সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু তিনবার সফর করেছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম

fec-image

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতি ও বাঙালি জাতির প্রাণ পুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। রাত দিন পরিশ্রম করেছেন, যাতে দ্রæতই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারেন। সেই লক্ষ্যে তিনি প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো জেলা, থানা সফর করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সাড়ে তিন বছর শাসনকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছেন তিনবার। ১৯৭৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম তিনি রাঙামাটি সফর করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ও একই বছরের ১৪ জুন রাঙামাটি সফর করেন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বল্প সময়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনবার পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেছেন এবং এখানকার পিছিয়ে পড়া লোকজনদের জীবনমানের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর গৃহীত সেসব পদক্ষেপ থেকেই বোঝা যায় তিনি কতটা উদারতা আর দূরদৃষ্টি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপলব্ধি করেছিলেন। একইসাথে পাহাড়বাসীর প্রতি তাঁর দরদ এবং মমত্ববোধও ফুটে উঠে। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু তিনবার পার্বত্য জেলা রাঙামাটি সফর করেছিলেন। এটা পার্বত্যবাসীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশাল উদারতা ও ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ।

বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাঙামাটি সফর

স্বাধীন দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। নির্বাচনী সফরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবারের মত রাঙামাটি সফর করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথমবারের রাঙামাটি সফর নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য দলে দলে লোকজন আসতে থাকে রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে। চাঁদের গাড়িতে করে, কেউবা বাসে চড়ে আবার অনেকেই পায়ে হেঁটে দূর-দুরান্ত থেকেও সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন। জলপথে লঞ্চ, স্টিমার, দেশি নৌকা ও সাম্পানযোগেও আসেন অনেকে। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য সেদিন মাঠ ভরপুর হয়ে লোকজন রাস্তায় এমনকি অনেকে গাছের ওপরেও উঠে বসে। বসন্তের মাতাল হাওয়ায় যেনো খুশির আনন্দও মিশে একাকার হয়েছিল। আর তাইতো সকল ধর্মের ও পাহাড়ে বসবাসরত সকল জাতিগোষ্ঠীর সব বয়সের নারী-পুরুষের ঢল নামে রিজার্ভ বাজার জুড়ে। এই যেন মানুষের উৎসবের বড় মিলনমেলা।

রিজার্ভ বাজারের পার্কের উত্তর পাশের্^ (বর্তমানে শহীদ আবদুল আলী একাডেমি ও স্কাউট ভবনের সামনে) বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়। দুপুরের আগেই জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান হেলিকপ্টারযোগে পদার্পণ করেন রাঙামাটিতে। রাঙামাটি কোর্ট বিল্ডিং মাঠে (বর্তমানে শহীদ আবদুস শুক্কুর স্টেডিয়াম) বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী হেলিকপ্টারটি অবতরণ করে। রাঙামাটির মাটিতে জাতির পিতার পা যখন পড়ে আর তখনই ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। হেলিকপ্টার থেকে নেমে বঙ্গবন্ধু হাত নেড়ে সবার অভিবাদনের জবাব দেন। এদিন ৫০ জন শিশুর অগ্রগামী একটি দল নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আবছার (তখন স্কাউট নেতাও ছিলেন) এবং উত্তরা রায় বঙ্গবন্ধুকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। বঙ্গবন্ধু শিশুদের আদর করেন। হেলিকপ্টার থেকে নামার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নেন। এরপর তিনি মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন। এসময় উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা নোয়াব আলী, সৈয়দুর রহমান, চারু বিকাশ চাকমা, নজির আহমদ তালুকদার, আলতাফ হোসেন, মুনসী মিয়া ডিলার, মো. জাকারিয়া প্রমুখ। মঞ্চের আশেপাশে সিকিউরিটি ফোর্স ছাড়াও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, দেশের সকল মানুষ সমান এবং সকলেরই সমানাধিকার রয়েছে। সকলেই বাংলা মায়ের সন্তান। বঙ্গবন্ধু এই মর্মে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন যে, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কাউকেই শোষণ করতে দেওয়া হবে না। এদিন রাঙামাটি, ফেনী ও লক্ষীপুরের তিনটি বিরাট জনসভায় ভাষণ দেবার সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, দেশের যে কোনো এলাকারই মানুষ হোক না কেন, সকলেই সমান এবং তিনি সকলকেই সমানভাবে ভালবাসেন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রথম রাঙামাটি সফর

১৯৭৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রথমবার রাঙামাটি সফর করেন। ১৯৭৩ সালে যখন তিনি রাঙামাটি সফর করেছিলেন তখন তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এই সময় জাতির পিতাকে বরণে ও তাঁর সম্মানে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়। কক্সবাজার থেকে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারযোগে রাঙামাটিতে আগমন করেন। এদিনও বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য ব্যাপক লোকের সমাগম ঘটে। পুরো শহর যেন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়।

বঙ্গবন্ধু বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারযোগে রাঙামাটি কোর্ট বিল্ডিং মাঠে (বর্তমান শহীদ আবদুস শুক্কুর স্টেডিয়াম) অবতরণ করেন। হেলিকপ্টার থেকে নামার পর বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে মাল্যভ‚ষিত করে অভ্যর্থনা জানান দু’জন শিশু। এরপর অভ্যর্থনা জানান আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে পরিচিত হন তিনি। পরিচয় পর্ব শেষে গাড়িতে ওঠার আগে বঙ্গবন্ধু সকলকে উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ালেন। সাথে সাথে বিপুল জনতা ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু, ‘জাতির পিতা দীর্ঘজীবী হোক’ ধ্বনি দিয়ে আনন্দে ফেটে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর গাড়ির বহর সার্কিট হাউজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পাঁচ কি.মি. সড়কে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে প্রায় দুই ডজনের মতো অপরূপ তোরণ নির্মাণ করা হয়। নারী-পুরুষ তাঁকে জানায় প্রাণঢালা অভিনন্দন আর রাস্তার দু’পাশ থেকে চলতি গাড়ির ওপর হতে লাগলো পুষ্পবর্ষণ। বঙ্গবন্ধু অভিনন্দনের জবাব দিলেন হাত নেড়ে। প্রতিটি জায়গায় স্কুলের ছেলেমেয়েরা রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো আর জাতির পিতাকে দেখে আনন্দ নৃত্য করছিল। সাথে সাথে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘জাতির পিতা দীর্ঘজীবী হোক’ ধ্বনি দিচ্ছিল। পথে পথে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও মুরং নাচ এবং দেশাত্ববোধক সঙ্গীতের আয়োজন ছিল। এদিন বঙ্গবন্ধু কাপ্তাই হ্রদে নৌ ভ্রমণ করেন। সন্ধ্যায় সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতির সম্মানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিন সার্কিট হাউজে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকজনের সাথে মতবিনিময় করেন।

রাঙামাটিতে বঙ্গবন্ধুর শেষ সফর

১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু আবারো রাঙামাটি সফর করেন। এই সফর ছিল রাঙামাটিতে তাঁর জীবনের শেষ সফর। বঙ্গবন্ধু এদিন দেশের প্রথম উপগ্রহ ভূÑকেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য জেলার বেতবুনিয়া সফর করেছিলেন। বহির্বিশ্বের সাথে টেলিযোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে দেশের প্রথম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র স্থাপিত হয় রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের মধ্যবর্তী বেতবুনিয়ায়। সাধারণ মানুষ এদিনও বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য বেতবুনিয়ায় ভিড় করেন। বঙ্গবন্ধুকে বরণে বেতবুনিয়াবাসীরও আয়োজনে কমতি ছিল না। বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ ভ‚-কেন্দ্র উদ্বোধনের আগে ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও বেতার মন্ত্রী কোরবান আলী, রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী তোফায়েল আহমেদ, ডেপুটি স্পিকার মোহাম্মদ বয়েতুল্লাহ, ডাক, তার ও টেলিফোন প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, হুইপ মোহাম্মদ হানিফ, কানাডীয় হাই কমিশনার, কূটনৈতিক মিশনের সদস্যবৃন্দ, স্থানীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ এবং বাকশাল নেতৃবৃন্দ ও পদস্থ কর্মকর্তাগণ। ভাষণের পর বঙ্গবন্ধু সুইচ টিপে উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র উদ্বোধন করেন এবং পরিদর্শন করেন। এসময় রাঙামাটি জেলার আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার সিনিয়র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু সুইচ টিপে উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের উদ্বোধন করে টেলিফোনে প্রথম কথা বলেন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনারের সাথে। প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীও কথা বলেন। তাঁদের কথোপকথন মাইকের মাধ্যমে লোকজনদের শোনানো হয়। জাতির জীবনের এই ছিল এক অবিস্মরণীয় দিন। বঙ্গবন্ধু এদিন বিকেলে কাপ্তাই যান এবং সেখানে দুই রাত অবস্থান করেন। ১৬ জুন তিনি ঢাকা ফিরে যান।

ইয়াছিন রানা সোহেল: লেখক, সংবাদকর্মী এবং ‘রাঙামাটিতে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক গ্রন্থের প্রণেতা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন