দৃশ্যমান উন্নয়ন নেই কক্সবাজার পৌরসভায়
পর্যটন নগরী কক্সবাজারের পৌরসভার নতুন পরিষদের প্রায় এক বছর পার হতে চলেছে। কিন্তু এখনো দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন দেখা মিলেনি। সব উন্নয়ন সভা-সেমিনারে ও কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। ফলে দৈনন্দিন ভোগান্তি নিয়ে জীবন যাপন করছে পৌরবাসী।
সুত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে কক্সবাজার পৌরসভার নতুন পরিষদ শপথ গ্রহণ করে। নির্বাচনী প্রচারণায় জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়নে কথার ফুলঝুরি উড়িয়ে বেড়ায়। দেশের আধুনিক মডেল পৌরসভা হবে কক্সবাজার এমন ইশতিহারও ভুলার নয়। কিন্তু নতুন পরিষদের প্রায় এক বছর পার হলেও কাঙ্খিত কোন উন্নয়ন হয়নি। এমনি মন্তব্য সুশীল মহলের।
ড্রেনেজ ব্যবস্থা: কক্সবাজার পৌরসভার ১২টি ওয়ার্ডের অন্যতম সমস্যা ড্রেনেজ। প্রতিটি ওয়ার্ডের নালাগুলো অপরিকল্পিতভাবে তৈরি। তাছাড়া নালা দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। অধিকাংশ ড্রেইন সরু। মিশে গেছে রাস্তার সাথে। মাঝে মধ্যে ড্রেইন পরিস্কার করা হলেও উন্নয়ন বলতে কিছুই হয়নি। যার কারণে অল্প বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি ও নালার পানি ঢুকে পড়ে বাড়ি-ঘর এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। এতে পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ।
রাস্তা: কক্সবাজার পৌরসভা প্রথম শ্রেণীর হলেও দেখলে মনে হবে তৃতীয় শ্রেণীর পৌরসভার ন্যায়। পর্যটন শহরের চির অভিশাপ অকেজো সড়ক। শহরের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে সড়ক-উপসড়কে লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। পৌর এলাকার প্রায় ১২টি ওয়ার্ডের ৩০টি পাড়া-মহল্লার সড়ক চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সড়কগুলোর কার্পেটিং উঠে সৃষ্টি হয়েছে খানা খন্দকে। চলতি বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাতে ভাঙা সড়ক দিয়ে যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে শহরবাসী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পৌর শহরের আলির জাহাল, রুমালিয়ার ছড়া, তারাবনিয়ার ছড়া, কালুর দোকান, পাহাড়তলী, বৃহত্তর টেকপাড়া, বার্মিজ স্কুল সড়ক, চাউল বাজার রোড, বড় বাজার, বৌদ্ধ মন্দির সড়ক, গোলদিঘির পাড়, ঘোনারপাড়া, বৈদ্য ঘোনা, এন্ডারসন সড়ক, বার্মিজ মার্কেট, বাজারঘাটা, হাসপাতাল সড়ক, স্টেডিয়াম সড়ক, লাইট হাউস, সমিতিপাড়া, আদর্শগ্রাম, কলাতলী ও হোটেল মোটেল জোন এলাকার সড়কের বেহালদশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিটি সড়কের কার্পেটিংয়ের কোন অস্তিত্বই নেই। এক হাত পর পর ছোট-বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিপাত হলে বাড়ে দুর্ভোগ। বৃষ্টি ও ড্রেইনের পানিতে একাকার হয়ে যায় সড়কগুলো। সাথে মিশে যায় রাস্তার পাশে জমে থাকা আবর্জনা। ফলে চলাচলে পোহাতে হয় সীমাহীন কষ্ট। তাছাড়া ভঙ্গুর সড়কে নানা সময় ঘটছে দুর্ঘটনা।
আবর্জনা :স্বাস্থ্য শহর হিসেবে খ্যাত কক্সবাজার। কিন্তু সর্বত্র অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজমান। পৌর শহরের আবর্জনা সঠিক সময়ে সরিয়ে নিতে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তবুও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কয়েকটি ওয়ার্ড ছাড়া অন্যগুলোতে আবর্জনা ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা। বিভিন্ন এলাকায় দুই দিনও পড়ে থাকে আবর্জনা। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলার কারণে পরিবেশ হয়ে উঠে ভারী। বিভিন্ন এলাকায় বসানো ডাস্টবিনের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন।
পানি সরবরাহ: কক্সবাজার পৌরসভার অন্যতম সমস্যা পানি। কখন পানি আসে বা যায় তার কোন হিসেব নেই। দিন দিন পানি সংকট প্রকট আকারে ধারণ করছে। পানি সরবরাহে নেই কোন তদারকি। পানি সমস্যা দূর করতে কক্সবাজার পৌর পরিষদ নানা উদ্যোগ নেয়। তবুও এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
পাওয়া যায় না কাউন্সিলরদের: দীর্ঘ প্রায় এক বছর ধরে পৌর এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। খবর নেই জনপ্রতিনিধির। শুধু ভোটের সময় তাদের দেখা মিলেছিল। মাঝে মধ্যে দেখা মিলেও মুহুর্তে হাওয়া হয়ে যান তারা। এতে এলাকার সমস্যা বলার কাউকে খুঁজে পায়না সাধারণ মানুষ। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা বেশ সক্রিয়। সেখানে নিজেরাই নানা উন্নয়নের ঝলক দেখান। নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরদের অফিস করার প্রতিশ্রুতিও ধোঁয়াশায় রয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে কোন জরুরী কাগজে স্বাক্ষর লাগলে পৌরসভায় গিয়ে স্বাক্ষর নিতেও বেগ পেতে হয়।
এদিকে কলাতলী মেরিড্রাইভ সংযোগ সড়কের সংস্কার কাজ এখনও শেষ হয়নি। যার দরূণ দিন দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। অনেকের প্রশ্ন শুধু একটি সড়ক সংস্কারে যদি এতোদিন সময় লাগে তাহলে বাকি সড়কগুলোর কাজ শুরু হলে শেষ হওয়ারতো নামই থাকবে না। জন্মনিবন্ধন ও অন্যান্য সেবা পেতেও চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে অভিযোগ শহরবাসীর।
চাউল বাজার এলাকার শিক্ষিকা মাউটিন বলেন, এই এলাকার প্রায় সড়ক গ্রামীণ জনপদের চেয়ে অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ৫ মিনিটের পথ যেতে লাগে ১৫ মিনিট। বৃষ্টি হলে রাস্তায় জমে থাকে নোংরা পানি। এতে চলাচলে খুব অসুবিধা হয়। তাছাড়া ড্রেইন গুলোও দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছে। তাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন খবর নেই।
টেকপাড়া এলাকার ব্যাংকার জাহেদ উল্লাহ জাহেদ বলেন, বড় পুকুর রোডের ৩ কিলোমিটার জুড়ে শুধুই খানা-খন্দক। এ অবস্থায় হাটাচলায় সকলের ব্যাপক বেগ পেতে হচ্ছে। সকলে মিলে মসজিদে যাওয়ার সড়কটি সংস্কার করা হয়েছে। অপরদিকে যত্রতত্র পড়ে থাকে আর্বজনা।
হোটেল মোটেল জোন এলাকার পর্যটন ব্যবসায়ী বোরহান উদ্দিন বলেন, বিশ্বে কক্সবাজারের সুনাম বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখানকার রাস্তার অবস্থা, ড্রেনেজ ও আবর্জনা ব্যবস্থা খুবই নাজুক। যার কারণে পর্যটকেরা এখানে আসলে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে ফেরেন। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাবা উচিত।
“আমরা কক্সবাজারবাসীর” এইচ.এম নজরুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং কক্সবাজার পৌরসভার মধ্যে বর্তমানে রাস্তা নিয়ে রশি টানাটানি চলছে। এক বিভাগকে বললে তারা তাদের আওতায় সে রাস্তা পড়েনি বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছে। এভাবে দায়সারা থাকলে ভবিষ্যত পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। সবার উচিৎ কক্সবাজারের স্বার্থে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, শীঘ্রই সব এলাকার রাস্তা ও সংস্কার করা হবে। সেই সাথে উন্নত করা হবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পৌর এলাকায় নিয়মিত আবর্জনা পরিচ্ছন্ন করতে হচ্ছে। তদারকি করছে সুপার ভাইজাররা। এখানে একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই। জনতার কাছে সবাই দায়বদ্ধ। তাই তাদের উন্নয়নে, কক্সবাজারের উন্নয়নে তিনি কারও সাথে কোন আপোষ করবেন বলে জানিয়ে দেন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, বিষয়টি উদ্বেগজনক। এ নিয়ে উন্নয়ন সমন্বয়ন কমিটির সভায় আলোকপাত করা হবে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ব্যবস্থা গ্রহণে বলা হবে।