রোহিঙ্গা গণহত্যার ৭ বছর

আরাকান পুনরুদ্ধার ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামতে চায় রোহিঙ্গারা

fec-image

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে আরাকান পুনরুদ্ধার ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নামতে চায় রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা। এতদিন যেটা সম্ভব হয়নি সেটা ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সম্ভব হবে বলে আশা তাদের। এজন্য রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন ও সহযোগিতা চায় ।

রবিবার (২৫ আগস্ট) দুপুরে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে একথা বলেন রোহিঙ্গা শিক্ষার্থী ও নেতারা।

উখিয়ার ক্যাম্প-৪ এর ফুটবল মাঠে বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সমবেত হয়। যাদের সবার মুখে চোখেমুখে হতাশা-উদ্বেগ থাকলেও নিজ ফিরে যাওয়ার আকুতি লক্ষ্য করা গেছে।

৭ বছর পূর্তির এই দিনে ক্যাম্প-৯, ক্যাম্প-১৩ ও টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প ২৭ এ সমাবেশ করেছে স্বদেশহারা এই জনগোষ্ঠী। সমাবেশগুলোতে আরাকানে গণহত্যা বিরোধী নানা স্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে প্রতিবাদমুখর হয় রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা। ন্যার বিচার দাবি করে We Want Justice শ্লোগান ধরে তারা।

৭ বছর পূর্তির এই দিনে সমাবেশে ৫ টি দাবি দিয়েছে রোহিঙ্গারা। দাবিসমূহ হলো:

১. অবিলম্বে আরাকানে রোহিঙ্গাদের উপর সব ধরণের গণহত্যা, সহিংসতা ও হামলা বন্ধ করুন।

২.নাগরিকত্ব সহ মিয়ানমারের সকল বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের দ্রুত প্রত্যাবাসন।

৩. জাতিসংঘ মায়ানমারের অন্যান্য জাতিগত জনগণের সাথে জীবিকা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য কর্মসূচি সমর্থন করেছে।

৪. মিয়ানমার জান্তা এবং আরাকান আর্মি উভয়কেই জাতিসংঘ বা মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে।

৫. আমরা মিয়ানমারে টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলির কাছ থেকে বাস্তব পদক্ষেপ আশা করি। আমরা, রোহিঙ্গারা আমাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। আমরা আশ্রয় শিবিরে এমন রাষ্ট্রহীন ও মানবেতর জীবনযাপন করতে চাই না। এটা মানুষের জীবন নয়।

স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতিতে সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করেছে ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হলে দুনিয়ার কোন শক্তি টিকে থাকতে পারেনা। তেমনিভাবে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে নামলে জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মির পতন হতে বাধ্য।

সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, এফডিএমএন আরসি মেম্বার ছৈয়দ উল্লাহ, রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার কামাল, রহমত উল্লাহ, মাস্টার আবদুর রশিদ, মুহাম্মদ মুসা। আরাকানে জুলুম নির্যাতনের বিচার ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন কামনায় মহান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন মাওলানা আবদুর রহমান।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কামনা করে রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, এদেশে কোন সরকার আসলে বা গেলো সেটা আমাদের মাথা ব্যাথার বিষয় নয়। কিন্তু আমরা চাই এখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকুক। কারণ এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে আমাদের আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে বেগ পেতে হবে।

জান্তা সরকারের নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর ২০১৮ সাল থেকে ২৫ আগস্টকে রোহিঙ্গারা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফেরত যেতে চায়। তবে তার আগে সামরিক জান্তা ও আরাকান আর্মির সঙ্গে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মহলকে আহ্বান জানিয়েছেন।

তারা বলছেন, প্রথম গণহত্যা চালিয়েছে সামরিক জান্তা বাহিনী। দ্বিতীয়বার গণহত্যা চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় দফায় গণহত্যায় তিন হাজারের অধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। পুরো আরাকান এখনো অস্থিতিশীল। এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মহলের কঠোর হস্তক্ষেপ জরুরী।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের যুদ্ধে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকার (সশস্ত্র বাহিনী)। মূলত রাখাইনে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী শূন্য করতে তাদের এই কৌশল। ইতোমধ্যে বহু রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে। অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। এখনও প্রাণে বাচঁতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে বহু রোহিঙ্গা। অনেকে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। ফলে ক্যাম্পেও চাপ অস্থিরতা বাড়ছে। এছাড়া নাফ নদে সাগরে ডুবে মারা যাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার সাত বছর পূর্ণ হলো। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো শুধু ত্রাণ নিয়ে ব্যস্ত। ওপারে প্রতিনিয়ত যে হত্যাযজ্ঞ চলছে তার স্থায়ী সমাধানের কোন চিন্তাধারা তাদের নেই। কূটনৈতিক জটিলতায় আটকে আছে প্রত্যাবাসন। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল মিয়ানমার সরকার। কিন্তু সেই প্রত্যাবাসন আজো শুরু হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে দুই পক্ষই। এতে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে বহু রোহিঙ্গা। আর যারা প্রাণে বেঁচে যাচ্ছেন তারাই নতুন করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছেন। এতে আরও চাপ-বিপদ বাড়ছে বাংলাদেশের।

কক্সবাজারের উখিয়া আর টেকনাফ উপজেলায় এখন ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বাস। দুই উপজেলায় মোট স্থানীয় পাঁচ লাখের মতো। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সেখানে এখন সংখ্যালঘু। অবনতি ঘটছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও। ক্যাম্পে ঘটছে মাদক, হত্যা, অপহরণ ও মানবপাচারসহ নানা অপরাধ। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ ক্যাম্পে রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে। রোহিঙ্গা ঢলের সাত বছর হলেও একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: মিয়ানমার, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন