কল্পনা চাকমা ইস্যুতে পাহাড় উত্তপ্ত করার চেষ্টা(ভিডিও)

কাজী সোহাগ, রাঙ্গামাটি থেকে | 

কল্পনা চাকমার অন্তর্ধান ইস্যুতে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পার্বত্য অঞ্চলকে উত্তপ্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে একটি মহল। বিদেশিদের কাছে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে তারা আনছেন ফান্ড। সভা-সমিতি, বক্তৃতা আর বিবৃতির মাধ্যমে বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখছেন এ ইস্যুটি। পাহাড়ি-বাঙালির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাঝে এ ইস্যুতে ছড়ানো হচ্ছে হিংসার বিষবাষ্প। একইসঙ্গে দেশের অখণ্ডতার ধারক-বাহক সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নেরও চেষ্টা হচ্ছে। কল্পনা চাকমা ইস্যু নিয়ে রাঙ্গামাটির প্রায় অর্ধশতাধিক মানুষের সঙ্গে আলাপ করলে
তারা এসব তথ্য জানান।

আগামীকাল ১১ই জুন কল্পনা চাকমার অন্তর্ধান দিবস হিসেবে পালন করে আসছে উপজাতীয়দের কয়েকটি সংগঠন। ১৯৯৬ সালের এই দিনে কল্পনা চাকমা অন্তরালে বলে জানান। অবশ্য কেউ বলেন অপহরণ করে তাকে গুম করা হয়েছে আবার কেউ বলেন স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান হয়েছেন। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মূলত কল্পনা চাকমাকে পুঁজি করে অনেকেই এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৬ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর সরকার সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল জলিলকে সভাপতি করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি কল্পনা চাকমা নিজ ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক অপহৃত হয়েছে বলে মতামত দেন। কিন্তু কার দ্বারা অপহৃত হয়েছে তা নির্ণয় করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। এ প্রেক্ষিতে তারা কারও বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেনি।

১৯৯৭ সালের ১৭ই জানুয়ারি বাঘাইছড়ি থানার মামলাটি জেলার বিশেষ শাখায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর মামলাটি আবারও বাঘাইছড়ি থানা গ্রহণ করে দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়ে ২০১০ সালের ২১ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।

মামলার বাদী কালিন্দী কুমার চাকমা এর বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করলে আদালত ২০১০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর মামলাটি তদন্তে সিআইডির চট্টগ্রাম জোনকে নির্দেশ দেয়। সিআইডি দীর্ঘ ২ বছর তদন্ত করে ২০১২ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে।

কিন্তু কালিন্দী চাকমার তা মনঃপূত না হওয়ায় তিনি আবারও নারাজি দেন। আদালত তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি রাঙ্গামাটির পুলিশ সুপারকে তদন্ত ভার দিয়ে ৪ দফা নির্দেশনা দেয়। পুলিশ সুপার দীর্ঘ তদন্ত চালান।

তদন্তের খাতিরে কল্পনা চাকমার দুই বড় ভাইয়ের ডিএনএ সংগ্রহের জন্য অনুমতি চাইলে আদালত ২০১৩ সালের ২২শে ডিসেম্বর নমুনা সংগ্রহের আদেশ দেন। কিন্তু কালিন্দী কুমার চাকমা এবং লালবিহারি চাকমা (ক্ষুদিরাম) ডিএনএ দিতে রাজি হননি। তারা ২০১৪ সালের ৬ মার্চ আদালতের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহের আদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করেন। কিন্তু আদালত তার আদেশ বহাল রাখেন। পরে পুলিশ দীর্ঘ অনুসন্ধান চালিয়েও কল্পনা চাকমার অপহরণ সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রমাণ এবং সাক্ষী পায়নি।

এ প্রেক্ষিতে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর মামলার কার্যক্রম বন্ধের জন্য আদালতে আবেদন করে। আবেদনটি এখন আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।

এদিকে কল্পনা চাকমা ইস্যু নিয়ে কাজ করা একটি তদন্ত সংস্থা জানিয়েছে, ঘটনার তদন্তে পুলিশ কল্পনা চাকমার বাসায় গেলে তার ব্যবহার্য পোশাক থেকে শুরু করে বই-পুস্তক তৈজসপত্র কিছুই খুঁজে পায়নি। এমনকি কল্পনা চাকমার মা বাধুনি চাকমা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, কল্পিত অন্তর্ধানের পরও তার মেয়ে দু’বার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের ১লা আগস্ট সে যোগাযোগ করেছিল। কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা নিয়ে মামলায় বলা হয়, ১৯৯৬ সালের ১১ই জুন রাত একটায় লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসের নেতৃত্বে একদল সৈনিক কল্পনা চাকমাসহ তার দুই ভাইকে অপহরণ করে। তার ভাইয়েরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ২৩ বছর বয়সী কল্পনা চাকমাকে গুম করা হয়েছে।

কালিন্দী কুমার চাকমা ঘটনার পরদিন ১২ই জুন বাঘাইছড়ি থানায় যে মামলা করে (মামলা নং-২/৯৬১,তারিখ-১২.০৬.১৯৯৬ ইং, ধারা-৩৪৬) সেখানে কিছু অপরিচিত লোকের কথা থাকলেও সেনাবাহিনী এবং গোলাগুলির কথা বলা হয়নি।

অথচ বিশেষ ওই মহলের ইন্ধনে ১৩ই জুন লালবিহারি চাকমা দাবি করে যে, রাতের আঁধারে কিংবা টর্চ লাইটের আলোয় লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসসহ তিনজন সেনা সদস্যকে চিনতে পেরেছে। মামলায় এসব কথা যোগ করা হলে কয়েক দফা তদন্তে এর সত্যতা পায়নি সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

এ প্রসঙ্গে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস ঘটনার দিন সকালে নির্বাচন উপলক্ষে  দায়িত্ব পালনের জন্য উগলছড়ি ক্যাম্পে আসেন। যা কল্পনা চাকমার বাড়ির কাছেই ছিল। আর সেই ক্যাম্পে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস একা নয়, ক্যামেপ তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, একজন মেজরসহ আরো দু’জন অফিসার এবং প্রায় ৯০ জন সৈনিক ছিল। সেনাবাহিনীর সদস্যরা ছাড়াও নির্বাচন পরিচালনা কাজে নিয়োজিত প্রিজাইডিং অফিসার জ্ঞানময় চাকমা, পুলিশের সুবেদার ইদ্রিস আলীসহ ৬ জন পুলিশ কনস্টেবল ওইদিন উগলছড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাত যাপন করে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এতজন লোকের মাঝে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস কয়েকজন সৈনিক নিয়ে একটা অপহরণের ঘটনা ঘটালো, গোলাগুলি করলো অথচ কেউ গোলাগুলির শব্দ শুনলো না বা চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনলো না? অথচ কে না জানে পার্বত্য এলাকার রাতের নিস্তব্ধ নিরিবিলি পরিবেশে এ ধরনের শব্দ অনেকদূর পর্যন্ত শুনতে পাওয়ার কথা।

বলা হয়, কল্পনা চাকমার ভাইদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিল। সেক্ষেত্রে কারও গায়ে গুলির আঁচড় পর্যন্ত নেই কেন? তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রশ্ন আসতে পারে, সেনা ক্যাম্পে বেশ কয়েকজন অফিসার থাকতে কেন লেফটেন্যান্ট ফেরদৌসকে নিয়ে এই অপপ্রচার।

আসলে লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস এর ওপরে শান্তি বাহিনীর ক্ষোভ অনেক পুরনো। সে সময়ে বাঘাইছড়ি এলাকায় অনেক সফল অভিযানের নায়ক সে। একারণেই তার ওপরে প্রতিশোধ নিতেই এ অপহরণ নাটকের দৃশ্যায়ন করা হয়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কল্পনা চাকমা ইস্যুতে বছরের পর লাভবান হচ্ছেন এমন পাহাড়ি সংগঠনগুলো সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়ে আসছে। ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিচ্ছে পাহাড়ি-বাঙালির মাঝে।

সূত্র: মানবজমিন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন