পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তির ভিত্তি: সকল জাতিগোষ্ঠীর সংখ্যানুপাতে সমান অধিকার


বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠী সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য হলেও বহুক্ষেত্রে তারা বৈষম্যের মুখোমুখি।
প্রশাসনিক নিয়োগ, ভূমি ব্যবস্থাপনা, উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের সুযোগ-এসব জায়গায় একটি শ্রেণিবিশেষের একচেটিয়া সুবিধা দৃশ্যমান। ফলে স্থানীয় বাঙালিরা নিজেদেরকে এই অঞ্চলের ন্যায্য অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে।
একইভাবে, কিছু ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীও কখনো কখনো উন্নয়ন বা রাষ্ট্রীয় সেবার ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে-কীভাবে সব পক্ষকে যুক্ত করে, সুষম নীতির মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করা যায়?
যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামোতে প্রতিনিধিত্ব নির্ধারিত হওয়া উচিত জনসংখ্যার ভিত্তিতে। অর্থাৎ একটি এলাকায় যারা যত বেশি সংখ্যায় বসবাস করে, তাদের অংশগ্রহণ, অধিকার ও সুযোগও ততটাই শক্তিশালী হওয়া উচিত।
এই সূত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক উপজেলায় বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও বিভিন্ন দপ্তরে, পরিষদে বা প্রকল্পে তাদের উপস্থিতি সীমিত। এটি শুধু অবিচার নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক অস্থিরতা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়।
শান্তি তখনই টেকসই হয় যখন রাষ্ট্র সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমান মর্যাদা ও অধিকারবোধ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ভাষা বা ঐতিহ্য যেমন সংরক্ষণযোগ্য, তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির অধিকার ও অবস্থানকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না।
অনেক সময় দেখা যায়, ‘সুরক্ষা’র নামে কিছু গোষ্ঠী অপ্রতিরোধ্য সুবিধা ভোগ করছে, অথচ স্থানীয় বাঙালি জনগণ জমি হারাচ্ছে, সুযোগ হারাচ্ছে-এবং ধীরে ধীরে একপ্রকার দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হচ্ছে। এটি শুধু বেআইনি নয়, নৈতিকভাবেও রাষ্ট্রবিরোধী।
যেকোনো অঞ্চলের উন্নয়ন ও শান্তি নিশ্চিত করতে হলে সেই অঞ্চলের বাস্তবতা অনুযায়ী নীতি গ্রহণ করতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে একটি পক্ষকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত প্রতিনিধিত্বে ঘাটতি দেখা যায়।
উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় বাঙালিদের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন উপেক্ষিত হয়, ভূমি ব্যবস্থাপনায় একপাক্ষিকতা কাজ করে, এবং সুযোগ-সুবিধার বণ্টনে পক্ষপাত তৈরি হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন তখনই সম্ভব, যখন প্রশাসন, স্থানীয় সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব ক্ষেত্রে সংখ্যাভিত্তিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সমাধান হুট করে আসবে না। এর জন্য প্রয়োজন দ্বিস্তর নীতির-একদিকে রাষ্ট্রীয় নীতি হবে নিরপেক্ষ ও জনসংখ্যা অনুযায়ী ভারসাম্যপূর্ণ; অন্যদিকে সমাজে গড়ে উঠবে আন্তসম্প্রদায়িক সম্মান ও সহনশীলতার পরিবেশ।
স্থানীয়ভাবে সংলাপ, তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনা এবং নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ—এই সবকিছুর মাধ্যমে বাস্তব ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের সামাজিক সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব, যদি রাষ্ট্র সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার ভিত্তিতে সমান অধিকার ও ন্যায়ের গ্যারান্টি দিতে পারে। এই অঞ্চল কেবল পাহাড়ে ঘেরা এক প্রাকৃতিক অঞ্চল নয়, এটি রাষ্ট্রের সমমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিকদের বসবাসস্থল—যেখানে কাউকেই পিছিয়ে রেখে শান্তি অর্জন সম্ভব নয়।
সুতরাং, স্থায়ী শান্তির জন্য প্রয়োজন এক ন্যায়ভিত্তিক নীতির, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘু নয়, বরং সমান মর্যাদার ভিত্তিতে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।