আশ্রয়ণে পাল্টে গেছে মানিকছড়ির সাঁওতাল পল্লীর চিত্র, আনন্দে আত্মহারা সাঁওতালরা

fec-image

খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার পশ্চাৎপদ জনপদে মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত সাঁওতালরা প্রায় ৭ দশক পর সরকারিভাবে ঘর পেয়ে আনন্দে আত্মহারা! আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় লাল-সবুজ টিনের ছাউনির নিচে আধাপাকা ঘরে ঠাঁই পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন প্রয়াত নকুন্দ সাঁওতালের বংশধরেরা।

বয়োবৃদ্ধ সাঁওতাল নেতা ভুট্টো সাঁওতাল (৭২) বলেন, ‌‘আমার প্রয়াত বাবা নকুন্দ সাঁওতাল দেশ স্বাধীনের দুই দশক আগে এই নির্জনে আসেন। এই প্রথম নাগরিক সুবিধা পেয়ে আমরা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। এই মাটিতে বাবা নকুন্দ সাঁওতাল ও বড় ভাই গণেশ সাঁওতালের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের ওয়ারিশ হিসেবে আমরা ৮ পরিবার এখনো বেঁচে আছি। জীবনে স্বপ্নেও ভাবিনি দুর্বিষহ জীবনের অন্তিম লগ্নে মৌলিক অধিকারের ছোঁয়া পাবো! ঘর পেলাম, টিউবওয়েল পেলাম। শুনেছি রাস্তার কাজ চলছে। মরার আগে সরকারি সুবিধা পেয়ে স্বস্তি পেলাম! নতুন প্রজন্মরা অন্ধকার থেকে আলোর দিশারী হয়ে বেড়ে উঠুক এবং সাঁওতাল বংশের বাতি জ্বালিয়ে রাখুক।’
উপজেলার পশ্চাৎপদ জনপদে “ভালো নেই সাঁওতালরা ” এই শিরোনামে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পোর্টালে সংবাদ প্রকাশের পর উপজেলার তৃণমূলে নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত সাঁওতাল জনগোষ্ঠীসহ উপজেলায় পিছিয়ে থাকা অসহায় মানুষের সন্ধানে সরজমিনে বের হন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রক্তিম চৌধুরী। এসব অসহায় পরিবারের আবেদন ও সংবাদ মাধ্যমের তথ্যে জনপ্রতিনিধি, কারবারি ও পাড়া প্রধানকে সাথে নিয়ে ৭-৮ কিলোমিটার মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে অসহায় ও দুর্বিষহ পরিবার খুঁজে বের করেন। আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় প্রথম-৩য় পর্যায়ে ৮টি সাঁওতাল পরিবারসহ মোট ৭২২টি অসহায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টি ও বাঙালি পরিবারে ঘর ও ভূমি নিশ্চিত করা হয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় পশ্চাৎপদ জনপদে থাকা সংখ্যালঘু সাঁওতাল পরিবারসহ দূর্বিষহ জীবনযাপনকারী মানুষগুলো থেকে পাওয়া আবেদন যাচাই বাছাই করে প্রথম-৩য় পর্যায়ে মোট ৭২২টি পরিবারে ২ শতক ভূমি ও আধাপাকা টিনশেড ঘর নির্মাণ শেষ করা হয়েছে। এখন চলছে আরও ২০০টি পরিবারের ঘর নির্মাণ কাজ।

উপজেলার পশ্চাৎপদ জনপদ সাঁওতাল পাড়ার পার্শ্ববর্তী দাইজ্জাপাড়ার কারবারি মংথৈই মারমা বলেন, ‘ইউএনও সাহেব দীর্ঘ ৭-৮ কিলোমিটার দুর্গম রাস্তা পায়ে হেঁটে সাঁওতাল পল্লীসহ বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রতিবন্ধী, বিধবা, ভবঘুরে পরিবার খুঁজে বের করেন! এই সাঁওতাল পল্লী বা দাইজ্জাপাড়ায় আগে কখনও কোন সরকারি লোক আসেনি।’

সুরেশ সাঁওতাল বলেন, ‘গত বছরের এই সময়েও আমরা মাটির ভাঙ্গা ঘরে ছিলাম, কূয়ার পানিতে খাওয়া ও গোসল হতো! আপনারা (সাংবাদিক) যাওয়ার পর আমাদের নিয়ে লিখেছেন বলে অবহেলিত সাঁওতাল পল্লীতে আজ ইটের গাঁতুনি ও লাল টিনের ছাউনিতে আমরা পরম সুখ অনুভব করছি। কালের আর্বতে ছোট হয়ে আসা সাঁওতালের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে স্যালুট।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা( ইউএনও) রক্তিম চৌধুরী বলেন, ‘এখনো উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় অনেক অসহায়, দুস্থ ও অভিভাবকহীন পরিবার রয়েছে এটা ভাবতেও অবাক লাগে! আমি এই উপজেলায় যোগদানের পর সংবাদ মাধ্যমে পশ্চাৎপদ জনপদে থাকা অসহায় মানুষের দূর্বিষহ জীবন সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাঁদের সন্ধানে তৃণমূল চষে বেড়িয়ে সুবিধাবঞ্চিত এসব মানুষের জীবনযাপনে দূর্বিষহতা খুঁজে পাই! বিশেষ করে সাঁওতাল সম্প্রদায়কে প্রধানমন্ত্রীর উপহার দিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। অনেক আগেই এসব পরিবারগুলো সুবিধা পাওয়া উচিত ছিল। এখন পর্যন্ত ৭২২টি পরিবার প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর ও ভূমিতে ঠাঁই পেয়েছে। ৪র্থ পর্যায়ে চলছে আরও ২০০টি পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ কাজ। আগামীতে অসহায় ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারি সুবিধা পৌঁছে দিতে আমরা কাজ করছি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুবিধাবঞ্চিত সকল নাগরিক এই সুবিধার আওতায় আনা হবে।’

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আশ্রয়ণ, মানিকছড়ি, সাঁওতাল পল্লী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন