“একই সংসদে বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের অনেকেরই পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সময়ে দায়িত্ব পালনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে নিয়ে এমন অসত্য বক্তব্যের প্রতিবাদ কাউকে করতে দেখিনি। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জাতীয় রাজনীতি রাজনীতিবিদদের উদাসীনতা, উপেক্ষা করা, গুরুত্ব না দেয়া এবং অবহেলা ও মনোযোগের অভাবের পরিচায়ক।”

পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা কৌশলের পুন:বিন্যাস জরুরী

fec-image

শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যেসব এলাকা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেসব এলাকা পুনরায় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। বিজিবি বা পুলিশ থাকার পরও সন্ত্রাসীরা ঐ সকল অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়েছে। ঐসকল পরিত্যাক্ত সেনা ক্যাম্পের অনেকগুলো ইতোমধ্যেই পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা দখল করে নানাভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তারের কাজে ব্যবহার করছে।

আপাতদৃষ্টিতে শান্ত ও স্বস্তির পার্বত্য চট্টগ্রাম হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। একের পর এক আলোচিত ও শীর্ষ খবর হওয়ার মতো ঘটনার জন্ম হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য বাসন্তী চাকমার বক্তব্য, বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপরে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে ৮ জন নিহত এবং কমপক্ষে ২৫ জন আহত হওয়ার ঘটনায, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে গোলাগুলিতে এক উপজাতীয় সন্ত্রাসী নিহত হবার পর ঘটনাস্থল থেকে ৭ টি এসএমজি ও ৪৩৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার, রাজস্থলীতে মগ লিবারেশন পার্টির সাথে স্থানীয় উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের গুলিবিনিময়ে ৭জন নিহত হওয়ার খবর(যদিও ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে হতাহতের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি), সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে বড় ধরনের হামলার হুমকি, জেএসএস ও ইউপিডিএফ(মূল) শীর্ষ নেতার এক সাথে দেশের বাইরে অবস্থান  প্রভৃতি ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন মাঝে মাঝেই জাতীয় গণমাধ্যম এর শীর্ষ সংবাদ’-এ উঠে আসছে। হয়ে উঠছে উত্তপ্ত।

এ সবের প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাস নির্মূলে চিরুণী অভিযান শুরু করেছে। এ অভিযানে এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোট ১৬ টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এরমধ্যে ৮ টি এসএমজি। এছাড়াও একই সময়ে প্রায় সাড়ে চারশত রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে।

তবে এই ঘটনা শুরু হয়েছে ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে দেয়া তিন পার্বত্য জেলা থেকে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন প্রাপ্ত সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমার ভাষণের পর থেকে। এই ভাষণে বাসন্তী চাকমা বলেছেন,

“মাননীয় স্পিকার… আপনার মাধ্যমে আমি এই হাউজে এবং সমগ্র বাংলাদেশকে আমাদের সে সময়ের পরিস্থিতির কথা একটু বলতে চাই। আপনারা জানেন আমাদের বেড়ে উঠা অনেকটা অস্ত্রের ঝনঝনানি জন্য বললাম যতটুকু জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি দেখেছি আমাদের সে সময়ের শান্তিবাহিনী ভাইদেরকে একপর্যায়ে ওনাদের মধ্যে বিভক্তি এসে যায়। সন্তু গ্রুপ এবং প্রীতি গ্রুপ- এই দুই গ্রুপে মধ্যে পড়ে আমাদের অনেক আত্নীয় স্বজন এবং অসহায় জনগণ মৃত্যুবরণ করে।….

১৯৮৬ সাল পহেলা মে পানছড়িতে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল মাননীয় স্পীকার আপনার মাধ্যমে আমি জানাচ্ছি সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা, যেদিনগুলোতে আমি সেদিন ছিল শুক্রবার বিকাল টাইম। আমাদের যে তখনকার সময়ে বহিরাগত ছিল এবং আমি কাউকে ছোট করে বলছিনা তখন আর্মিরা মিলে আমাদেরকে দুই তিন গ্রামবাসী জড়ো করে একটা ব্রীজের উপর আমাদের পশ্চিম দিকে এভাবে মাথা নত করে থাকতে হয়েছিল একপর্যায়ে পানছড়ি বাজার থেকে ওখানকার বহিরাগত যারা ছিল তারা এবং আর্মিরা মিলে আল্লাহ আকবর করতে করতে একজন একজন করে জবাই দিতে আসতেছিল সেটা ছিল ১৯৯৬ সালের পহেলা মে শুক্রবার।

…. মাননীয় স্পীকার…. একপর্যায়ে আমাদেরকে চুরি করে বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়াতে যেতে হয়েছিল। একদিকে ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল, অন্যদিকে তখনকার সময়ে আর্মিদের প্রেশার ছিল। তো একপর্যায়ে বর্ডার চুরি করে গিয়ে শরণার্থী হিসেবে আড়াই কি তিনমাস আমাকে থাকতে হয়েছিল। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। আমি যতটুকু বই পড়ে এবং আত্নীয় স্বজনের কাছ থেকে টিভিতে দেখে যেটুকু জেনেছি, আমার কাছে মনে হয়েছিল, না জানি মুক্তিযুদ্ধ কি এটাই ছিল? এইরকমই ছিল বোধহয়!….

তার এই বক্তব্যের পরপরই পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি সংগঠনগুলো বাসন্তী চাকমার পদত্যাগের দাবিতে এবং এহেন বক্তব্যের প্রতিবাদে তিন পার্বত্য জেলায় মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও স্মারকলিপি প্রদান কুশপুত্তলিকা দাহ এবং বাসন্তী চাকমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে।

বাসন্তী তার বক্তব্য মোটা দাগে মোটা দাগে ৪টি ভুল তথ্য তুলে ধরেছেন বলে বাঙালীদের অভিযোগ।

♦ প্রথমতঃ তিনি শান্তিবাহিনী শান্তিবাহিনীকে ভাই হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

♦ দ্বিতীয়তঃ-  তার বক্তব্যে  সেনাবাহিনী সম্পর্কে যে অভিযোগ করা হয়েছে তাতে সেনাবাহিনীকে একটি ‘খুনি’, ‘সাম্প্রদায়িক’ ও ‘জঙ্গি বাহিনী’ হিসেবে আখ্যা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

♦ তৃতীয়তঃ তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রত্যাবাসিত বাঙালিদেরকে সেটেলার বলে আখ্যা দিয়েছেন, যাতে বাঙ্গালী প্রবল আপত্তি।

♦ চতুর্থত- তিনি শান্তিবাহিনীর বাংলাদেশ বিরোধী সংগ্রামকে মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন।

এই চারটি অভিযোগই অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এবং সংহতি বিরোধী। বাঙ্গালী সংগঠনগুলোর দাবি বাসন্তী চাকমা তার বক্তব্যে যে সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন ওই দিন পার্বত্য চট্টগ্রামে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাসন্তী চাকমা কেন এই বক্তব্য দিলেন?

বাসন্তী চাকমার আগে জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা, উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, পাহাড়ি ও শান্তিবাহিনীর সাবেক নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে কোথাও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সম্পর্কে এ ধরনের অভিযোগ করা হয়নি। শুধু তাই নয় জাতীয় সংসদে শান্তিবাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার তথা সামরিক শাখার প্রধান দুই ব্যক্তি যথাক্রমে মনি স্বপন দেওয়ান ওরফে মেজর রাজেশ এবং উষাতন তালুকদার ওরফে মেজর মলয় জাতীয় সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু তারাও কখনো জাতীয় সংসদে এ ধরনের অভিযোগ করেনি। কাজেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাসন্তি চাকমা কেন এ ধরনের অভিযোগ করলেন? এমনকি জাতীয় সংসদে তার এই বক্তব্যের পর পার্বত্য বাঙালি সংগঠনগুলো প্রবল প্রতিবাদ করলেও তিনি তার বক্তব্যে অনড় রয়েছেন অথবা তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান প্রত্যাহার করে নেন নি।

দেশবাসীর অবাক হওয়ার বিষয় হলো, বাসন্তী চাকমা যে সংসদে দাঁড়িয়ে এই বক্তব্য রেখেছেন সেই সংসদে যে সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন পার্লামেন্টারিয়ান। বাসন্তী চাকমার এই বক্তব্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে তা সম্পর্কে না বোঝার মত অনভিজ্ঞ কেউ ছিলেন না। তারপরও সেদিন বাসন্তী চাকমার বক্তব্যে হাউজে কেউই কোনো প্রতিবাদ করেননি।

এমনকি একই সংসদে বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের অনেকেরই পার্বত্য চট্টগ্রামে সে সময়ে দায়িত্ব পালনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকেও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে নিয়ে এমন অসত্য বক্তব্যের প্রতিবাদ কাউকে করতে দেখিনি। এটা পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জাতীয় রাজনীতি রাজনীতিবিদদের উদাসীনতা, উপেক্ষা করা, গুরুত্ব না দেয়া এবং অবহেলা ও মনোযোগের অভাবের পরিচায়ক।

কেননা, আমরা দেখতে পেলাম জাতীয় সংসদের একই অধিবেশনেই ওয়ার্কাস পার্টির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ নেতা আল্লামা শফীকে নিয়ে কিছু আপত্তিকর বক্তব্য রাখেন। তার এই বক্তব্যের দুই দিন পরেই মহাজোটের শরিকদলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের সমালোচনা করেন এবং তার বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। সেই প্রেক্ষিতে সংসদের স্পিকার জনাব রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের আপত্তিকর অংশ প্রত্যাহার করে নেন।

একইভাবে বাসন্তী চাকমার বক্তব্যের বিতর্কিত অংশও জাতীয় সংসদের কার্যবিধি থেকে প্রত্যাহার করা যেত। কিন্তু অধিবেশন শেষ হয়ে গেলেও জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণীর রেকর্ড বইতে বাসন্তী চাকমার বক্তব্য রয়ে গেছে।

আমরা জানি, জাতীয় সংসদ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ফোরাম। এখানে দেয়া বক্তব্য জাতীয়ভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বিভিন্ন পর্যায়ে অত্যন্ত সুনামের সাথে কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে দেশের মধ্যেই এহেন বক্তব্য আন্তর্জাতিকভাবে সুনামের সাথে কাজ করা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ও মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা, রিপোর্ট ও ফোরামে তার এই বক্তব্য রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।

একইসাথে শান্তি বাহিনীর রাষ্ট্রবিরোধী সশস্ত্র লড়াইকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনা করে বাসন্তী চাকমা সুস্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছেন। সে কারণে আমরা মনে করি বাসন্তী চাকমার বক্তব্যের বিতর্কিত অংশ অনতিবিলম্বে সংসদের বর্তমান অধিবেশনেই সংসদের কার্যতালিকা থেকে প্রত্যাহার করা জরুরি।

এদিকে গত ১৮ মার্চ ৫ম উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষে রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক থেকে ফেরার পথে নয়কিলো নামক স্থানে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের আকষ্মিক এমবুশে পড়ে নির্বাচনী কর্মকর্তাবহনকারী গাড়ী বহর। সন্ধ্যার অন্ধকারে দুপাশের পাহাড় থেকে আসা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণের কোনো প্রতিরোধ গড়ার সুযোগ পায়নি সঙ্গে থাকা পুলিশ- বিজিবির প্রটেকশন টিম। এ ঘটনায় ৮জন নিহত ও কমপক্ষে ২৫ জন আহত হয়েছিল। শান্তিচুক্তির পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ হামলায় সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এ ঘটনার পর গত ৪ এপ্রিল ২০১৯ বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় যৌথবাহিনীর সাথে সন্ত্রাসীদের গুলিবিনিময়ে জয় শঙ্ক চাকমা নামে এক উপজাতীয় সন্ত্রাসী নিহত হয়।

র‌্যাব ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে ৭টি সাব মেশিনগান ও ৪৩৭ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে। একইদিনে রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলায় দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গুলি বিনিময়ে ৭ জন নিহত হবার খবর প্রচারিত হলেও পুলিশ ঘটনাস্থল তল্লাশি করে কোনো লাশ খুঁজে পায়নি। এরমধ্যেই খবর বেরিয়েছে দেশে ছেড়েছেন জেএসএস প্রধান সন্তু লারমা এবং ইউপিডিএফ প্রধান প্রসীত বিকাশ খীসা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাহাড়ে বড় ধরণের হামলা হবে। পাহাড়ীদের বিভিন্ন গ্রুপে এ হামলার হুমকি দেয়া হচ্ছে কিছু দিন ধরে। এসব নিয়ে পাহাড়ে নতুন করে শুরু হয়েছে উত্তেজনা, আতঙ্ক ও আশঙ্কা। সাধারণ ও শান্তিপ্রিয় পাহাড়বাসী এখন অজানা আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন।

কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিলো না। কারণ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় জেএসএস নেতা সন্তু লারমার সাথে শান্তিচুক্তি করেন। কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির অন্বেষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে হাজার হাজার পার্বত্যবাসীর খুনি সন্তু লারমা ও তার দলের সহস্রাধিক সশস্ত্র সদস্যের বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় এবং ২০ দফা প্যাকেজের আওতায় তাদেরকে পুনর্বাসন করে। অপরপক্ষে সন্তু লারমার পক্ষে কর্তব্য ছিলো, অবৈধ অস্ত্র জমা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা এবং দেশের আনুগত্য করা। কিন্তু গত ২০১১ সালের ২৫ নভেম্বর ইন্ডিডেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক শামিমা বিনতে রহমানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সন্তু লরমা সকল অস্ত্র জমা দেয়ার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামের এই অশান্ত ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় গণমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। অধিকাংশ আলোচক ও বুদ্ধিজীবীদের মত, শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িতা না হওয়ার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শান্তিচুক্তি শতভাগ বাস্তবায়িত হলে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তাদের সাথে আমি আংশিক একমত। কেননা, আমিও মনে করি শান্তিচুক্তি  পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হলে পার্বত্য সমস্যার সমাধানে উন্নতি হবে। তবে সম্পূর্ণ সমাধান হয়ে যাবে এ  দাবীর সাথে কোনোভাবেই একমত নই। কিন্তু শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বাঁধা কোথায়? কেন সরকার দীর্ঘ দিনেও এ চুক্তি বাস্তবায়নে সক্ষম হয়নি। (এ বিষয়ে বিস্তারিত পড়তে লেখকের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দুই দশক: পুনর্মূল্যায়ন জরুরি’, http://parbattanews.com, প্রকাশ , ২৮ নভেম্বর ২০১৮ দ্রষ্টব্য) লেখাটি পড়তে পারেন।)

এতো গেলো একটা দিকের কথা। অন্যদিকে শান্তিচুক্তি হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে। বাস্তবায়নও দুইপক্ষকেই করতে হবে। একপক্ষ সরকার। শান্তিচুক্তি ৪ খন্ডে বিভক্ত। ক খন্ডে ৪টি, খ খন্ডে ৩৫টি, গ খন্ডে ১৪টি, এবং ঘ খন্ডে ১৯টি মিলে সর্বমোট ৭২টি ধারা রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর তাঁর কার্যালয়ে নিবন্ধ লেখককে দেয়া এক স্বাক্ষাৎকারে বলেন, ক খন্ডের ১, ২, ৩, ৪ ধারা; খ খন্ডের ১, ২, ৩, ৫, ৬, ৭, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৫, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ও ৩৩ ধারা; গ খন্ডের ১, ৭, ৮, ৯, ১০, ১২, ১৪ ধারা এবং ঘ খন্ডের ১, ৫, ৮, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৯ ধারা মিলে মোট ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হয়েছে। খ খন্ডের ৪(ঘ), ৯, ১৯, ২৪, ২৭, ৩৪; গ খন্ডের ২, ৩, ৪, ৪, ৫, ৬ এবং ঘ খন্ডের ৪, ১৬, ১৭, ১৮ নম্বর মিলে মোট ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। খ খন্ডের ২৬, ২৯, ৩৫; গ খন্ডের ১১, ১৩ এবং ঘ খন্ডের ২, ৩, ৭, ৯ নম্বর ধারা মিলে মোট ৯টি ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তবে জেএসএস সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমা সরকারের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার মতে, সরকার শান্তিচুক্তির মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন করেছে। এছাড়াও ১৩টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করেছে এবং ৩৪টি ধারা অবাস্তবায়িত রয়েগেছে।

পার্বত্য চুক্তির অপরপক্ষ জেএসএস নেতা সন্তু লারমা। যার প্রতি একমাত্র শর্ত ছিলো, তিনি তার বাহিনীকে অর্থাৎ শান্তিবাহিনীকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করে, অস্ত্র জমা দিয়ে, বাহিনী ভেঙে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন। কিন্তু সন্তু লারমা কি সে কথা রেখেছেন? তিনি কি শান্তিচুক্তির শর্ত বাস্তবায়ন করেছেন? তিনি কি তার দলের সবাইকে নিয়ে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন? তিনি কি শান্তিবাহিনী ভেঙে দিয়ে এর সকল সদস্যকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরত নিয়ে এসেছিলেন? তারা কি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন?  আমরা সকলেই জানি, শান্তিচুক্তির শুরুতেই শান্তিবাহিনীর একটি অংশ সন্তু লারমার বিরোধিতা করে, অস্ত্র সমর্পন না করে শান্তিবাহিনীকে ভাগ করে ফেলে যা পরবর্তীতে ইউপিডিএফ নামে আত্মপ্রকাশ করে। অভিযোগ রয়েছে, সন্তু লারমা নিজেও সরকারের সদিচ্ছার প্রতি পূর্ণ আস্থা স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়ে নিজ সমর্থক শান্তিবাহিনীর একাংশকে জঙ্গলেই অপেক্ষাকৃত ভারী ও আধুনিক অস্ত্রসহ রেখে আসেন। অর্থাৎ শুরুতেই শান্তিবাহিনীর দুইটি অংশ অস্ত্র সমপর্ণ করেনি বা সন্তু লারমা অস্ত্র সমর্পন করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর ১৯৯৮ সালে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন শান্তিবাহিনী চার দফায় আত্মসমর্পন করে। এরমধ্যে

♦  ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ তারিখে ৭৩৯জন আত্মসমর্পন করেন সমর্পন করেন। তাদের সমর্পনকৃত অস্ত্রের মধ্যে ১৪টি টি-৫৬ রাইফেল, এসএমজি টি-৫৬ ১২টি, এলএমজি ৭টি, জি থ্রি রাইফেল ১৩১টি, এসএমসি ৩১টি, ৩০৩ ব্রেন এলএমজি ১৪টি, মোর টি-৬৩ ৩টি, মোর(ব্রিটিশ) ৪টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৮১টি, পিস্তল/রিভলভার ৫টি, সিএম স্ট্যান্ড ২৪টি, ২ মোর ১টি, ৪০ এমএম আরএল ১টি, পাইপ গান ২৬টি, এসএলআর ৮৩, স্মল ব্রোক রাইফেল  ১টি। মোট ৪৩৮টি।

♦ ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ তারিখে বাঘাইহাট স্কুলে ৫৪২জন, তাদের জমা দেয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে টি-৫৬ রাইফেল ১৩টি, এসএমজি টি-৫৬ ৯টি, এলএমজি ৬টি, জি থ্রি রাইফেল ৩২টি, এসএমসি ১৪টি, মোর টি-৬৩ ১টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ১০০টি, পিস্তল/রিভলভার ৪টি, পাইপ গান ৪টি, এসএলআর ৩৬। মোট ২১৯টি।

♦ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ তারিখে বাঘাইছড়ির বরাদম স্কুলে ৪৪৩ জন অস্ত্র সমর্পন করেন।  এরমধ্যে এসএমজি টি-৫৬ ২টি, জি থ্রি রাইফেল ২টি, এসএমসি ১৫টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৩০টি, এসএলআর ১১টি। মোট ৬০টি।

♦ ৫ মার্চ ১৯৯৮ তারিখে পানছড়ির দুদুকছড়িতে ২২২ জন শান্তি বাহিনীর সদস্য অস্ত্র সমর্পন করেন।  এরমধ্যে টি-৫৬ রাইফেল ৯টি, এসএমজি টি-৫৬ ৬টি, জি থ্রি রাইফেল ৯টি, এসএমসি ১টি, থ্রি নট থ্রি রাইফেল ৩টি, এসএলআর ৩। মোট ৪৪টি। সর্বমোট ১৯৪৬ জন ৭৬১টি অস্ত্র জমা দিয়ে আত্ম সমর্পন করেন।

এরপর দীর্ঘ বাইশ বছর পার হয়েছে। পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সন্তু লারমা নিজে কী করেছেন এসময়ে? এ প্রশ্নের উত্তরে তৃতীয় কোনো সূত্রের তথ্য ব্যবহার না করে আমরা সরাসরি সন্তু লারমার কাছে যেতে চাই।

২০১১ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের সাংবাদিক শামিমা বিনতে রহমানকে শান্তিচুক্তির পর আবার কবে অস্ত্র তুলে নিলেন- এ প্রশ্নের জবাবে জেএসএস প্রধান বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে। ওটা আমরা সীমিত রেখেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি যে না, সরকার কিছু করছে না। এদের দিয়ে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। ইউপিডিএফসহ যারা এদের সাথে যুক্ত আছে তাদের সাথে লড়াইটা চলছে’। শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র সংখ্যা কতো জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা অনেক আছে, বেশ কয়েকশত আছে’। সন্তু লারমা কয়েক শতের কথা স্বীকার করলেও পাহাড় সংশ্লিষ্টরা জানেন, এ সংখ্যা কয়েক হাজার।

পাহাড়ে এখন আঞ্চলিক সশস্ত্র দলের সংখ্যা চারটি। এই চারটি দলের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উপদলীয় সংঘাত, চাঁদাবাজী, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ প্রভৃতি নানা অপরাধমূলক কর্মে শান্তির পাহাড় আজ নৈরাজ্যের নরকপুরীতে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমে একে মৃত্যু উপত্যকা বলেও আখ্যা দিতে দেখা যায়। শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষরকারী হিসেবে যার একমাত্র দায়িত্ব ছিলো নিজ দলের স্বশস্ত্র কর্মীদের আত্মসমর্পন করিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা, আজ তার দলের লোকেরাই সরকারী দায়িত্ব পালনকারীদের এম্বুশ করে নির্বিচারে হত্যা করছে।

১৮ মার্চের বাঘাইছড়ি হত্যাকাণ্ডের পর গঠিত সরকারী তদন্ত কমিটিও তাদের রিপোর্টে এ হামলার জন্য সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসকেই দায়ী করেছে। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এসএম মতিউর রহমান যৌক্তিকভাবেই বলেছেন, ‘আঞ্চলিক দলের সন্ত্রাসীরা সরকারের কর্মচারীদের উপর হামলা করে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে মনে করি তারা এই চুক্তি ভঙ্গ করেছে’। এ হামলার পর বাঘাইছড়িতে স্থানীয় জনগণের সাথে এক মতবিনিময় সভায় জেনারেল মতিউর আরো বলেন, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য এলাকা থেকে ২৪০টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছিল। ক্যাম্প প্রত্যাহারের অর্থ এই যে, আমাদের সাথে এই এলাকার দূর্বৃত্তদের সাথে আর যুদ্ধ নেই। তাই চুক্তির মাধ্যমে আমাদের ক্যাম্প ক্লোজড করলাম। এখন যদি এই সকল দূর্বৃত্ত আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করে তাহলে কিন্তু একঅর্থে এই শান্তিচুক্তির আর কোন কার্যকারিতা থাকে না।’

আমরা মনে করি জেনারেল মতিউর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার উৎস চিহ্নিত করেছেন তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে। সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে অনেক সরকারী কর্মকর্তাই সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে চান না। কিন্তু জেনারেল মতিউর সেই দলে পড়েন না। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের একটা দাবী যে সকল জায়গা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেখানে সেনা ক্যাম্প পুনঃস্থাপন করা, এই হামলার ফলে সেটা বাংলাদেশ সরকারের পুনঃ বিবেচনার একটা সুযোগ হবে।’

সাধারণত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের কথা উঠলেই পাহাড়ী আঞ্চলিক দলের নেতৃবৃন্দ, তাদের সমর্থক বুদ্ধিজীবীবৃন্দ বলে থাকেন পাহাড় থেকে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের শর্তানুযায়ী এ পর্যন্ত পাহাড় থেকে একটি ব্রিগেডসহ ২৪০ টি বিভিন্ন ধরনের সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারপরও সন্তু লারমা ও তার সহযোগী দলসমূহ এবং সমর্থক বুদ্ধিজীবীবৃন্দের ক্রমাগত দাবী শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী পাহাড়ে ৬ টি স্থায়ী সেনাক্যাম্পের বাইরে পাহাড়ে আর কোনো সেনা ক্যাম্প থাকতে পারবে না। প্রশ্ন হলো- শান্তিচুক্তিতে কি সত্যিই এমন কথা বলা হয়েছে? সে বিচারে যাবার আগে শান্তিচুক্তির এ সংক্রান্ত ধারা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডের ১৭(ক) ধারায় বলা হয়েছে, “সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলীকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হইবে। আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন”।

এখানে বিভ্রান্তি সৃষ্টির কারণ হচ্ছে, শান্তিচুক্তিতে ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেই সেনানিবাসগুলোর ফর্মেশনের কথা শান্তিচুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা নেই। এই ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস কিরূপে সেখানে অবস্থান করবে- ডিভিশন আকারে, ব্রিগেড আকারে না ব্যাটালিয়ন আকারে তা সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই। এই অপশনটি রাষ্ট্রের হাতে রয়ে গেছে। রাষ্ট্র প্রয়োজন মতো তা ব্যবহার করতে পারবে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন জেলা সদরে তিনটি ব্রিগ্রেড রয়েছে। এর বাইরে খাগড়াছড়ির গুইমারায় আরেকটি ব্রিগ্রেড রয়েছে। কাপ্তাই ব্রিগ্রেডটি প্রত্যাহার করা হয়েছে। শান্তিচুক্তির শর্ত পালনে গুইমারা ব্রিগ্রেড দিঘীনালায় সরিয়ে নিলেও আলীকদম ও রুমাতে দুইটি নতুন ব্রিগ্রেড প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। তবে শান্তিচুক্তির মধ্যেই সমাধান খুঁজলে এ চুক্তির ঘ খণ্ডের ১৭(ক) ধারা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।

এই ধারায় যেমন স্থায়ী সেনানিবাসের প্রকৃতি ব্যাখ্যা করা হয়নি। তেমনি অস্থায়ী সেনানিবাসের সংজ্ঞাও দেয়া নেই। অর্থাৎ অস্থায়ী সেনানিবাস বলতে ব্রিগেড, ব্যাটালিয়ন/জোন, সাবজোন, কোম্পানী স্থাপনা নাকি সেনা আউট পোস্ট বোঝানো হবে তার কিছুই চুক্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এই ব্যাখ্যাটাও রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে এবং রাষ্ট্র চাইলে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ৪টি ব্রিগেডের মধ্যে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান ব্রিগেডে ৫ ব্যাটালিয়ন করে সৈন্য রয়েছে, গুইমারায় রয়েছে ৩ ব্যাটালিয়ন। সব মিলিয়ে ১৮ ব্যাটালিয়ন সৈন্য রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। একটি ব্যাটালিয়নে গড়ে ৭০০ করে সৈন্য ধরলে ১৮টি ব্যাটালিয়নে ১২-১৩ হাজার সৈন্য রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ফর্মেশন অনুযায়ী ৩-৫টি ব্যাটিলিয়ন নিয়ে একটি ব্রিগেড গঠিত হয়। কাজেই পার্বত্য চট্টগ্রামে ৬ টি ব্রিগেড থাকলে সেখানে ১৮-৩০ ব্যাটালিয়ন সৈন্য থাকতেই হবে। ব্যাটালিয়নগুলো আবার গড়ে ওঠে কতকগুলো সাবজোনের সমষ্টিতে। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এই জোন, সাবজোনগুলো কোথায়, কিভাবে অবস্থান করবে? শান্তিচুক্তিতে এ বিষয়ে পরিস্কার করে কিছু বলা নেই।

শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডের ১৭(ক) ধারায় আরো বলা হয়েছে, ‘আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে’।

উল্লিখিত বাক্যটি বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে বা জাতীয় অন্যান্য দরকারে রাষ্ট্র প্রয়োজনানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে যেখানে প্রয়োজন যে কোনো ফর্মেশনে সেনাবাহিনী রাখতে পারবে। এ ক্ষেত্রে ৪টি ব্রিগেড বা ৬টি স্থায়ী সেনানিবাস বিবেচ্য নয়- রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন বিবেচ্য। আরো বিবেচ্য যে, এক্ষেত্রে নির্ধারিত কোনো সময়সীমাও রাখা হয়নি।

একই ধারায় আরো গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলা হয়েছে তাহলো শান্তিচুক্তিতে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার শর্ত বাস্তবায়িত হতে হবে ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে’’..। অর্থাৎ চুক্তিতে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার ও সেনাবাহিনী ফিরিয়ে আনার বিষয়টি শর্তহীন নয়। বরং এর সাথে ‘জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার’ শর্ত যুক্ত রয়েছে। অর্থাৎ জনসংহতি সমিতির সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেই কেবল সেনাবাহিনী ফেরত আনার বিষয়টি বিবেচ্য হবে।

সন্তু লারমার ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে দেয়া বক্তব্য ও ১৮ মার্চ বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপর হামলার পর একথা নিশ্চিত করে বলা যায়, জেএসএসের মূলের সামরিক শাখাও সম্পূর্ণরূপে অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেনি। বরং বর্তমানে চারটি পাহাড়ী সংগঠন প্রকাশ্য ও গুপ্ত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পাহাড়ে প্রকাশ্য ও গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গুপ্ত বা গোপন শাখা আসলে তাদের সশস্ত্র সামরিক শাখা। যদিও প্রকাশ্যে তারা কখনই এই সামরিক শাখার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে না। প্রকৃতপক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম বর্তমানে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে। চাঁদা ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ নাগরিক তো দূরে থাক, সরকারী কর্মকর্তাদেরও বসবাস অসম্ভব। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি পাহাড়ী সংগঠনের নির্ধারিত চাঁদা দিতে না পারলে সেখানে বসবাস যে কারো জন্যই অসম্ভব। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে সাধারণ ও শান্তিপ্রিয় পাহাড়ীদের জিম্মি করে তাদের নির্দেশিত পথে পরিচালিত করতে বাধ্য করে।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী ১৬০৯ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে গ্রেনেড ৩৫৯টি, মর্টার ৭০টি, মাইন ১৩টি এবং অন্যান্য গোলাবারুদ সাড়ে ৪ লক্ষ। এই পরিসংখ্যানে আরো দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পরে ২০০৫ সাল থেকে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ২৬৩০টি অস্ত্র ও ১৮৪৫৬৯টি গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।

শান্তিচুক্তির পূর্বে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক ২৩৮ জন উপজাতি, ১০৫৭ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ১৭৮ জন উপজাতি ও ৬৮৭ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ২৭৪ জন উপজাতি ও ৪৬১ জন বাঙালি।

একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শান্তিচুক্তির পরে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত শান্তিবাহিনী কর্তৃক ৪৪১ জন উপজাতি,২৭১ জন বাঙালি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬৭২ জন উপজাতি ও ৮২৮ জন বাঙালি। অপহরণের শিকার হয়েছে ৯৯১ জন উপজাতি ও ৪২০ জন বাঙালি।

এমতাবস্থায় শান্তিচুক্তিতে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষে সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার সম্ভব হয়নি (আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও কৌশলগত ঝুঁকির কথা এখানে বিবেচিত হয়নি)। তবু শান্তিচুক্তির ২১ বছরে সরকার একটি ব্রিগ্রেডসহ ২৪০টি নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে। দেখা গেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর যেসকল ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, ওই সকল এলাকা উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্পগুলোর অনেকগুলো বিভিন্ন নামে সন্ত্রাসীরা দখল করেছে। ফলে স্থানীয় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে পুনরায় নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানানো হয়েছে।

শুধু তাই নয়, শান্তিচুক্তির শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া’ সরকার ও জনসংহতি সমিতি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে কিন্তু জনসংহতি সমিতির পক্ষে স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমা টানা ২২ বছর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগ করলেও আজো বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়পত্র গ্রহণ করেন নি। এমনকি তিনি ২৬ মার্চ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবসের মতো জাতীয় দিবসগুলো পালন করেন না। অর্থাৎ চুক্তিতে সাক্ষর করলেও সন্তু লারমার বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য  সন্দেহাতীত নয়।

এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন, পাশ্চাত্যের ক্রিশ্চিয়ান বাফার স্টেট বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র, বাংলাদেশ ভারত আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস ও উভয় রাষ্ট্র বিরোধীদের তৎপরতা, আন্তঃসম্পর্ক, অনিষ্পন্ন সীমানা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সংলগ্ন কক্সবাজারে ১১ লাখ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অবস্থান এবং রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সন্নিহিত পার্বত্য চট্টগ্রামের অবস্থানগত কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি বর্তমানে নাজুক অবস্থায় রয়েছে।

এরূপ পরিস্থিতিতে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী বাধ্যতামূলক বা বিবেচ্য নয়। বরং শান্তিচুক্তির শর্তানুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের যেখানে যেমন প্রয়োজন সেনাবাহিনী মোতায়েন করা জরুরী। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলা যায়, শান্তিচুক্তির ঘ খণ্ডের ১৭(ক) ধারা বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা মোতায়েন ও সেনাক্যাম্প স্থাপন জরুরী। এটা শান্তিচুক্তিরই অংশ। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন চাইলে এটাও মানতে হবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী স্বেচ্ছায় বা স্বাগ্রহে যায়নি। কোনো প্লেজারিজমের উদ্দেশ্যেও যায়নি। সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অপরিহার্য প্রয়োজনে। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে পোস্টিংকে পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী গিয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে সরকারী নির্দেশে। সেখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া, ভূপ্রকৃতি, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন সমতলের মানুষের জন্য অনুকুল নয়। সাপ, মশা, জোক হিংস্র বন্যপ্রাণী, দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রতিকুল পরিবেশ, বৈরী ভূপ্রকৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের সাথে মোকাবেলা করে এবং পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের হুমকি ও অপতৎপরতার মুখে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অটুট রেখেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকের অনেকে এ কথা বহুবার বলেছেন যে, সেনাবাহিনী না থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রাম বহু আগেই বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৫৯ জন সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪৩০ জন এবং অন্যভাবে ২২৭ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একই পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তির পূর্বে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৪৩ জন সদস্য নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৭৩, বিজিবি ৯৬, পুলিশ ৬৪, আনসার ভিডিপির ১০ জন। নিহত সেনা সদস্যদের মধ্যে অফিসার ৫ জন, জেসিও ৩ জন, বাকিরা সৈনিক।

এছাড়াও দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনা, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন রোগ, ভূমিধস প্রভৃতি কারণে মারা গেছে আরো অনেকে। এর মধ্যে শান্তিচুক্তির পূর্বে শুধু ম্যালেরিয়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১৬০ জন এবং পরে ৮১ জন মারা গেছে। উভয় কারণে আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। তবে শান্তিচুক্তির পরে পার্বত্য চট্টগ্রামে নানা কারণে নিরাপত্তা বাহিনীর মোট ১৬ জন সদস্য মারা গেছে। এর মধ্যে শান্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে মারা গেছে ১১ জন, ৫ জন রাঙামাটির ভূমিধসে। এদের মধ্যে সেনাবাহিনীর ৮ জন, বিজিবি ২ জন,  পুলিশ ২ জন ও আনসার ভিডিপি ৪ জন।

তারপরও সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে রয়ে গেছে দেশের স্বার্থে। কিন্তু এদেশে পাহাড়ী সশস্ত্র সংগঠনগুলোর সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমগুলোতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অবস্থানকে এমন নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয় যেন, তারাই সকল সঙ্কটের মূল। অথচ অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যেসব এলাকা থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেসব এলাকা পুনরায় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছে। বিজিবি বা পুলিশ থাকার পরও সন্ত্রাসীরা ঐ সকল অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়েছে। ঐসকল পরিত্যাক্ত সেনা ক্যাম্পের অনেকগুলো ইতোমধ্যেই পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা দখল করে নানাভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তারের কাজে ব্যবহার করছে।

উল্লিখিত পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ কথা জোর দিয়ে বলার সময় এসেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পূনর্মূল্যায়ন করে নিরাপত্তা কৌশল নিয়ে পুণর্বিন্যাসের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে যেসকল নিরাপত্তা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরী। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব সেনা নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল সেগুলো ইচ্ছেমতো করা হয়নি। এর সাথে যোগাযোগ, জনবসতি, জননিরাপত্তা, কৌশল অবস্থানগত, সন্ত্রাসীদের তৎপরতা প্রভৃতি বিবেচনা করেই একটি নিরাপত্তা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এখন সেগুলো থেকে সেনা/বিজিবি প্রত্যাহারের ফলে এদিকে যেমন ওই এলাকায় নুতন করে নিরাপত্তা সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে ওই সকল ক্যাম্প সন্ত্রাসীরা দখল করে অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার ও নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণের কাজে ব্যবহার করছে।

কাজেই অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারকৃত সেনাক্যাম্পের স্থান সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনানুযায়ী এসব ক্যাম্পের স্থানে সেনা অবস্থান/সেনা টহল নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে যোগাযোগ, অবকাঠামো ও পর্যটন উন্নয়নের কারণে যেসব স্থানে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে সেসব স্থানে প্রয়োজনানুযায়ী সেনা ক্যাম্প স্থাপন ও সেনা টহল বৃদ্ধি করতে হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু, এবং বাংলাদেশে সীমান্তে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমার আর্মির নিয়মিত সংঘর্ষ পরিস্থিতি বিবেচনা এবং মাদক, অস্ত্র পাচার ও সম্ভাব্য জঙ্গী তৎপরতা বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বিন্যাসে পুর্নমূল্যায়ন অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে।

 লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ ডটকম, পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ ও চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন


পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বিষয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন