অব্যাহত বর্ষণে পাহাড়ধস: ঝুঁকিপূর্ণ বসতি থেকে সরে যেতে প্রশাসনের মাইকিং

fec-image

গত কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টির সঙ্গে থেকে থেকে ঝড়ো হাওয়া বইছে। এতে শহর-গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবনের পাশাপাশি ডুবছে চলাচলের পথও। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঝুপড়ি ও গ্রামের অনেক কাঁচা বাড়ি-ঘর বাতাসের ঝাপটায় উড়ে গেছে। এতে চরম দূর্ভোগে পড়েছে হতদরিদ্র ও পানি নিমজ্জিত এলাকার লোকজন। বিশেষ করে টেকনাফে ভারী বর্ষণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ডুবে গেছে প্রায় এলাকা।

এসবের মাঝে বর্ষণ অব্যাহত থাকায় আরও পাহাড় ধসের আশংকা করা হচ্ছে। এমন দুর্যোগে প্রাণহানি রোধে পাহাড় কেটে আবাস গড়া ঝুঁকিতে বাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে মাইকিং করেছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে টেকনাফ ও মহেশখালীতে পাহাড় ধসে ৪ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

টেকনাফে বর্ষণের ফলে পাহাড় ধসের ঘটনায় তিন শিশু নিহত ও আহত হয়েছে অন্তত ১০ জন। মঙ্গলবার ভোরে টানা ভারী বর্ষণে এ পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা দূর্যোগ প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) কর্মকর্তা আবদুল মতিন। নিহতদের মধ্যে দুজন হল-টেকনাফের পুরানপল্লান পাড়ার মুহাম্মদ আলমের মেয়ে আফিয়া (৫) ও একই এলাকার রবিউল হাসানের ছেলে মেহেদী হাসান (১০)। আরেক শিশু আবদুল গফুরের ছেলে মো: খায়রুল চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

অপরদিকে বুধবার সকালে মহেশখালীর কালামারছড়ায় বাড়ির দেয়াল ধসে সোমাইয়া আক্তার (১০) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় সোমাইয়ার মামা ও এক ভাই আহত হয়েছে। বুধবার সকাল ১০টায় কালামারছড়া ইউনিয়নের আধারঘোনা পাহাড়ি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। সুমাইয়া ওই এলাকার আবদুল গফুরের মেয়ে। কালারমারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান তারেক বিন ওসমান শরীফ বলেন, প্রবল বর্ষণের কারণে মাটির ঘরের চারদিকে পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ফলে ঘরের মাটির দেয়াল ধসে শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এ সময় তার এক ছোট ভাই রিয়াদ (১০) ও মা পারভীন আক্তার আহত হয়েছে।

এদিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের হিমছড়িতে পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটেছে। মাটি চাপায় আহত হয়েছে ১৮ জন। মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় এ ঘটনা ঘটে। পাহাড়ের মাটি পড়ায় মেরিনড্রাইভ সড়কে যোগাযোগ প্রায় ২ ঘন্টা বন্ধ ছিল।

সাংবাদিক আহমদ গিয়াস জানান, অতি বৃষ্টির কারণে মেরিন ড্রাইভ লাগোয়া পাহাড়ে ধ্বস হয়। এতে মাটি চাপা পড়ে যায় ১৮ জন। খবর পেয়ে দ্রুত তাদের উদ্ধার করতে সক্ষম হন সেনাবাহিনীর ১৬ ইসিবির সদস্যরা। আহতদের পরিচয় তাৎক্ষণিক পাওয়া যায়নি। সবাই গাড়ির যাত্রী ছিলো বলে ধারণা করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, গত কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যেকোনো মুহুর্তে ঘটতে পারে পাহাড় ধস ও প্রাণহানির ঘটনা। এ আশঙ্কায় পাহাড়ের পাদদেশ বা চুঁড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ আবাস গড়া লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে সরে যেতে নির্দেশ দিয়ে মাইকিং শুরু হয়েছে। স্বেচ্ছায় না সরলে অভিযানের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারিও দেয়া হচ্ছে।

বিশেষ করে কক্সবাজার শহরের পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসরত জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে বলা হয়েছে। শহরে পাহাড় বেষ্টিত পাহাড়তলী, লাইট হাউস পাড়া, বৈদ্যঘোনা, ঘোনারপাড়া, বাদশা ঘোনা, কবরস্থান পাড়া, সাহিত্যিকা পল্লী, সার্কিট হাউস এলাকায় ঝুঁকিতে থাকাদের নিরাপদে সরতে বলা হয়। নিজেরা সরে না আসলে আইন প্রয়োগে তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে দেয়া হবে।

কক্সবাজার সদর ভূমি কর্মকর্তা (এ্যাসিল্যান্ড) শাহরিয়ার মোক্তার জানান, জেলা প্রশাসকের নির্দেশে জেলার ঝুঁকিপূর্ণ সব এলাকায় মাইকিং করে মানুষকে নিরাপদ স্থানে যেতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, শহরের লাইটহাউজ, ফাতেরঘোনা, কলাতলী, আদর্শগ্রাম, পাহাড়তলী, বৈদ্যঘোনা, খাজামঞ্জিল, ঘোনারপাড়া, মোহাজের পাড়া, কবরস্থান পাড়া, গরুর হালদা সড়ক, সিটি কলেজ এলাকা, সাহিত্যিকা পল্লী, বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকাসহ ৬টি ওয়ার্ডে পাহাড়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করে। ভারী বৃষ্টিপাতে পাহাড় ধসে এসব এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এসব এলাকার অতীত ইতিহাস এমনটিই বলছে।

এছাড়া মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজার সদরের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা দেখা দেয়ায় সেখানেও মাইকিং করা হয়েছে।

কক্সবাজার বন বিভাগের টেকনাফ রেঞ্জ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, টেকনাফ-উখিয়ায় পাহাড় কেটে বেশি আবাস গড়া হয়েছে। বনভূমিগুলো ন্যাড়া করে বাসা করায় এখানেই পাহাড় ধসের আশঙ্কা বেশি। তাই এদের নিরাপদে চলে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, জেলার পাহাড়ি এলাকায় অবৈধভাবে পাহাড় কেটে সমতল করে বসতি নির্মাণ করা হচ্ছে অনবরত। ফলে প্রতিবছরই ঘটছে পাহাড় ধসের ঘটনা। এতে প্রাণহানি ঘটছে। এরপরও বোধোদয় হচ্ছে না। এ রকম ঝুঁকিতে বাস করছে লাখো পরিবার।

টেকনাফ : ভারি বর্ষণে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের অধিকাংশ এলাকা ডুবে গেছে। সোমবার সকাল থেকে শুরু হয়ে বুধবার পর্যন্ত (এ রিপোর্ট লেখাকালিন) চলা ভারি বর্ষণে উপজেলার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পানিবন্ধি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার পরিবার।

এদিকে কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও কোমর পানিতে ডুবে গেছে বেশিরভাগ এলাকা। সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে টেকনাফের হ্নীলা রংগীখালী, সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ এলাকা।

অপরদিকে প্রধান সড়কগুলোতে পানি ওঠায় দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। নিম্নাঞ্চল হিসেবে রংগীখালী লামারপাড়ার অবস্থা ছিল ভয়াবহ। সেখানকার বেশিরভাগ নিচতলার বাসা-বাড়ি পানি ঢুকে পড়ে। যার ফলে সেখানকার কোন মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। এবং কোন মানুষ পানি বৃদ্ধির কারণে সাহায্য সহযোগিতা করতে প্লাবিত এলাকায় যেতে পারেনি। অনেক পরিবারে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। গতরাত থেকে দুপুর পর্যন্ত অধিকাংশ বাড়িতে চুলায় আগুন পর্যন্ত দিতে পারেনি। বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ।

রংগীখালী লামারপাড়ার বাসিন্দা এনজিও কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ জানান-হঠাৎ এভাবে ভারী বর্ষণ হবে কল্পনাও করিনি। কিন্তু প্রতিবছর এ দুর্ভোগের শিকার হলেও এবছর বর্ষার শুরুতেই এ এলাকায় পানি উঠেনি। তাতে আমরা এলাকার মানুষ খুশিতে ছিলাম। কিন্তু বর্ষার শেষে আচমকা অবিরাম বর্ষণের ফলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরা দ্রুত এ দুর্ভোগ থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে দেখছি একটি কার্যকরি স্লুইচগেইট।

এদিকে প্লাবিত এলাকা হ্নীলা রংগীখালীর লামারপাড়ায় দুর্ভোগের খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান হ্নীলা ইউপির নবনির্বাচিত রাশেদ মাহমুদ আলী। তিনি-ক্ষতিগ্রস্থ ঘর-বাড়ি পরিদর্শন করে বিভিন্ন অলি-গলি দেখে দ্রুত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। এবং স্লুইচ গেইটসহ টেকসই বেরিবাঁধ ও সাইক্লোন সেন্টার নির্মাণের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সাথে আলোচনা করে কার্যকরী পদক্ষেপের কথা বলেন।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: রবিউল হাসান জানান, ভারী বর্ষণে টেকনাফ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম পানিবন্দী হয়ে আছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি এলাকায় পরিদর্শন করেছি বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে তাদের সাহায্য দেওয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, টানা ভারী বর্ষণে উপজেলার বেশির ভাগ নীচু এলাকা প্লাবিত হয়ে উপজেলা পৌরসভার বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে বড় ধরণের বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, পাহাড় ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদেরকে মাইকিং করে সরে যেতে বলা হয়েছে। এরপরেও যদি সরে না আসে বৃষ্টিপাতের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হবে। তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার জন্য প্রতিটি এলাকায় পর্যাপ্ত শেল্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক দিন পরিদর্শন করে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। মানুষের প্রাণহানি যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে প্রশাসন।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বর্ষণ, রোহিঙ্গা
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন