বাংলাদেশে সাংবাদিকতা কোন পথে?

fec-image

ছোট বেলা থেকে সাংবাদিক-সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে আমার আগ্রহ। পড়া লেখার পাশা-পাশি নব্বই দশকে প্রথমে আমার লেখালেখি ছিল খাগড়াছড়ি থেকে প্রকাশিত সপ্তাহিক পার্বতীর চিঠিপত্র কলামে। প্রবীন সাংবাদিক তরুন কুমার ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় প্রকাশিত ওই পত্রিকায় প্রায়ই আমার লেখা ছাপা হতো। আর দারুন মজা পেতাম। একই সাথে ঢাকার জাতীয় দৈনিক দিনকালে নিউজ পাঠানো শুরু করলাম। নিউজ পাঠাতাম নিয়মিত। আমার পাঠানো নিউজ কখনো কখনো লিড হতো। দারুন উপভোগ করতাম। তখন জেলার রামগড় থেকে গুরুত্বপূর্ণ নিউজ পাঠাতাম টেলিফোনে। রামগড় টেলিফোন অফিসের স্টাফ কালাম ভাই সহযোগিতা করতেন।

তবে নিউজ পাঠানো ছিল চরম কষ্টের। গুরুত্বপূর্ণ নিউজ থাকলে সন্ধ্যার আগে টেলিফোন অফিসে গিয়ে হাজির হতাম। শুধু আমি একা নয়, দৈনিক ইত্তেফাকের প্রয়াত প্রতিনিধি সুবোধ বিকাশ ত্রিপুরা, গিরিদর্পনের দীনেশ সরকার, বর্তমানে খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের মুহাম্মদ, বাংলার বানীর মিলন ও দৈনিক পূর্বকোণের নিজাম উদ্দিন লাভলু প্রায় প্রতিদিন রামগড় টেলিফোন অফিসে হাজির হতাম।

নিউজ পাঠানোর জন্য রামগড় টেলিফোন অফিস থেকে প্রথমে খাগড়াছড়ি, তারপর রাঙামাটি, তারপর চট্টগ্রাম টেলিফোন অফিস হয়ে ঢাকা পত্রিকা অফিসে নিউজ পাঠাতাম। নিউজ অর্ধেক পাঠানোর পর লাইন কেটে যেত। আবার বসে থাকতাম লাইন পাওয়ার অপেক্ষায়। নিউজ পাঠাতে গিয়ে কখনো কখনো রাত ১২টা বেজে যেত। পরের দিন সকালে পত্রিকার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। কি পাঠালাম আর কি ছাপা হলো তা দেখার জন্য। পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখতাম নিউজ ছাপানো হয়েছে গুরুত্বসহকারে, তবে অজস্র বানান ভুল। আর বর্তমানে নিউজ পাঠানো কত সহজ। আছে ইন্টারন্টে, ভাইভারসহ কত মাধ্যম। এক মিনিটে নিউজ চলে যাচ্ছে স্ব স্ব অফিসে। নিউজ লেখতেও হয়না। অন্যের নিউজ কপি করে পাঠানো যায়।

১৯৯২ সালে শিক্ষা জীবন শেষ করে চলে আসলাম খাগড়াছড়ি জেলা সদরে। দৈনিক দিনকালের পাশাপাশি ১৯৯২ সালে যোগ দিলাম চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক ঈশান পত্রিকায় জেলা প্রতিনিধি হিসেবে। তখন বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে খাগড়াছড়ি ছিল সারা বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে দেশি-বিদেশী বিখ্যাত সাংবাদিকরা খাগড়াছড়ি আসতেন-থাকতেন।

১৯৯৭ সালে যোগ দিলাম দৈনিক ইনকিলাবে। ২০০৫ সালে নিয়োগ পেলাম বৈশাখী টেলিভিশনে। শুরু হলো নতুন অভিজ্ঞতা। নিউজের সাথে ফুটেজ পাঠানো। ডাক যোগে পাঠাতাম নিউজ আর ক্যাসেট। ২০১০ সালে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল বাংলাভিশনে যোগ দিলাম। এরপর যোগ দিলাম কবীর ভাইয়ের সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে প্রাকাশিক দৈনিক সাঙ্গু পত্রিকায়। এছাড়াও কাজ করেছি শীর্ষ নিউজ ও দ্যা রিপোর্টসহ বেশ কয়েকটি অনলাইনে।

১১/১ এর জরুরী সরকারের আমলে রাজধানী ঢাকায় দুই বছর সাংবাদিকতা করেছি। সে সময় বিএনপির সাবেক মহাসচিব জনাব দেলোয়ার হোসেন, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, প্রয়াত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক উল হকসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাতকার নেওয়ার সুযোগ হয়েছে।

এতক্ষন তো শুধু নিজের অভিজ্ঞতা আর গুনকীর্তন করলাম, এখন বলি কেন আমার হঠাৎ করে এমন লেখার অবতাড়না।

আমার সাংবাদিকতা পেশা নব্বই দশকে শুরু হলেও খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সদস্য পদ পেয়েছি ২০০১ সালের নভেম্বরে। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জনাব তরুন কুমার ভট্টাচার্যের কাছে। আমি যখন খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি, তখন সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচজন। সে প্রেসক্লাবে এখন সদস্য সংখ্যা ১৯ জন। প্রেসক্লাবের বাইরে আছে আরো অন্তত তিন ডজন সাংবাদিক। যাদের মধ্যে অনেকে আছেন জনপ্রিয় গণমাধ্যমের সাথে জড়িত। তারাও হয়তো ধীরে ধীরে একদিন খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবে সদস্য পদ লাভ করবেন। কিন্তু কথা সেখানে নয়। বর্তমানে সাংবাদিকতার নামে যেভাবে অপ-সাংবাদিকতা চলছে, নিজেকে সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে।

সম্প্রতি আমার ফেসবুক ওয়ালে দেওয়া স্ট্যাটাসের প্রেক্ষিতে (গলায় কার্ড ঝুলিয়ে স্বয়ং সম্পাদক মহোদয় খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবে হাজির। সাথে তার জেলা প্রতিনিধি। তাকে খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবে সদস্য পদ দিতে হবে। নাম ভাঙ্গলেন ঢাকার অনেক বিখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদকের । বাদ যায়নি জিটিভির মালিক মাননীয় সংসদ সদস্যের নামও। সম্পাদক মহোদয়ের হুংকার দেখে সিনিয়র সাংবাদিক দীলিপ চৌধুরী ভয়ে চলে গেলেন পাশের রুমে। আমিও ভয়ে কাঁপছি। কিন্তু উঠার সাহজ পাচ্ছি না।

অপনারাই বলেন, এত পদের বাহার যার তাকে কি অসম্মান করা যায়? অনেক তর্ক করে মাননীয় সম্পাদক মহোদয় চলে গেলেন। এখন ভয় পাচ্ছি আমার চাকুরিটা চলে যায় কিনা। যারা সাংবাদিকতা করতে চান, তাদের এ মহান ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করছি)

স্ট্যাটাসের প্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সভাপতি জনাব জীতেন বড়ুয়া লিখেছেন,“ আমাকে ডাকো নাই কেন? কত বড় সাংবাদিক তখন তাকে বুঝাইয়া দিতাম”।

খাগড়াছড়ি প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক লিখেছেন, “এ ধরনের প্রতারকদের জন্য সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশা আজ কলংকিত হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে কার্ড ধরিয়ে দিচ্ছে রাস্তার হকার থেকে শুরু করে টমটম চালক, কাঠ মেস্ত্রী থেকে শুরু করে রাজমেস্ত্রী। জেলা প্রতিনিধি, ক্রাইম রিপোর্টার আর বিশেষ প্রতিনিধিরা তমকাধারীরা এ প্রতারকরা সর্বত্র বিচরন করছে। হুমকীদাতা, টাকা দাবীকারী আর টাকার বিনিময় কার্ড বাণিজ্যকারী এ প্রতারকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ধরিয়ে দিন”।

সাংবাদিক এইচএম ফারুক লিখেছেন, “ভাই গত কয়েকবার খাগড়াছড়ি গিয়ে দেখলাম নানা কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের এমআর, এসআর রা কার্ডধারি কথিত সাংবাদিক। নানা দোকানে অর্ডার নিতে গিয়ে দেখি স্বগৌরবে পরিচয় দেয় “সাংবাদিকতাও করি”! আহ সাংবাদিকতা”।

সাংবাদিক এমডি হাসান লিখেছেন, সম্প্রতি অত্র জেলায় সাংবাদিক নামধারী দোকানীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গেছে। মাটিরাঙ্গার মতো উপজেলায় স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন অনেকে ব্যু্রাে অফিস খুলে বসেছে। আর কত এদের দৌরাত্ম্য? খাগড়াছড়ির সিনিয়র সাংবাদিকদের নেতৃত্বে এ পেশায় অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিহত করার সময় এসেছে।

হৃদয় নুরু লিখেছেন. “তিনি যে ধান্দাবাজের সভাপতি বুঝতে বাকি নাই। এই সব কুলাংগারদের জন্যই, এই পেশা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।

শিক্ষাবিদ চম্পানন চাকমা লিখেছেন. “যারা পেশাধারী সাংবাদিক মানুষ তাদেরকে এমনিতেই চিনে। আর তার কার্ড দেখে আমি যা বুঝলাম সে একটাও জাতীয় দৈনিকের নাম ব্যবহার করেনি। তার মানে সে কোন জাতীয় দৈনিকের জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধিও নয়।সম্ভবত যে পত্রিকার নাম ব্যবহার করেছে সেগুলো স্থানীয় পত্রিকা বা অনলাইন পত্রিকা।বাংলাদেশ প্রতিদিন নামে একটা জাতীয় পত্রিকা আছে। কিন্তু তাঁর কার্ডে দেখলাম প্রতিদিন বাংলাদেশ। আরেকটা লক্ষ্য করলাম যে পত্রিকার নাম ব্যবহার করেছে, সেসব পত্রিকার সে কি জেলা বা উপজেলা প্রতিনিধি কিছুই উল্লেখ নাই। আর একুশে নিউজ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক উল্লেখ করেছে। সেটা কি অনলাইন পত্রিকা নাকি প্রিন্টের পত্রিকা।আমার জানা নেই। কালীগঞ্জ হল গাজীপুরের একটা উপজেলা।

দিদারুল আলম লিখেছেন,“ব্যাপার হলো ভূঁইফোড়রাই কীভাবে কীভাবে যেনো ম্যানেজ করে নেয় আমাদের সমাজপতিদের। আর যারা তেলবাজ কিংবা চাটুকার নয় তাদের অনেককেই লোকে সাংবাদিক হিসেবে অযোগ্যভাবে। শুনতে খারাপ লাগলেও একথাই সত্য যে, আমাদের বর্তমান যে রাষ্ট্রীয় নীতি কিংবা সমাজব্যবস্থা তাতে যোগ্যতম কেউ আর সাংবাদিকতায় আগ্রহবোধ করে না। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন ভাইয়া”।

বান্দরবানের কৃতি সন্তান বিশিষ্ট সাংবাদিক বদরুল ইসলাম মাসুদ লিখেছেন,“ ভাই, আমি তো ভিজিটিং কার্ড দেখেই কাঁপতাছি, আবার ভাবতাছি- স্যারের সাথে যোগাযোগ করে যদি একখান চাকরি মিলে যায়, তাহলে খাগড়াছড়ি না হয় মহালছড়ি প্রেসক্লাবের সদস্য পদের একটা সুযোগ হলেও হতে পারে! এই ভদ্রলোকের দেখা পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার”!

সাংবাদিক ফরিদ আহমেদ লিখেছেন.“এমন গুনীজনের সাথে আমাদের পরিচয় না করালে চাকুরী থাকবে কিভাবে? ধন্যবাদ পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য”।

সাংবাদিক মুজিবুর রহমান ভূইয়া লিখেছেন,“ভাই তিনি তো ইতিমধ্যে মাটিরাঙ্গায় কিছু লোককে টাকার বিনিময়ে কার্ড ঝুলিয়ে দিয়ে ব্যুরো অফিস খুলেছেন ..। এখানে ব্যুরো চিফ, স্টাফ রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি, ক্রাইম রিপোর্টার, উপজেলা প্রতিনিধি, সদর থানা প্রতিনিধি নিয়োগ দিয়েছেন! জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে ক্রাইম রিপোর্টার থাকে তা আমি কখনোই শুনিনি। তবে ওনার মতো দোকানীর মাধ্যমে তা দেখলাম।”

সাংবাদিক আলমগীর হোসাইন লিখেছেন, “ইতি মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলায় ও বিভিন্ন উপজেলায়, চা-দোকানি, সেলসম্যান, আইসক্রিম বিক্রেতা সহ অনেক পদের কাবিল। সাংবাদিক পেশায় এসেছেন। এই পেশার বারটা বাজতে শুরু হয়েছে”। আমার দেওয়া এই স্ট্যাটাসে এই পর্যন্ত ৭৫টি কমেন্ট/মন্তব্য, ৫১ জন শেয়ার ও ৬০টি লাইক পড়েছে।

সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। সাংবাদিকতাকে বলা হয় রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ যাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রের উন্নয়ন কল্পনা করা যায় না। কিন্তু আজকে কিছু নামধারী সাংবাদিক মহান পেশাটিকে কুলষিত করছে। এ নিয়ে আমাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে এগিয়ে আসা উচিত। না হলে ইজ্জত বাঁচাতে আমাদের এ পেশা ছেড়ে পালাতে হবে। রাষ্ট্র হবে ক্ষতিগ্রস্ত।

 

লেখক,
সাধারণ সম্পাদক
খাগড়াছড়ি টিভি জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন