধিকার রিপোর্টের অন্যতম একজন সম্পাদক পল্লব চাকমা।।

এসময় তিনি বলেন, ‘গতবছর সর্বমোট ২৩ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে। যার একটিরও ন্যায় বিচারআদিবাসীরা পায়নি। গতবছর ভূমি সংক্রান্ত হামলার ঘটনায় ৬ জন আদিবাসীকে হত্যা করা হয়েছে যার মধ্যে সমতলের ৫ জন ও পাহাড়ের ১ জন এবং ৮৪ জনকে জখম করা হয়েছে। ক্রমাগত জমি দখলের কারণে ৩১,৬৯৯পরিবারের জীবন ও জীবিকা হুমকির মধ্যে রয়েছে যার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬০৬ টি পরিবার এবং সমতলের ৩১,০৯৩ টি পরিবার।

এছাড়াও সমতলের আদিবাসীদের ১,২০৮ টি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে গত ৬ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে বাগদা ফার্মের জমি উদ্ধারের নামে স্থানীয় প্রশাসন পুলিশের সহায়তায় এবং ভাড়াটে গুন্ডাদের মাধ্যমে সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম এলাকার সাঁওতাল ও গরীব বাঙালি কৃষকদের নিজ পৈতৃক ভূমি থেকে জোর করেউচ্ছেদ চেষ্টাকালে তিনজন সাঁওতাল আদিবাসীকে হত্যা করা হয়, ১২০০ আদিবাসী পরিবারের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয় যা আদিবাসীদের অসহায়ত্ব ও নিকৃষ্টতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ।

২০১৬ সালে সারাদেশে আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুর প্রতি ৫৩টি ঘটনায় ৫৮ জন আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশু শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যার মধ্যে ৬ জন আদিবাসী নারী ও কন্যা শিশুকে হত্যা ও ধর্ষণের পরহত্যা করা হয়েছে। সংগঠিত ৫৩ টি ঘটনায় ৩০ জন ভিকটিম পার্বত্য চট্টগ্রামের এবং ২৮ জন সমতলের।

আদিবাসী শিশু ও যুবদের অধিকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিশ্র উন্নয়ন হলেও তাদের শিক্ষা অধিকার বছর জুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। সরকার পাঁচটি আদিবাসী ভাষায় মাতৃভাষা ভিত্তিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করলেও এটি বাস্তবায়নে যথেষ্ট পরিকল্পনার অভাব রয়েছ ‘ বলে তিনি অভিযোগ করেন।

১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তির মূল বিষয়গুলো বাস্তবায়িত না হওযার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির কার্যত এখনো তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি বলেও তিনি জানান।

তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় ও স্থানীয় উভয় পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতা আদিবাসীদের প্রতি সরকারের আধিপত্যবাদী ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকেই প্রতিফলিত করে। ২০১৬ সালে অন্তত ১৯১জন আদিবাসী মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার মধ্যে সমতলের ৪২ জন নিরীহ আদিবাসী গ্রামবাসী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ জন জনপ্রতিনিধিসহ ৮০ জন আদিবাসী মানবাধিকারকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সমতলের ৪ জনসহ মোট ৮১ জনকে আটক করা হয়’।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন