আতঙ্কের রাজবিলা-কুহালংয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চায় আ’লীগ
বান্দরবান জেলা সদর থেকে মাত্র ২০কি.মি দূরে রাজবিলা এবং ৮কি.মি দূরে কুহালং ইউনিয়ন। গত দুই বছর যাবত এ দুটি এলাকা গুম-খুনের জনপদে পরিণত হয়। সন্ত্রাসীদের টার্গেটে পড়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের লোকজন। এই সময়ের মধ্যে দলটির একাধিক নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। যার কারণে এসব এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন।
দীর্ঘদিন পর হলেও সেই রাজবিলা ও কুহালং ইউনিয়নে অবশেষে বর্ধিত সভা করে নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার আয়োজন করেছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ। মঙ্গলবার (২০অক্টোবর) সকালে পৃথক অনুষ্ঠিত বৈঠকে আগামী ইউনিয়ন কমিটি এবং আসন্ন নির্বাচনসহ সমসাময়িক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা একেএম জাহাঙ্গীর, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি পাইহ্লা অং মারমা, সহ সভাপতি রাজু মং মারমা, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক সার্চ প্রু মারমা (সাবু), রাজবিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ক্যসিং শৈ মারমা, সাধারণ সম্পাদক মংনু মারমাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে থাকা উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পার্বত্যনিউজকে জানান, আতঙ্ক নিয়েই তারা বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। এবারও তাদের নেতাকর্মীদের সভায় আসতে বাঁধা দিয়েছে পাহাড়ের সন্ত্রাসীরা।
জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে গুম-খুনের মধ্যে আতঙ্কে দিন কাটছে রাজবিলা ও কুহালং এলাকার মানুষের। বিশেষ করে প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আতঙ্কে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। আধিপত্য ও স্বতন্ত্র রাজনৈতিক বলয় সৃষ্টির লক্ষ্যে জেএসএস এসব অপকর্মের নেপথ্যে রয়েছে এমনটি দাবি করেছেন উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ। হত্যাকারীরা এলাকার প্রভাবশালী না হলেও ভাড়াটিয়া হওয়ায় গোপনে তারা হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতে অংশ নিতে গেলেই প্রাণ হারিয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী।
এই প্রসঙ্গে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান ক্যসিং শৈ মারমা বলেন- বর্ধিত সভায় সমসাময়িক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে রাজবিলায় ক্ষমতাসীন দলের প্রাণ হারানো নেতাকর্মীদের তথ্য জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। তাঁর মত অন্যান্য নেতাকর্মীরা বৈঠকে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দিলেও ‘নিরাপত্তার অভাব’ এর কারণে গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
জানতে চাইলে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি পাইহ্লা অং মারমা জানান, আসন্ন ইউপি নির্বাচন এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলের জন্য বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিটির নেতাকর্মীদের সাথে তিনি যোগাযোগ করছেন। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া নেতাকর্মীদের সংগঠিত এবং শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছেন। বৈঠকে সাম্প্রতিক সময়ে খুন হওয়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের এপ্রিল থেকে মগ পার্টি নামে একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর উত্থানের পর বান্দরবানে মূলধারার জেএসএসের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। তাদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে মারা গেছে অসংখ্য নিরীহ মানুষ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থক, জেএসএসের ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের কর্মী-সমর্থক।
সর্বশেষ ১৫অক্টোবর জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুনপাড়ায় সাবেক ইউপি মেম্বার সাউ প্রু মারমা নামে একজনকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এর আগে ১০ অক্টোবর সদর উপজেলার জামছড়ি বাজারে বাচমং মারমা নামে এক জেএসএস কর্মীকে নিজ দোকানে ঢুকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। ১ সেপ্টেম্বর রাজবিলা ইউনিয়নের চিউংকিউ পাড়ায় ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে যুবলীগ নেতা ম চ উ মারমাকে। ২ সেপ্টেম্বর রোয়াংছড়ি উপজেলার নতুন পাড়া এলাকায় জেএসএস কর্মী উথোয়াই মারমাকে অপহরণ করা হয়।
গত ৭ জুলাই বান্দরবান শহরের নিকটে বাঘমারায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওইদিন ব্রাশফায়ারে ছয় উপজাতি খুন হওয়ার পর শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
ইতোপূর্বে গত কয়েক বছর অপহরণ ও খুনের প্রবণতা দেখা গেলেও সিক্স মার্ডারের মিশনটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পাঁচদিন পর (১৩জুলাই) মামলার এজাহারভুক্ত আসামিসহ ২ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা হচ্ছেন কুহালং ইউনিয়নের উজিপাড়ার বাসিন্দা এজাহারভুক্ত দুই নাম্বার আসামি অংপ্রু মারমা (৪০) এবং অজ্ঞাতনামা আসামি সুশান্ত চাকমা (৩২)।
এই ঘটনার আগে ২ জুলাই সদর ইউনিয়নের হেব্রন পাড়া থেকে মোটর সাইকেলের গতিরোধ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক লুলাথাং বম (৩০)কে ধরে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এখনো তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৫ জুলাই কুহালং ইউনিয়নের রাবার বাগান এলাকা থেকে একইভাবে অপহৃত হন গুংগা জলি ত্রিপুরা (৪১)। তার সন্ধানও এখনো মিলেনি। স্থানীয়দের মতে, অপহরণকারী সন্ত্রাসীরাই সিক্স মার্ডার ঘটনার সাথে জড়িত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বান্দরবানে হানাহানি এবং সশস্ত্র সংঘর্ষে হত্যাকাণ্ডে বা মৃুত্যুর মিছিল বেড়েই চলেছে। স্থানীয় দলগুলোর অনেক নেতা মনে করেন, পাহাড়িদের দলগুলো বার বার বিভক্ত হচ্ছে এবং কয়েক বছরে পরিস্থিতির নতুন মেরুকরণ হয়েছে। এমন পরিস্থিতি হয়েছে, এখন আদর্শ বাদ দিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজি মুল বিষয় হয়ে উঠেছে কিনা এই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।