মিয়ানমারের সংঘাতে মলিন বাংলাদেশ সীমান্তের ২১ গ্রামের মানুষের ঈদ আনন্দ

fec-image

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে টানা দুই মাস ধরে চলছে মর্টার শেল ও গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণ। মাঝেমধ্যে ওপারের মর্টার শেল ও গুলি এপারে এসে পড়ছে। মর্টার শেল পড়ার আশঙ্কায় দুই মাস ধরে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ৫টি ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের অন্তত ২৩ হাজার মানুষ নাফ নদীর তীরের জমিতে চাষাবাদ, মৎস্য ও কাঁকড়া আহরণ করতে পারছেন না। সাত হাজারের বেশি জেলে মাছ ধরতে নাফ নদীতে নামতে পারছেন না।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ওপারের চলমান সংঘাতে জীবিকা হারানো মানুষগুলো চরম অর্থসংকটে পড়েছেন। রমজান মাস তাঁরা কাটিয়েছেন অতিকষ্টে। পবিত্র ঈদুল ফিতরেও সীমান্তের জনপদের মানুষগুলোকে চরম আতঙ্কে রাত কাটাতে হচ্ছে। ঈদের আনন্দ যেন বিলীন হচ্ছে ওপারের বিকট শব্দের বিস্ফোরণে।

আজ বুধবার দুপুরে টেকনাফ সীমান্তের হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও সাবরাং ইউনিয়ন ঘুরে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই হতাশার কথা জানা গেছে। দীর্ঘ দুই মাস ধরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে সংঘাত–লড়াই চলছে। এ লড়াই কখন থামবে কেউ জানে না। এতে ভবিষ্যতে তাঁদের অবস্থা কী হবে ভেবে পাচ্ছেন না সীমান্ত জনপদের মানুষগুলো।

আজ ভোররাত পাঁচটায় রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের উত্তর বলিবাজার, নাকফুরা, রাইক্ষবিল, শীলখালী, মাঙ্গালা এবং মংডুর দক্ষিণে পেরাংপুরা ও হাস্যুরাতা এলাকায় বিকট শব্দে মর্টার শেল ও গ্রেনেড–বোমার বিস্ফোরণ শুরু হয়। আধা ঘণ্টার মধ্যে অন্তত ১৫০টি মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে নাফ নদীর এপারে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়া, আচারবুনিয়া, টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরীপাড়া, নেটংপাড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের রাখাইনপল্লি, ফুলের ডেইল, মৌলভিপাড়া, খারাংখালী, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবনিয়া, কাঞ্জরপাড়াসহ অন্তত ১৭টি গ্রামে ভূকম্পন দেখা দেয়। সকাল-দুপুর-বিকেল গড়িয়ে ওপারের বিস্ফোরণ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, দীর্ঘ দুই মাসের যুদ্ধে আরাকান আর্মির সঙ্গে অনেকটা টিকতে পারছে না সরকারি বাহিনী। বিশেষ করে দুই মাসে যুদ্ধ এবং শক্তিশালী মর্টার শেল ও গ্রেনেড বোমার বিস্ফোরণে মংডু টাউনশিপের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া সেখানে জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রীর তীব্র সংকট চলছে।

আরকান আর্মির সঙ্গে টিকতে না পেরে সরকারি বাহিনীর লোকজন মংডু টাউনশিপের পেছনে কালাদান পাহাড়ে আত্মগোপন করছেন। সর্বশেষ গত ৩০ মার্চ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ৩ সদস্য নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। এর আগে ১১ মার্চ আশ্রয় নেন আরও ১৭৭ জন বিজিপি ও সেনাসদস্য। তাঁরা সবাই নাইক্ষ্যংছড়ি সদরে ১১ বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) হেফাজতে রয়েছেন। এর আগে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন আরও ৩৩০ জন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৩৩০ জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছিল।

টেকনাফ স্থলবন্দরে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা মিয়ানমারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, আরাকান আর্মি চাইছে মংডু টাউনশিপের দক্ষিণে চারমাইল স্থানটি দখলে নিতে। সেখানে সেনাবাহিনীর একটি ব্যারাক রয়েছে। এলাকাটি দখলে নিয়ে পারলে রাজধানী সিথুয়ের (আকিয়াব) সঙ্গে মংডুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে বিজিবির টহল বাড়ানো হয়েছে।

বুধবার সন্ধ্যার দিকে হোয়াইক্যং ও হ্নীলা সীমান্তের মানুষ যখন ইফতার নিয়ে ব্যস্ত, ওপারে তখন মর্টার শেলের বিস্ফোরণ ঘটছিল। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিল লোকজনের ঘরবাড়ি। বঙ্গোপসাগরের মধ্যে অবস্থিত সেন্ট মার্টিনে দ্বীপেও ভূকম্পন দেখা দেয়।

হোয়াইক্যং ইউপির চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, ঈদের দিনেও টেকনাফের লোকজনকে ওপারের বিস্ফোরণ আতঙ্কে থাকতে হবে। ওপারের যুদ্ধ কখন থামে, কেউ জানে না। হ্নীলা ইউপির চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী ও টেকনাফ পৌরসভা প্যানেল মেয়র-১ মুজিবুর রহমান বলেন, ওপারের সংঘাত কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, এপার থেকে আন্দাজ করা মুশকিল। আরাকান আর্মির আগ্রাসী মনোভাব ও শক্তি দিন দিন বাড়ছে মনে হলেও সরকারি বাহিনীকে নির্মূল করা ততটা সহজ নয়।

সংঘাতে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মানুষ কিছুটা আতঙ্কে থাকলেও নিরাপত্তা নিয়ে ততটা চিন্তিত নন জানিয়ে সেন্ট মার্টিন ইউপির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, কারণ দ্বীপের চারপাশে বাংলাদেশ সরকারের কঠোর নিরাপত্তা রয়েছে।

সীমান্ত পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় গ্রামের ব্যবসা–বাণিজ্য, আয়রোজগার সীমিত হয়ে পড়েছে জানিয়ে হ্নীলার রাখাইনপল্লির কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, দিনের চেয়ে রাতের মর্টার শেলের বিস্ফোরণ তাঁদের আতঙ্ক বাড়িয়ে তুলছে।

টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জেলে আবদুল গনি ও জালিয়াপাড়ার নুরুল ইসলাম বলেন, রাখাইন রাজ্যের যুদ্ধ মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু তার দায় টেকনাফ সীমান্তের মানুষের বইতে হবে কেন? নিরাপত্তার খাতিরে সরকার নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখলে বেকার জেলেদের জীবন–জীবিকা নির্বিঘ্ন করার দায়িত্ব কার?
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, ওপারের সংঘাতে টেকনাফ সীমান্তের লোকজন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন সত্যি। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, টেকনাফ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন