পার্বত্য চট্টগ্রাম, শান্তিচুক্তি, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন ধারা উপধারার জনবসতি আদিকাল থেকেই বিদ্যমান। মুঘল আমলে (১৬৬৬ থেেেক ১৭৬০ সাল) যা কর্পাস মহল নামে পরিচিত ছিল, ব্রিটিশদের সময়ে তা Chittagong Hill Tracts নাম ধারণ করে। অঞ্চলটি পার্বত্য ও জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় দুটি কারণে বিভিন্ন উপজাতিরা অত্র অঞ্চলে আগমন করে এবং বসবাস শুরু করে। প্রথমত: দুর্গম ও বিশেষ ব্যবস্থায় বসবাস, চাষাবাদ, জীবিকাঅর্জন ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিচু ও ভালো ভূমিপ্রকৃতি, চলাচলের উপযোগী বিধায় দুর্গম পাহাড়ে বসবাসে অভ্যস্ত বিশেষ সম্প্রদায়ের লোকেরা ত্রিপুরা, মিজোরাম, আসাম, আরাকান ইত্যাদি থেকে এখানে এসে বসবাস শুরু করে। দ্বিতীয় কারণ হলো, আরাকান রাজ্যের অস্থিরতা, যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগমন। এরমধ্যে ১৭৮৪ সালে বার্মার (মধ্যবার্মা) রাজা বাদপায়া’র আরাকান রাজ্য আক্রমণ ও দখল অন্যতম। এই যুদ্ধের ফলে অনেক উদ্বাস্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে, আরাকান থেকে খুমি, চাকমা ও মারমাদের আগমন উল্লেখযোগ্য। ইংরেজ শাসনামলে (১৮৬০ সাল থেকে) এই দুর্গম অঞ্চলে খাজনা আদায়ের জন্য চাকমা সার্কেল, মং সার্কেল ও বোমাং সার্কেল নামে তিনটি ভাগে ভাগ করে এবং প্রত্যেক সার্কেলে একজন করে চিফ নির্ধারণ করে দেয়। পাকিস্তান স্বাধীন হবার পর ১৯৪৭ সালে স্নেহকুমার চাকমা রাঙামাটিতে ভারতের পতাকা উঠিয়েছিলেন। আবার ১৯৭১ সালে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় উড়িয়ে ছিলেন পাকিস্তানের পতাকা। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় (বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ ব্যরিস্টার দেবাশীষ রায়ের পিতা) পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তানে চলে যান। রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ ও পরবর্তীতে মন্ত্রিত্বও পান। ২০১২ সালে পাকিস্তানেই মৃত্যুবরণ করার পর সেখানেই সমাধিস্ত করা হয়। পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬২ সালে ৮০ মেগাওয়াটের (পরবর্তীতে ২৩০ মেগাওয়াট) জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যে ৪৫.৭ মিটার উচ্চতার কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে প্রায় ৫৪,০০০ একর জলমগ্ন হওয়াতে এই এলাকার প্রায় ১,০০,০০০ বসবাসকারী চাকমা জনগোষ্ঠি বাস্তুচ্যুত হয় এবং যা প্রথম অসন্তোষের বীজ বপন করে। ক্ষতিপূরণ বাবদ ৪ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হলেও চাকমাদের দাবি অনুযায়ী সব অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছায়নি বা তাদের ন্যায্য হিস্যা পায়নি বলে দাবি করে, ফলে অসন্তোষ আরো গভীর হতে গভীরতর হতে থাকে।

স্বাধীনতা পরবর্তীতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি পিসিজেএসএস গঠন করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে পিসিজেএসএস শান্তিবাহিনী নামে সশস্ত্র শাখা গঠন করে এবং গোপনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, তৎকালীন বিডিআর, পুলিশ, আনসারসহ অন্যান্য নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে ১৯৭৬ সাল থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। যা একটি স্বাধীন দেশের ভিতরে থেকে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম ও দেশদ্রোহিতার শামিল। ফলে বহু দেশপ্রেমিক সেনা সদস্য, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, নিরাপরাধ বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের (আনুমানিক ৩০,০০০) প্রাণহানি ঘটে। উপজাতিদের অসন্তোষ আরো বৃদ্ধি পায়, যখন সত্তর ও আশির দশকে প্রায় লক্ষাধিক বাঙালিকে সমতল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনের জন্য নিয়ে আসা হয়।

শান্তিবাহিনী একদিকে যেমন স্থানীয় বাঙালি ও উপজাতিদের উপর জুলুম, নির্যাতন, চাঁদাবাজিতে মেতে ছিল, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে নিজেদের বিপথে যাবার পথকে আরো সুগম করেছিলো। প্রাথমিকভাবে নব্য গঠিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দুর্গম অঞ্চলে অভিযান পরিচালনায় কম অভিজ্ঞতা, অতি দুর্বল অথবা শূন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা, ম্যালেরিয়া, কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অপারেশনের কম অভিজ্ঞতা ইত্যাদি কারণে সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হতাহতের পরিমাণ বাড়তে থাকে। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারের সঠিক দিক নির্দেশনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি জনগণের সমর্থন, এবং সর্বোপরি কাউন্টার ইন্সারজেন্সি অভিযানে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা ও উপর্যোপরি আক্রমণের মুখে টিকে উঠতে না পেরে শান্তিবাহিনী সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। সরকারের সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পার্বত্যচুক্তি হিসেবে পরিচিত এবং এই চুক্তির ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ প্রায় ২২ বছরের সশস্ত্র সংগ্রামের কিছুটা পরিসমাপ্তি ঘটে।

পার্বত্যচুক্তি

পার্বত্যচুক্তির চারটি অধ্যায়, সাধারণ; পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ/ পার্বত্য জেলা পরিষদ; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন ও অন্যান্য বিষয়াবলি। চুক্তিটি পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের স্বতন্ত্র জাতিস্বত্তা এবং বিশেষ মর্যাদাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পার্বত্যচুক্তির পর শান্তিবাহিনীর কিছু সংখ্যক সদস্য আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে এবং আর্থিক ক্ষতিপূরণসহ জীবিকার্জনের জন্য বহু প্রাক্তন শান্তিবাহিনীর সদস্যকে পুনর্বাসন করা হয়। ইতোমধ্যে সাত শতাধিক অস্ত্র সমর্পণকৃত শান্তিবাহিনীর সদস্যকে পুলিশে চাকরি প্রদান করা হয়েছে। প্রায় ৫০,০০০ এর বেশি বাস্তুচ্যুত উপজাতিকে তাদের স্বীয় বাড়িতে পুনঃস্থাপন করা হয়। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৩২টি বিষয়াবলীর ২২টি জেলা পরিষদকে হস্তান্তর করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় করা হয়েছে। পক্ষান্তরে পার্বত্যচুক্তির বিভিন্ন ধারা উপধারা নিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি ও সচেতন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন (সংশোধিত) ২০১৬ ইত্যাদি প্রণয়ন করা হয়। সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, উপজাতিদের অংশগ্রহণ পুলিশ ফোর্স গঠনসহ শান্তিচুক্তির বেশির ভাগ (৭২টি ধারার ৪৮টি) বাস্তবায়ন হলেও কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন ভূমি সমস্যা সমাধান, কার্যকর জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ গঠন ইত্যাদি বিষয়ে যৌক্তিক ও আইনত জটিলতার সৃষ্টি হয়। রিজিয়নাল কাউন্সিল অ্যাক্টকে চ্যালেঞ্জ (এক কেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক, যা সংবিধানের আর্টিকেল ১ এবং ৫৯ এ বর্ণিত। তাছাড়াও আর্টিকেল ২৭ এর সাথেও সাংঘর্ষিক, যেখানে সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দেয়া আছে) করে ২টি রিট পিটিশন দাখিল হলে হাইকোর্ট পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে রায় দেন। পরবর্তীতে ঐ রায়ের উপর সরকার আপিল করাতে তা সুপ্রিম কোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে।

পার্বত্যচুক্তির সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সশস্ত্র অধ্যায়ের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি এবং সংক্ষুব্ধ গোষ্ঠির দাবির প্রতি সরকারের যথাযথ সম্মান, দৃষ্টিপাত ও বাস্তবায়ন। সামগ্রিক বিবেচনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রক্ত, ঘাম, শ্রম, বুদ্ধিমত্তা; প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর পরিশ্রম; সাধারণ জনগণের সমর্থন এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক দুরদর্শিতা, সংলাপ ও সঠিক দিক নির্দেশনা এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সদিচ্ছার কারণে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক, অবকাঠামোগত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পর্যটন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদির উন্নয়ন হয়েছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠি তাঁদের উৎপাদিত পণ্য শুধু স্থানীয় জেলা শহর নয়, ঢাকাসহ সারাদেশ এমন কি বিদেশেও রপ্তানি করছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে পৌঁছে যাওয়াতে বিদ্যুৎ, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রসার ঘটেছে। সমতলের জনগোষ্ঠির সাথে পাহাড়ের জনগোষ্ঠির সংযোগ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। যে পাহাড়ি জনগোষ্ঠি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিতরেই তাঁদের সকল সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ রাখতো, আজ তাঁদের সকল কর্মকাণ্ডের বিস্তৃতি দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে ওঘএঙ, ঘএঙ বিভিন্ন পশ্চিমাদেশ, দেশে সুশীল সমাজ আগ্রহী হয়ে উঠেছে এই পার্বত্য জনগোষ্ঠি নিয়ে। প্রশ্ন আসতে পাওে, তাহলে কি পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে? সহজ উত্তর হবে এখনও সকল সমস্যার উত্তরণ হয়নি।

চলমান পরিস্থিতি

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ভূকৌশলগত রাজনীতি বহুদিনের পুরোনো। এ অঞ্চলকে পৃথকিকরণ জনগোষ্ঠির ভারসাম্য বিনষ্টিকরণ এবং ধর্মান্তকরণের অপচেষ্টা সবই চলমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের চাকরির অভিজ্ঞতায় অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছি সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিভক্তিকরণের রাজনীতি কখনো উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার সহায়ক নয়। এই ধারা পরবর্তী প্রজন্মকে পথভ্রষ্ট করার পথে সহায়ক হচ্ছে এবং হবে যদি না এখনি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

পার্বত্য অঞ্চল ভূমির গঠন অনুযায়ী বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন। দুর্গম ও জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় এই অঞ্চল বাংলাদেশের মূল ধারা ও অন্যান্য জেলা থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। এই অঞ্চলের অধিবাসীরাও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। তাই বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার। সে সাথে জাতিগত বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের অধিকারও নিশ্চিত করছে বাংলাদেশ সরকার। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে যে সকল উপজাতি সম্প্রদায় বসবাস করছে তারা কেউই এই অঞ্চলের মূল আদিবাসী নয়। বিগত কয়েকশো বছরের মধ্যে তারা সকলেই পাশর্^বর্তী অঞ্চল হতে আগমন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেছে। অথচ, ২০০৯-১০ সালে কিছু কুচক্রিমহল যেমন ‘আদিবাসী’ ইস্যু তুলে এ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। এমনকি তারা জাতিসংঘ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো এ দেশের বিরুদ্ধে প্রস্তাব করতে। সরকারের যথাযথ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে তাদের সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তীতে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই ‘আদিবাসী’ শব্দটি রহিত করে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি বা উপজাতি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, যা এখন সকলের মেনে চলাই শ্রেয়।

২০১১ সালে চট্টগ্রামে ২৪ পদাতিক ডিভিশনে চাকরির সুবাদে অনন্য ও বিস্ময়কর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। স্বচক্ষে দেখেছি, বাংলাদেশের স্বনামধন্য এবং সুশীল হিসেবে পরিচিত কিছু ব্যক্তি, INGO, NGO ও বামপন্থী লোকজন হয়তো টাকার(?) বিনিময়ে কীভাবে দেশের বিরূদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দোহাই তুলে সরকারের ও আইনশৃংখলাবাহিনীর কার্যক্রমের বিরূদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। গুইমারার এক ছোট্ট মেয়ের গায়ে রং মাখিয়ে ছবি তুলে তাকে অত্যাচার করা হয়েছে বলে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর কটাক্ষ করা হয়েছিল। জিওসিকে ডিভিশন সদরে চার্জ করেছেন। ঐ সকল তথাকথিত মানবাধিকার কর্মীদের যখন সব প্রমাণসহ ঘটনার মূল চিত্র দেখানো হলো, তখন সেসব দেশদ্রোহীদের ষড়যন্ত্র নিমিষেই চুকিয়ে গেলো। সচেতনমহল ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের এই হীন উদ্দেশ্য, অর্থায়নের উৎস এবং আঞ্চলিক দলগুলোর অহরহ চাঁদাবাজি ও অপকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আরেকটি মূল সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা। পার্বত্যচুক্তি অনুযায়ী সরকার ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন ২০০১ আইন ও তার সংশোধন (২০১৬) করে দিয়েছে। ভূমি কমিশন গঠন করা হলেও বিভিন্ন আইনি জটিলতা, কমিশন চেয়ারম্যানের (একমাত্র বাঙালি) ক্ষমতা, ভূমি জরিপ করার সিদ্ধান্ত, বাঙালি ও উপজাতি জনগোষ্ঠির সুষম প্রতিনিধিত¦, জমির প্রকৃতি, জমির মালিকানা নির্ধারণ ইত্যাদি বহুবিধ কারণে কমিশন অদ্যাবধি উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ করতে পারেনি। ভূমি সমস্যারও সমাধান হয়নি। সরকার সারা দেশের ভূমি জরিপ করতে পারলেও বিভিন্ন বাধার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো জরিপ করতে পারেনি। চলমান পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক রাজনীতিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠির একাংশ আগ্রহী ও ব্যস্ত। আগ্রহের মূল কারণ অর্থ-সম্পত্তি এবং ক্ষমতার লোভ ইত্যাদি। অর্থ লাভের মূল উৎস চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা, মুখ বন্ধ রাখার শর্তে অর্থ লাভ, টেন্ডারবাজি, বিদেশে স্কলারশিপ পাইয়ে দেয়া সংক্রান্ত ঘুষ, জমি বা সম্পদ দখল বা উদ্ধারে চাঁদাবাজি ইত্যাদি। আঞ্চলিক রাজনীতির মধ্যেও বহুদ্বা বিভক্ত পাহাড়ি জনগোষ্ঠি। মতানৈক্যের মূল কারণ অর্থ-সম্পত্তি ও তৎসম্পর্কিত ক্ষমতা লাভ। চাঁদাবাজির ব্যপ্তি পাহাড়ি নিরীহ কলা বিক্রেতা থেকে শুরু করে দোকান, যানবাহন, বাঁশবিক্রেতা, কন্ট্রাক্টর, কৃষক, পেশাজীবী পর্যন্ত বিস্তৃত। এক সময় এই চাঁদার টাকা অঞ্চল ভিত্তিক প্রতিনিধির মাধ্যমে উত্তোলিত হলেও বর্তমানে চাঁদা আদায়ের নতুন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিকাশ, নগদ ও রকেটের মতো প্রযুক্তি। তার মানে হচ্ছে এখন আর চাঁদা হাতে হাতে প্রদান করতে হয় না। এর উপরে রয়েছে জাতিগত বৈষম্য। চাকমা জনগোষ্ঠি অন্য সকল জনগোষ্ঠির চেয়ে অধিক সুবিধাভোগী। তারপর রয়েছে মারমা, ত্রিপুরা ও অন্যান্যদের অবস্থান। তাদের এমন জাতিগত বৈষম্যের কারণে বম জনগোষ্ঠি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কুকি, খুমি, তঞ্চঙ্গা, খেয়াং, ম্রোসহ সুবিধা বঞ্চিত হওয়ায় গড়ে তোলে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)। এছাড়াও রয়েচে মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি)। আর্মড সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সাম্প্রতিক সময়ে তারা আবার মুসলিম জঙ্গি সংগঠনের সাথে আঁতাত করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে খবরে প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন করার কথা ছিল সরকারের, যার অধিকাংশ ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। পক্ষান্তরে চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ২টি ধারা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। এক. সকল অস্ত্র জমা দেওয়া; দুই. সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা। দুটি শর্তের মধ্যে তারা একটি শর্তও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করেনি। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের পর যে কোনো অস্ত্রধারী অবৈধ (যদিও তারপূর্বেও অবৈধই ছিল)। শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের সংখ্যা কমে যাওয়াতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তার সুযোগ নিচ্ছে এই আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সশস্ত্রশাখা। সুযোগ পেলেই এক দলের সশস্ত্রশাখা অন্যদলের কর্মী সমর্থকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তিন পার্বত্য জেলাকে মোটামুটি তারা ভাগ করে নিয়েছে নিজ নিজ নিয়ন্ত্রিত এলাকা রূপে। নিরীহ সাধারণ পাহাড়ি বা বাঙালি তাঁদের স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা বা জীবিকা অর্জনে প্রতিনিয়ত বাধা অথবা বিপদে পড়ছে। উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার পথে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই অপরাজনীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। ২০১১-১২ সালেও থানচির দক্ষিণে অতি দুর্গম লিক্রি, পানঝেরী ইত্যাদি স্থানে পপি চাষ হতো। থানচি থেকে ওইসব এলাকায় পায়ে হেঁটে এবং নৌকায় পৌঁছাতে প্রায় দুই দিন সময় লাগত। বছরে কমপক্ষে দুই বার আমরা পপি চাষ ধ্বংসের জন্য অপারেশন করেছি। পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্ত পরিবেশকে কতিপয় স্বার্থন্বেষী মহল স্বীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থে অশান্ত করে তুলেছে। অথচ, এখন হাঁটতে হবে উন্নয়নের পথে, হাটতে হবে ‘ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটির’ পথে, সম্প্রীতির পথে। তবেই অর্জিত হবে প্রত্যাশিত লক্ষ্য।

প্রত্যাশা

পার্বত্য চট্টগ্রাম (বাংলাদেশের এক দশমাংশ) বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা কোনো পরিস্থিতিতেই আপোস করা যায় না। বাংলাদেশের কোনো অংশকেই বিদেশি সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থল করতে দেয়া যাবে না। একই সাথে দেশের অভ্যন্তরের কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে পাহাড়ি সন্ত্রাসী অথবা পার্শ্ববর্তী দেশের সন্ত্রাসীদের সাথে হাত মিলাতে দেয়া যাবে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতিদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক স্বত্তা রয়েছে। তাদের স্বত্তার শুধু স্বীকৃতি নয়, চর্চারও সুযোগ দিতে হবে। যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে তাদের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠি (পাহাড়ি-বাঙালি) মিলেমিশে থাকবে। প্রত্যেকে বাংলাদেশের নাগরিক এবং সকলের সমান অধিকার থাকবে। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী যে কোনো নাগরিকের যেমন বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যে কোনো সম্পদের মালিক হবার অধিকার আছে, বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের পার্বত্য অঞ্চলে বৈধভাবে সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকার রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী পিছিয়ে পড়া প্রতিটি জনগোষ্ঠি, প্রতিটি নাগরিক সম্ভাব্য সকল নাগরিক সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। উপজাতিদের মধ্যেও যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি তাদের সার্বিক উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে কেএনএফ এর মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। কেএনএফ আবার পার্শ্ববর্তী দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠির সাথে হাত মিলিয়ে এ অঞ্চল অশান্ত করে তুলতে পারে।

নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আঞ্চলিক ক্ষুদ্র বা স্বীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে সকল আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষিত সমাজ, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, ধর্মীয় নেতাসহ সকল সচেতন নাগরিকের। প্রত্যেকের একটাই লক্ষ্য হওয়া দরকার, কীভাবে সবাই সবার সাথে হাত মিলিয়ে এ অঞ্চলের অবকাঠামোগত, সামাজিক, পরিবেশগত, প্রশাসনিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন করা যায়। বয়কট করতে হবে অস্ত্রধারীদের, হীন স্বার্থ চরিতার্থকারীদের, চাঁদাবাজদের, সন্ত্রাসীদের, বৈষম্য সৃষ্টিকারীদের, উন্নয়নে বাধা সৃষ্টিকারীদের, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব হরণে ষড়যন্ত্রকারী অপশক্তিদের, শান্তি বিনষ্টকারীদের। সাধারণ নিরীহ মানুষ অস্ত্রের ঝলকানি দেখতে চায় না। ঘুষ, চাঁদা দিতে চায় না। মুখ ফুটে তাদের মনের কথা বলতে চায়। স্বীয় উৎপাদিত পণ্য নির্বিঘ্নে, নিশ্চিন্তে, ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে চায়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পেতে চায় সকল নাগরিক সুবিধা। তবেই হবে আমাদের শান্তির পার্বত্য চট্টগ্রাম।

লেখক: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা, শান্তিচুক্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন