ভুটানের ইকোট্যুরিজম হতে পারে আমাদের পার্বত্য পর্যটনের মডেল
আমাইন বাবু::
ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির কারণে সমতল ভূমি বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণ পূর্বাঞ্চল আর দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি জনপদ। দেশি তো বটেই এমনকি বিদেশি অতিথিদের বাংলাদেশ ভ্রমণের পছন্দ শীর্ষে পার্বত্য জনপদ। প্রশ্ন হচ্ছে, পাহাড় বলতে কতটুকু জায়গা বোঝেন পর্যটকরা? এখানে দুটো অংশ আছে; এক. ট্যুরিস্ট, দুই. ট্রাভেলার। যারা কেবল নির্দিষ্ট গণ্ডিতে নির্ধারিত সুযোগ-সুবিধায় ঘুরে বেড়ান এবং নির্ধারিত সময়টুকু নিরুপোদ্রব কাটানোর প্ল্যানে ঘর ছাড়েন তারা মূলত ট্যুরিস্ট। সেক্ষেত্রে পরিবার কিংবা একা অথবা দল বেঁধেও ট্যুরিস্ট প্লেসে যাওয়া চলে। অন্য পক্ষটি অফবিট। প্ল্যান বলতে কেবল রুট প্ল্যান থাকে অথবা নাও থাকতে পারে। এরা যেখানে রাত সেখানে কাত টাইপের। ব্যাকপাকার এই ঘুরিয়েদের ট্রাভেলার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলত এই দুই শ্রেণিকেই পর্যটনের প্রাণ হিসেবে ধরা হয়। তাদের ঘিরেই যত পরিকল্পনা আর কথাবার্তা বিশ্বজুড়ে।
বাংলাদেশে আশির দশকের শেষভাগে সমতলের মানুষের যাতায়াত, বাণিজ্য এবং নিরাপত্তাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফলে নির্মিত সড়ক উন্মুক্তকরণের অংশ হিসেবে ট্যুরিস্ট জোন বা হিল ট্র্যাক ট্যুরিজমের আইডিয়ার যাত্রা। যার ফল আজকের নীলগিরি, সাজেক, ঝুলন্ত ব্রিজ বা বগা লেক। এসবই এক ধরনের ম্যান মেড ট্যুরিজম। অপরদিকে, ১৯৯১-৯৫ সালের দিকে বাংলাদেশে অদম্য কয়েক যুবকের হাত ধরে ট্রাভেলিংয়ের যাত্রা শুরু। এই দুই ধরনের ভ্রমণের মধ্যে দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে ঝুঁকি ও ঝক্কি দুটোই বেশি এবং ভিন্নতর বটে। কেননা, ট্যুরিস্ট যেখান পর্যন্ত যেতে পারে, সেখান থেকে ট্রাভেলারের যাত্রা শুরু হয় পার্বত্য অঞ্চলে। এমন বেশ কিছু ভিন্নতার কারণে পাহাড়ে পর্যটন কিছুটা চ্যালেঞ্জিং।
মোটা দাগে পাহাড়ে যেতে দুই ধরনের বাধার সম্মুখিন হতে হয় ট্রাভেলার বা ট্যুরিস্টদের।
১. প্রাকৃতিক
২. মনুষ্য সৃষ্ট
বর্ষা, ভূমি ধস, ম্যালেরিয়াসহ বেশকিছু প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ ট্যুরিস্ট এবং ট্রাভেলারদের অন্তরায়। এক্ষেত্রে ট্যুরিজম বন্ধ রাখা হয় অথবা বলা ভালো নিরুৎসাহিত করা হয় সাময়িক সময়ের জন্য। প্রাকৃতিক এই বাধা উপেক্ষা করেও ট্রাভেলারদের কেউ কেউ পাহাড়ে চলে যান। সেক্ষেত্রে ট্রাভেলারদের জন্য পাহাড়ে অবস্থানের প্রতিটি মুহূর্তই অধিক চ্যালেঞ্জের। খাদ্য, নিরাপত্তা এবং রাত্রিযাপনের প্রশ্নটা আরও বড় করে দেখা দেয়। বিশেষত, ম্যালেরিয়া প্রবণ এলাকা হওয়ায় লালমাটির পাহাড়ে সংকট বড় হয়ে দেখা দেয়। বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের সময় এ সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। এটা প্রকৃতির এক ধরনের বাধা, যা উতরে যেতে হয়। এক্ষেত্রে পর্যটক হিসেবে শুধু চোখের দেখা নয়, বিশেষ কিছু দক্ষতায় টিকে থাকার কৌশল জানা চাই। বাধা অতিক্রমের মানসিকতা তৈরিতে পাহাড় আরাধ্য ভ্রমণ কেন্দ্র। আজকের মুসা, মুহিত, নিশাতসহ যারা এ অঞ্চলের পাহাড় এমনকি সেভেন সামিট সম্পন্ন করেছে তাদের নেশার বীজ বপন হয়েছিল রাঙ্গামাটি, বান্দরবানের পাহাড়ে। অথচ ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি কী অসহায়ত্বের সাথে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে পাহাড়ের ভ্রমণকে! এটাই মনুষ্য সৃষ্ট বাধা।
আমরা যারা পাহাড়ে হাইকিং, ট্রেকিং, এক্সপেডিশন বা ক্যাম্পিংয়ের জন্য যাই তাদের প্রতিনিয়ত সমতলের অযাচিত অতিথি হিসেবে পরিগণিত হতে হয়। বাধা আসে তথাকথিত পাহাড়ি কিছু আঞ্চলিক সংগঠন আর নিরাপত্তাবাহিনীর পক্ষ থেকে। দুই পক্ষই যার যার মত ব্যাখ্যায় ট্রেকিং নিরুৎসাহিত করে যাচ্ছে। তারপরেও পর্যটকদের যত পরিকল্পনা হালের ক্রেজ সাজেক বা অন্যতম আকর্ষণ নীলগিরি, চিম্বুককে ঘিরে। প্রশ্ন হচ্ছে, পাহাড় কি সত্যি পর্যটনবান্ধব হয়েছে?
সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ভারতের দার্জিলিং, কালিম্পং পাহাড় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে স্বায়ত্বশাসন, পাঠ্যবই, বাংলার ব্যবহারসহ বেশিকিছু ইস্যুতে। কিন্তু গোর্খাদের পর্দার আড়ালের দাবিটা আজীবনই স্বাধীনতার পক্ষে। একই চিত্র বান্দরবান সীমান্ত ঘেঁষা মিয়ানমার, ভারতের মিজোরাম, মনিপুর, ত্রিপুরা, আসামসহ সবখানে। মোদ্দাকথা পাহাড় যেখানে, সেখানে একপক্ষ তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে সোচ্চার। অপরদিকে প্রতিটি জায়গায় তা দমন করার জন্য প্রস্তুত সরকারের সামরিক বা আধাসামরিক বাহিনী। বাংলাদেশও এই সূত্রের বাইরে যায়নি। বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের ভুল চালে বিভেদের দেয়াল উঠেছে পাহাড়ে। যা ভাঙা যাচ্ছে না শত চেষ্টায়। আস্থার এই সংকটটা মানসিক। এ অবস্থায় চার দশক পাড় করেছি আমরা। দেরিতে হলেও পাহাড়ের মানুষ বুঝতে শুরু করেছে; দরজা, জানালা বন্ধ করে রাখাটা সমাধান নয়। বরং উন্মুক্ত বাতায়নে বন্ধুতার সুবাস নেয়াই শ্রেয়। সমতলের নাগরিকের ভাবনায়ও পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু তারপরও সমস্যা আছে, থাকবে।
আমাদের পাহাড়ে সংকট তীব্র হচ্ছে যতটা না মানবিক কারণে, তারচেয়ে অনেক বেশি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণে। পাহাড়ে পর্যটনের জন্য থ্রিজি-ফোর জি নিয়ে গেছি আমরা। বুক চিতিয়ে বিলাসবহুল কোচ চালাচ্ছি। কিন্তু পর্যটন বান্ধবতা এবং প্রাকৃতিক সুরক্ষার কথা কতটুকু ভাবছি? পাহাড়ে যে ধরনের গাছ থাকার কথা তা কি আছে? বাণিজ্যিক বনায়ন কার স্বার্থে? প্রশাসনের ভেতর আরেক প্রশাসনের জন্ম দিয়ে পাহাড়ি সংগঠনগুলো যে কাঠের বাণিজ্যে মশগুল, তার জন্য দায়ী কে? কেননা কাঠ, বাঁশের চাঁদাবাজি নিয়ে যতবার উত্তপ্ত হচ্ছে পাহাড় ততবার বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে রুমা বা থানচির রুট। মাঝপথে আটকে সময় আর অর্থের শ্রাদ্ধ দেখতে হচ্ছে। টাকা খরচ করে যে মানুষগুলো অবসরে পাহাড়ে যাচ্ছে তাদের সুন্দর সময়ের বদলে একরাশ তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে হচ্ছে।
এজন্য দায়ী মূলত:
১. অযাচিত শর্ত;
২. পাহাড়ি সংগঠন বা শ্রেণিগুলোর চাঁদাবাজি এবং এই আধিপত্য ধরে রাখার দ্বন্দ্ব;
৩. জিম্মি বাণিজ্য এবং
৪. কাঠ, বন্যপ্রাণীসহ প্রকৃতিক সম্পদের বাণিজ্য লিপ্সা
যে লালসা আর লাভালাভির কারণে পাহাড়কে পুঁজি করা হচ্ছে, ব্যবহার করা হচ্ছে তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে পার্বত্য অঞ্চলের পর্যটনে। লোভের কুঠারে ক্ষত বিক্ষত পাহাড় দিন দিন শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। বন্য জন্তু, গাছ, পাখি বিরল থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে। তাতে আকর্ষণ হারাচ্ছে পর্যটন। অথচ পাহাড়ের পর্যটন ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিলে, যত্নবান হলে তা কয়েকগুণ হারে ফিরিয়ে দেবে প্রকৃতি। এক্ষেত্রে ভারত কিংবা নেপাল নয় আমার মতে, পার্বত্য পর্যটনের উদাহরণ বা মডেল ধরতে হবে ভুটানকে। সেখানকার অবকাঠামো ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা সর্বোপরি ইকো ট্যুরিজমের কনসেপ্ট নিঃসন্দেহে টেকসই পর্যটনের জন্য আদর্শ। সমতল ভূমি, উপত্যকা, হ্রদ, মেঘ সবমিলিয়ে সামঞ্জস্য কিছুটা ধরতে হলে ভুটানের মতো স্মাইলি দেশকেই ধরতে হবে। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকাগুলোকে ওই আদলে সাজানো গেলে ইকো ট্যুরিজম ধারণার বাস্তব প্রতিফলন সম্ভব। সেই সাথে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় সম্ভব পার্বত্য তিন জেলা থেকে।
লেখক: সাংবাদিক ও পরিব্রাজক
সূত্র: পাক্ষিক পার্বত্যনিউজ, বর্ষ ১, সংখ্যা ২ ও ৩