“বান্দরবানে হত্যা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির নতুন আতঙ্কের নাম নাথান বম।”
সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফ সভাপতি নাথান বম

বান্দরবানের নতুন আতঙ্ক নাথান বম

fec-image

খুমি, লুসাই, খেয়াং, পাংখোয়া, ম্রো—এই পাঁচ সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের নামে জেএসএসের এক শীর্ষ নেতার হাত ধরে এবং তার প্রশ্রয়ে কেএনএফ প্রতিষ্ঠা করেন নাথান বম। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের নামে, মোটা অঙ্কের টাকা আয় করার উদ্দেশ্যে, গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন।

বান্দরবান জুড়ে নতুন আতঙ্ক সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সভাপতি নাথান বম। তার সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জড়িত। মূলত তিনি বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার (সন্তু লারমা) ছত্রছায়ায় রয়েছেন। শুধু চাঁদাবাজি নয়, ধর্ষণসহ নারী নির্যাতনের সঙ্গেও নাথান বমের সশস্ত্র বাহিনী জড়িত। তাদের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দুর্গম পাহাড়ে বর্তমানে জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউপিডিএফ (সংস্কার)—এই চার সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয়। এই চার সংগঠনের মূল কাজ চাঁদাবাজি এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। বান্দরবানে হত্যা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির নতুন আতঙ্কের নাম নাথান বম।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অধীনে থাকাটা মানতে পারছে না তারা। তাদের রয়েছে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। কোনো কিছু হলেই সীমান্তের ওপারে তারা আশ্রয় নেয়। খুমি, লুসাই, খেয়াং, পাংখোয়া, ম্রো—এই পাঁচ সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের নামে জেএসএসের এক শীর্ষ নেতার হাত ধরে এবং তার প্রশ্রয়ে কেএনএফ প্রতিষ্ঠা করেন নাথান বম। জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের নামে, মোটা অঙ্কের টাকা আয় করার উদ্দেশ্যে, গহিন অরণ্যে প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন। জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ প্রদানের চুক্তিও স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু সেই কেন্দ্রের প্রশিক্ষণ প্রদান বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারেননি।

র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে সেই প্রশিক্ষণ আস্তানা তছনছ হয়ে যায়। জঙ্গি প্রশিক্ষণ ধরা পড়ার পর নাথান বমের একের পর এক অপকর্ম বেরিয়ে আসে। অবৈধ অস্ত্র পাচারের সঙ্গেও তারা জড়িত। নাথান বমরা ছিলেন দিন এনে দিনে খাওয়ার মতো পরিবার।

এদিকে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ জানান, বান্দরবানে চার সন্ত্রাসী চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি এবং আধিপত্য বিস্তার লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের হাতে নিহত হওয়ার পর একটি ষড়যন্ত্রকারী মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অংশ হিসেবে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চাঁদাবাজিদের আখড়া আর সন্ত্রাসীদের স্বর্গরাজ্য।

প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে সন্ত্রাসী সংগঠনের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ ও প্রাণনাশের ঘটনা ঘটছে। তারই বাস্তব প্রমাণ হলো গত সোমবার বিকালে বান্দরবান পার্বত্য জেলার রোয়াংছড়িতে একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে প্রতিপক্ষ কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা। পরে ঘটনাস্থল থেকে তিন জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। নিহত সন্ত্রাসীরা হলেন নেমথাং বম এবং গণলাইনে কাজ করা মোটরসাইকেল নিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও বাজার বা রসদ সরবরাহকারী লাল লিয়ান ও সশস্ত্র চাঁদা কালেক্টর সিম লিয়ান। তারা সবাই বম সম্প্রদায়ভুক্ত। আর বমদের সব তরুণ প্রজন্মই কেএনএর সঙ্গে যুক্ত।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের অপপ্রয়াসে লিপ্ত সশস্ত্র সংগ্রাম করা ‘কেএনএফের’ সঙ্গেও এদের সরাসরি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।

স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি ও আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে রোয়াংছড়ি উপজেলার সদর ইউনিয়নের পাইখ্যংপাড়ায় পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ডেমোক্রেটিক ) কিংবা মগ নিবারেশন পার্টি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী কুকি চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)—এ দুটি সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলি হয়। সকালে সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দুই পক্ষের অস্ত্রধারীদের মধ্যে কয়েক দফায় থেমে থেমে শতাধিক রাউন্ড গুলিবিনিময় হয়। এদিকে গোলাগুলির পর ঘটনাস্থলসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ এলাকা ছাড়তে থাকে।

এ সময় স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে তিন জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ‘তিন জনের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী কেএনএর সঙ্গে সম্পৃক্ত নিহতরা। কেএনএফের সঙ্গেও কাজ করতেন তারা।’

অধিবাসীদের মধ্যে ডেবিট বম নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ‘নেমথাং বম, লাল লিয়ান ও সিম লিয়ান দীর্ঘদিন ধরে অত্র এলাকায় কেএনএর সোর্স, চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুমসহ নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার-জুলুম করে আসছিলেন। তারা কেএনএফ সন্ত্রাসীদের গণলাইনের সোর্স হিসেবে কাজ করেছিলেন, ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালানোর অন্তরালে তথ্য সংগ্রহ করে কেএনএফ গোয়েন্দা শাখার উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট ফ্লেমিংয়ের কাছে সরবরাহ করতেন এবং প্রায়ই তাদের সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে দেখা যেত। তাদের হয়ে রুমা বাজারে ও বর্ডার রোড প্রজেক্টের ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা কালেকশন করতেও দেখা গেছে বলে স্থানীয়রা জানান। তাদের বিগত বছরগুলোতে কেএনএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নাথান বমের সঙ্গে দেখা গেছে।

এছাড়া রুমা ও থানচি লিক্রিতে কেএনএফের জন্য রসদ, বাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহকাজে তারা নিয়োজিত ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্মাণশ্রমিক, ঠিকাদার ও পর্যটকেরা রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি সড়কে প্রবেশ করলেই তারা সেই তথ্য কেএনএফকে সরবরাহ করতেন। তাদের মধ্যে নেমথাং গোলাগুলির ঘটনার দেড় ঘণ্টা আগে অস্ত্রসহ মোটরসাইকেলের মহড়া দেন।

ডেবিট বমের বর্ণনা অনুযায়ী, যারা নিহত হয়েছেন তারা কেএনএফের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তারা মূলত মোটরসাইকেল ভাড়ায় চালানোর অন্তরালে গণলাইনের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন এবং চাঁদা কালেকশনসহ রসদ সরবরাহকাজে তারা যে নিয়োজিত ছিলেন তার সত্যতা পাওয়া গেছে।

এছাড়া স্থানীয়রা ও পুলিশ সূত্রে খবর পাওয়া যায়, নিহত সন্ত্রাসীদের লাশ ময়নাতদন্ত শেষ করার পর কেউ নিতে আসেনি। তাই লাশ মর্গে দীর্ঘক্ষণ রেখে দেওয়া হয়। নিহতরা কেএনএফের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই মামলার ভয়ে কেউ লাশ নিতে আসেনি, এটা সুস্পষ্ট। নিহত সন্ত্রাসীদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর পাড়া হেডম্যানের কাছে লাশ পৌঁছানো হয়।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে স্থানীয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সশস্ত্র সন্ত্রাসী দুই গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পাড়া হেডম্যানের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়।

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আতঙ্ক, কেএনএফ, নাথান বম
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন