গ্রীষ্মকালীন পার্বত্য চাষীরা ১০ লাখ টন ফল বিক্রি নিয়ে শঙ্কায়


দেশের তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে প্রতি বছর ১৮ লাখ টন ফল উৎপাদন হয়, যার অর্ধেকেরই বেশি আগে গ্রীষ্ম মৌসুমে। চলমান কভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে চলতি গ্রীষ্ম মৌসুমে উৎপাদিত প্রায় ১০ লাখ ফলের বাজারজাত নিয়ে শঙ্কায় আছেন পাহাড়ের উদ্যান চাষীরা।
নভেল করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সাধারণ ছুটির এ সময়ে সারা দেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামেও যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় ফল কিনতে আসছেন না দেশের অন্য অঞ্চলের ব্যাপারী ও আড়তদাররা। এ কারণে উৎপাদিত ফল বিক্রি করতে পারছেন না চাষীরা।
১০ বছর ধরে নিজস্ব পাহাড়ি জমিতে জুম চাষের পাশাপাশি উদ্যান ফসলও চাষ করেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার আদিবাসী কৃষক উশেথোয়াই মারমা। এক সময় পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবে চাষ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্যিকভাবে জুমের জমিতে উদ্যান ফসলের চাষ বাড়িয়েছেন তিনি।
যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার পাশাপাশি সারা দেশে পাহাড়ি ফলের চাহিদা থাকায় এ থেকে প্রতি বছর ভালোই আয় করেন তিনি। কিন্তু চলতি বছর কাঁঠাল, লিচু ও আনারসের চাষ করে লোকসানে পড়েছেন এ উদ্যান চাষী। গড় দেড় মাস ধরে সাপ্তাহিক হাটে শহর থেকে ব্যাপারী না আসায় কম দামে ফলগুলো বিক্রি করতে হচ্ছে তাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) রাঙ্গামাটি অঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৪৫ প্রজাতির প্রায় ১৭ লাখ ৪০৫ টন ফল উৎপাদন হয় পার্বত্য অঞ্চলে। চলতি মৌসুমে ১৯ লাখ ৩৬ হাজার ৪৪৫ টন ফল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু মার্চের মাঝামাঝিতে কভিড-১৯-এর কারণে সারা দেশে যানবাহন চলাচল সীমিত হয়ে যাওয়ায় উৎপাদিত ফলের বিপণন নিয়ে সংকটে পড়েছেন পাহাড়ের কৃষক।
নিত্যপণ্য, ওষুধ ও কৃষিপণ্য পরিবহনে বাধা না থাকলেও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ব্যাপারীরা পার্বত্য এলাকায় যেতে পারছে না। উৎপাদিত ফলে স্থানীয় চাহিদা খুবই সীমিত হওয়ায় বাজারজাত নিয়ে সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে।
মূলত ব্যবসায়ীদের যাতায়াত সমস্যা ও পণ্য পরিবহনের যানবাহনের সংকটে ফলের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। এতে করে একদিকে পার্বত্য কৃষক কম দামেও ফল বিক্রি করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অপরদিকে গ্রীষ্মকালীন ফলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী পার্বত্য এলাকার ফল না আসায় সারা দেশে এসব ফলের সরবরাহ কমে যাওয়ায় অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে।
ডিএই রাঙ্গামাটি অঞ্চলের উদ্যান ফসলের বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে দেখা গেছে, ২০১৮-১৯ মৌসুমে পার্বত্য তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৫০ টন কলা, ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩০৬ টন আম, ২ লাখ ৫৭ হাজার ২ টন কাঁঠাল, ২৪ হাজার ৩৫২ টন লিচু, ২১ হাজার ২৯৮ টন তরমুজ, ৪১ হাজার ৫০৫ টন লেবু, ৩৮ হাজার ১২১ টন বাতাবীলেবু, ৪৯ হাজার ৪৯১ টন পেয়ারা, ১ লাখ ৭৪ হাজার ৯৫৪ টন পেঁপে ও ১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৭ টন আনারস উৎপাদন হয়েছিল।
কলা, পেঁপে ও আনারস প্রায় সারা বছর উৎপাদন হলেও কাঁঠাল, আম, লিচু, লেবু, তরমুজ, বাতাবীলেবুর গ্রীষ্মকালীন ফল হওয়ায় এসব ফল নিয়েই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় কৃষক। অর্থাৎ গ্রীষ্মকালীন প্রায় ২০টি ফলের মোট উৎপাদন বার্ষিক উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি হওয়ায় চলতি মৌসুমে উদ্যান ফসল অর্থাৎ ফলের আবাদে বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন পার্বত্য কৃষকরা।
জানতে চাইলে কৃষি ডিএই (রাঙ্গামাটি) অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) কাজী শফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, পার্বত্য কৃষকদের উদ্যান ফসলের সরবরাহ চেইনের সংকট দূর করতে এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে অধিদপ্তর।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ছাড়াও সারা দেশের সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের তালিকা চেয়েছে কৃষি বিভাগ। আমরা তালিকা তৈরি করে আগামী সপ্তাহের মধ্যে ঢাকায় পাঠিয়ে দেব। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে পার্বত্য এলাকার উৎপাদিত ফল সারা দেশে বাজারজাতে বড় ধরনের কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
কৃষি বিভাগ ও ভুক্তভোগী একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে প্রশাসনিক বাধা না থাকলেও সীমিত যানবাহনের কারণে কৃষকরা উৎপাদিত ফল পাঠাতে পারছেন না। মার্চ ও এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত পার্বত্য এলাকায় পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলও সীমিত ছিল।
তাছাড়া স্থানীয় কৃষক ও ব্যাপারীরা পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন বাজার থেকে ফল ও কৃষিজ পণ্য ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় কেউই পার্বত্য এলাকার বাজারগুলোতে আসছেন না।
চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গীবাজারের বিসমিল্লাহ বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী আবদুল কাদের এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী মৌসুমে পার্বত্য এলাকায় গিয়ে ফল নিয়ে আসেন আড়তে। কমিশনের ভিত্তিতে তারা ফলগুলো চট্টগ্রামের পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সরবরাহ করেন।
কিন্তু কৃষিপণ্যের যানবাহন চলাচল করলেও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ব্যাপারীরা যেতে পারছেন না। ফলে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলের সুবিধা রাখা হলেও সেটি কাজে আসছে না বলে মনে করছেন তিনি।
সূত্র: বণিক বার্তা