কল্পনা চাকমা স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান না নিখোঁজ: নাকি আটকে আছে ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে

fec-image

আজ কল্পনা কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণের ২৬ বছর। এ দিনটি আসলে সরব হয়ে উঠে পাহাড়ের কিছু ভুইফোঁড় সংগঠন। মাঠে নামে, সভা সেমিনার করে। নানা অভিযোগ করে দেশের সার্বভৌমত্বের দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। আজও(১২ জুন) এমনটিই করেছে তারা।

পার্বত্য চট্টগ্রামের নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৬ বছর উপলক্ষে সাবেক এক সেনা কর্মকর্তাকে দায়ি করে প্রকাশ্য গণআদালতে বিচারের দাবিতে খাগড়াছড়িতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের অংগ সংগঠন নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন। কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণ ঘটনার মিমাংসার জন্য রাষ্ট্র ডিএনএ পরীক্ষার জন্য চেষ্টা করলে পরিবার রাজি হয়নি। কাজেই এ ঘটনার পিছনে কোন অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছে বলে ধারণা সচেতন মহলের। মূলত: পাহাড় যারা উত্তপ্ত করে রাখতে চায় নিজেদের স্বার্থে, তারাই চায় না কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণ নাটকের অবসান হোক।


কল্পনা চাকমাকে নিয়ে পার্বত্যনিউজে প্রকাশিত আরো কিছু লেখা


কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণের ২৬ বছর উপলক্ষে রবিবার(১২ জুন) সকাল ১০টার সময় খাগড়াছড়ি সদরের স্বনির্ভর থেকে একটি মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি নারাঙহিয়া রেডস্কোয়ার ঘুরে আবার স্বনির্ভরে এসে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নিরূপা চাকমা সভাপতিত্বে ও সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নীতি চাকমার সঞ্চালনায় এতে আরো বক্তব্য রাখেন, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য রেশমি মারমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান।

সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নিরূপা চাকমা বলেন, সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ক্ষমতাসীন সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বেনার নিউজ নামে এক নিউজ পোর্টালকে দেয়া সাক্ষাতকারে কল্পনা চাকমা অপহরণ নিয়ে মিথ্যাচার করে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। কল্পনা অপহরণ নিয়ে তথ্যের বিকৃতি না ঘটাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে সতর্ক করে দেন নিরূপা চাকমা।

কিন্তু বাস্তবে প্রকৃত ঘটনা কী তা এখনো ধোঁয়াছা রয়ে গেছে। প্রতি বছরের মত এ বছরও কল্পনা চাকমা অপহরণের সাজানো নাটক নিয়ে কিছু মহলের অপতৎপরতা দেখতে পাচ্ছি। তারা সভা-সমাবেশ করছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে (ফেইসবুক) বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে যাচ্ছে। কে এই কল্পনা চাকমা? কেন তাকে নিয়ে এত মাতামাতি?এ কথিত অপহরণ নাটকের আবসানের জন্য লেখার এ অবতারণা।

কল্পনা চাকমার কথিত অপহরণ নাটক নিয়ে কথা বলতে রাঙামাটি পুলিশ সুপার মীর মোদ্দাছুছের হোসেনকে কয়েক বার তার সরকারি সেল ফোন নাম্বারে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস দেওয়া হলেও উত্তর মেলেনি। ফলে পুলিশ সুপারের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

কল্পনা চাকমার কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে একাধিকবার তার পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ টেস্ট করার জন্য অনুরোধ করা হলেও তার পরিবার বারবার ডিএনএ টেস্ট করাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে জানতে চাইলে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বাদীপক্ষের আইনজীবী জুয়েল দেওয়ান বলেন, ‘৩/৪ বছর আগে পুলিশ ডিএনএ টেস্টের অনুরোধ জানিয়েছিল, কিন্তু কল্পনা চাকমার পরিবার তাতে রাজি হয়নি। কিন্তু কেন রাজি হয়নি, সেটা তারা কখনো আমাকে জানায়নি।’

কল্পনা চাকমা ছিলেন, জ্যোতিরিদ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তুু লারমা নেতৃত্বাধীন অবিভক্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নারী সংগঠন সংগঠন হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদিকা। স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক, আন্দোলনে ও নেতৃত্বে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে ১১ জুন মধ্যরাতে নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান কল্পনা চাকমা। অবশ্য কেউ কেউ বলে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান হয়েছেন।

অনুসন্ধান কী বলে?
অনুসন্ধানে জানা গেছে,কল্পনা চাকমার প্রেমিক (পরবর্তীতে স্বামী) অরুণ বিকাশ চাকমা ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সাথে জড়িত ছিলেন। অরুণ বিকাশ চাকমা বেশ কয়েকবার কল্পনা চাকমাদের বাড়িতে বেড়াতেও এসেছিলেন। কল্পনা এবং অরুণ দুজনের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। এই সম্পর্কের কথা কল্পনার বাড়িতে জানাজানি হলে কল্পনার পরিবার সে সম্পর্ককে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

অনুসন্ধান বলছে, তৎকালীন তরুণ সেনা অফিসার লে. ফেরদৌস বেশ কিছু সফল অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী এবং পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের(পিসিপির) মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন রাঙামাটির উগলছড়ি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার। নির্বাচনের উদ্দেশ্যে তার ঐ ক্যাম্পে আগমন। খুব তাড়াতাড়ি তার এই সফলতা শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির মধ্যে চিন্তার উদ্রেক করে। পরবর্তিতে লে. ফেরদৌসকে হত্যার করার উদ্দেশ্যে তার গাড়ির বহরের উপর বেশ কয়েকবার এম্বুশ করে পিসিপি এবং শান্তিবাহিনী। কিন্তু তার কোন ক্ষতি করতে পারে নি তারা। ফলে তারা ফন্দি আটতে থাকে কিভাবে লে. ফেরদৌসকে কোন বিতর্কে জড়িয়ে তাকে এলাকা ছাড়া করা যায়। যার ফলশ্রুতিতে কল্পনা চাকমা অপহরণের নাটক।

সূত্রটি বলছে, কল্পনা চাকমা হিল উইমেন ফেডারেশনের নেত্রী এবং তাদের নিজস্ব প্রার্থী বিজয় কেতন চাকমার প্রচারণা চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া সত্বেও আওয়ামী লীগের প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। যার কারণে তিনি অতি দ্রুত সবার নজরে চলে আসেন। ফলে ‘সতীনের ছেলেকে বাঘ মারতে পাঠানোর‘ বাংলা প্রবাদেরর মতো তাকে ঘিরেই ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা সাজায় আঞ্চলিক সংগঠনটি। বিষয়টি টের পেয়ে তৎকালীন শান্তিবাহিনী ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)‘র কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীদের সহায়তায় এবং পরিকল্পনায় প্রেমিক অরুণ বিকাশ চাকমার কাছে কল্পনা চাকমা পালিয়ে যান। যাকে অনেকটা স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান বলা যায়। যা তার পরিবারের সকলেই অবগত।

এ ঘটনা ভিন্নখাটে প্রবাহিত করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য সন্তুর সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী এবং পিসিপি সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে মিথ্যা অপহরণের নাটক মঞ্চস্থ করে। যার প্রথম ধাপ ছিল ১২ জুন ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা চাকমার ভাই কালিন্দা কুমার চাকমা বাঘাইছড়ি থানার মামলা (মামলা নং-২/৯৬১)।

কল্পনা চাকমা নিখোঁজের ব্যাপারটিকে নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠিক হয়। এক পর্যায়ে তদন্ত কমিশন কল্পনা চাকমার মাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা কল্পনা চাকমার মা শান্তিবাহিনী ও পিসিপির চাপে পরে প্রকৃত ঘটনা আডাল করেন এবং তদন্ত কমিটিকে জানায়, যে রাতের বেলা কিছু লোক অস্ত্র হাতে, লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় তার বাড়িতে দরজা কেটে প্রবেশ করে কল্পনাকে নিয়ে যান। সাথে কল্পনার দুই ভাইকেও নিয়ে যায়। কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পর তার ভাইদের পাঠিয়ে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ তার মা তিনটি গুলির আওয়াজ পান। এখানে মজার ব্যাপার হল যে, গুলির আওয়াজ তিনি একাই পেয়েছিলেন। তার আশেপাশের কেউ এই আওয়াজ পান নি। তিনি আরো বলেন যে, ‘যারা এসেছিল তাদের কন্ঠস্বর নাকি সেনাবাহিনীর মত’। যাই হোক, সময়ের সাথে চলতে থাকে তদন্তের কার্যক্রম। এলাকাবাসীর মন্তব্য এবং কল্পনার পরিবারের কথায় যখন তদন্ত কমিটি সন্দিহান হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই ১ আগস্ট ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা তার মার সাথে যোগাযোগ করে এবং জানায় যে, সে ভাল আছে। (বিষয়টি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রকাশিত)

৮ আগস্ট ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা চাকমাকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গংগাছড়া মহাকুমার ৪ মাইলের শুক্রে নামক এলাকায় দেখা যায়। ৯ আগষ্ট ১৯৯৬ তারিখে বিভিন্ন পত্রিকায় কল্পনা চাকমা বেঁচে আছে বলে খবর প্রকাশিত এবং শুধু তাই নয়, কিছু কিছু পত্রিকায় সেনাবাহিনীর কোন সম্পৃত্ততা নেই বলে মত প্রকাশ করে।

১৯৯৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অরুণাচল থেকে লিখিত একটি চিঠিতে কল্পনা চাকমা উল্লেখ করেন যে, প্রায় দেড় মাস খানেক আগে তিনি মা হয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, আত্মীয় ও স্বজনদের নিষেধ অমান্য করে বিয়ে করায় নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন তিনি।

১৯৯৬ সালের ১৪ জুন প্রথম আলো পত্রিকায় একটি লেখাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে হিল উইমেন্স ফেডারেশন একটি লিফলেট (১০ জুন ২০০৬) বিতরণ করে। যেখানে তারা দাবি করে, ত্রিপুরার এক সেনা কর্মকর্তা সাংবাদিক আবেদ খানকে নিশ্চিত করেছেন যে, কল্পনা চাকমাকে সেনা গোয়েন্দারা ভারতের ত্রিপুরায় অক্ষত অবস্থায় দেখে এসেছেন। এমনকি কল্পনা চাকমা অবশ্যই বেঁচে আছে এ খবর নিশ্চিত করেছেন।

সূত্র জানায়, তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটি যখন কল্পনা চাকমার বাসায় যায় তখন তার ব্যবহৃত কোন প্রকার ব্যবহার্য দ্রব্য পাননি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, অপহরণকারীরা যদি অসৎ কোনো উদ্দেশ্যেই তাকে তুলে নিয়ে যাবে তাহলে তার ব্যবহার্য দ্রব্যাদি কেন নিয়ে যাবে?
শুধু তাই নয়, তদন্ত কমিটি এক পর্যায়ে কল্পনা চাকমার ভারতে থাকার সুত্র পান এবং তাকে দেশে ফিরে আসার জন্য চিঠি লিখেন। ফিরতি চিঠিতে কল্পনা চাকমা লিখেন, তিনি ফিরে আসতে চান। কিন্তু ফিরে আসলে তৎকালীন শান্তিবাহিনী তাকে হত্যা করে ফেলবে। এই ভীতি থেকেই তিনি দেশে আসেন না।

উপরক্ত বিষয়গুলো পর্যালচনা করলে দেখা যায়, কল্পনা চাকমা আসলে নিজে নিজেই পালিয়ে গিয়েছিলেন। যার কারণ দুইটি। একটি হল তার ভালবাসাকে তার পরিবার বিবাহের সম্পর্কে আবদ্ধ করতে চাননি এবং তৎকালীন শান্তিবাহিনীর একটি চাপ। কারণ এখন সে যদি দেশে ফিরে আসে তাহলে শান্তিবাহিনীর সকল বানোয়াট ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে।

সর্বশেষ বলবো, কল্পনা চাকমা অপহরণ নিয়ে শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির সকল প্রচার-প্রচারণা মিথ্যা এবং বানোয়াট। তাই সকলের উচিত এই ভুল প্রচারণাকে উৎসাহিত না করা। কেননা, কল্পনা চাকমা এখনো বেঁচে আছেন এবং বেশ ভাল আছেন। সে স্বামী-সন্তান নিয়ে ভাল থাকুক সেটাই প্রত্যাশা।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কল্পনা চাকমা, কল্পনা চাকমা অপহরণ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন