উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে পাহাড়ের আঞ্চলিক দলগুলো

upazila-election-logo

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি:
বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভাতৃঘাতি সংঘাতে জড়াতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিবদমান আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো। এই সংঘাতে বড় ধরনের হতাহতের ঘটনাও ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগামী ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে যেকোনো সময় বাঘাইছড়ি উপজেলায় ঘটতে পারে স্বশস্ত্র সংঘাতের মতো ঘটনা। আর এই সংঘাতের পূর্ব প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে পরস্পর বিরোধী দুইটি আঞ্চলিক সংগঠনের ব্যানারে থাকা সশস্ত্র ক্যাডাররা। ইতোমধ্যে বাঘাইছড়ি উপজেলা অপরিচিত লোকের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র থেকে।এদিকে নির্বাচনকে ঘিরে এই মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালায় শুরু হয়েছে সশস্ত্র সংঘাত। এরই অংশ হিসাবে রবিবার প্রতিপক্ষের গুলিতে ইউপিডিএফ কর্মী সুদৃষ্টি চাকমা নিহত হয়েছে। স্থানীয়দের :ধারণা অচিরেই প্রতিশোধ হামলা আসতে পারে ইউপিডিএফ’র পক্ষ থেকে। ফলে দিঘীনালার নির্বাচন আদৌ শান্তিপূর্ণভাবে করা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে স্থানীযদের মধ্যে।

এবারের নির্বাচনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এই উপজেলা আবারো দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জেএসএস। এই দলটি বিগত ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত করার পর আরো মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে দলটির একটি সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পুরো রাঙামাটি জেলায় নিজেদের আধিপত্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অন্যতম বাধা হলো বাঘাইছড়ি ও নানিয়ারচর উপজেলা। আর রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলা সদর দখলে নিতে না পারলেও এর আশে-পাশের বেশ কয়েকটি এলাকা ইতিমধ্যে তারা দখলেও নিয়ে নিয়েছে বলে জানা গেছে।

এই সংগঠনটির প্রভাবশালী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আমরা আমাদের দলীয় রাজনীতির কৌশল একটু ভিন্নভাবে পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সংসদে আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার পর জুম্ম সমাজের আত্মবিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, আমরা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে অধিকার হারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠির চাওয়া-পাওয়া আদায়ে এগিয়ে যাবো। তাই আমরা সংসদ সদস্য প্রাপ্তির পর বেশ কয়েকটি উপজেলাও পেয়েছি। বাকিগুলোতে আমাদের প্রতিনিধিদের গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত করতে নেতা-কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

বাহির থেকে কি পরিমাণ দলীয় কর্মী বাঘাইছড়িতে এনেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে এই নেতা জানান, আমরা কয়েকজন দক্ষ কর্মীকে এখানে এনেছি শুধুমাত্র নির্বাচনী কর্মকান্ড পরিচালনা করার জন্য অন্যকিছু নয়।

তবে বাঘাইছড়িতে কর্মরত কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, এই এলাকায় নির্বাচনকে কেন্দ্র জেএসএস জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় শতাধিক সশস্ত্র কর্মীকে বাঘাইছড়িতে এনে জড়ো করেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে। আর এরা অবস্থান করছে, উপজেলার উগলছড়ি থেকে শুরু করে খাগড়াছড়ি নামক এলাকায়।

অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ধরে বাঘাইছড়ি উপজেলায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করা ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল এমএন লারমা সমর্থিত জেএসএস এবারের নির্বাচনে জয়লাভ করতে একটু সমস্যা হবে এই ভেবে এই দলটি এবারের নির্বাচনে যাতে করে প্রতিপক্ষের হাতে ধরাশায়ী না হয়, সেলক্ষ্যে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে দলীয় কর্মী ও সশস্ত্র ক্যাডার।

দলটির একটি পক্ষ থেকে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে উপজেলায় তাদের মিত্রদল হিসেবে পরিচিত পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সংগঠন ইউপিডিএফ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিশ্বজিৎ চাকমা ওরফে হারিহাপ্পাকে নিজেদের সমর্থন দেওয়ায় সংস্কারপন্থী জেএসএস আর ইউপিডিএফ এর ঐক্যের মধ্যে কিছুটা ফাটল দেখা দিয়েছে। আর এই সুযোগটাকে কাজে লাগাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে জেএসএস। তাই নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তিকে ব্যবহার করে হলেও এই উপজেলা আসন দখলে রাখতে চাইছে প্রয়াত এমএন লারমা’র আদর্শে গঠিত সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত জেএসএস (এমএন লারমা) নামের দলটি। তাই তারাও অন্যত্র থেকে নিজেদের দলীয় কর্মীদের এনে জড়ো করছে বাঘাইছড়ি উপজেলায়।

গত তিনদিনে এই দলটি প্রায় দেড়’শ জনের একটি দলকে এনেছে বলেও জানা গেছে। আর বর্তমানে তাদের অবস্থান হচ্ছে উপজেলা সদরের পাশ্বোর্স্থ তুলাবান, রূপকারি, বারকুন্ড ঘাটসহ কয়েকটি এলাকায়।
এছাড়া সরেজমিনে বাঘাইছড়ি গিয়ে দেখা গেছে, বাঘাইছড়ি উপজেলাবাসির একটি অংশের কাছে উপজেলা চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমার একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। যার পেছনের কারণ হলো সুদর্শন চাকমা একটি দলের প্রতিনিধিত্ব করলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারটি সামনে রেখে সকল সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নেন। আর এজন্য তার একটি জনপ্রিয়তা রয়েছে পুরো উপজেলায়। তাই তিনি নিজেও আশাবাদী জয়ের পক্ষে।

এই প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে সুদর্শন চাকমা বলেন, আমি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা সময়ে বিগত দিনগুলো অন্যসব উন্নয়ন কর্মকান্ডের সঙ্গে শুধুমাত্র জলাতঙ্ক রোগের জন্যই প্রায় ৩৫ লাখ টাকার ভ্যাকসিন প্রদান করেছি একেবারেই বিনামূল্যে। এরকম ইতিহাস দেশের অন্য কোনো উপজেলায় এখনো পর্যন্ত নাই বলেও দাবি করেন তিনি।

অপরদিকে বাঘাইছড়ি উপজেলাবাসির সামনেই নিজে বড় হয়েছেন দাবি করে জনগণ তার সাথে কোনো ধরনের বেঈমানী করবেনা বলে জানিয়েছেন সন্তু লারমা’র নেতৃত্বাধীন দল জেএসএস সমর্থিত প্রার্থী বড়ঋষি চাকমা।
এদিকে পরস্পর জাতশত্রু দুইটি আঞ্চলিক দলের মধ্যে নিজেদের আধিপত্যের লড়াইয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে সীমান্তবর্তী এই উপজেলার পাহাড়ি জনপদ। এখানকার বেশকয়েকটি এলাকা থেকে সংঘর্ষের ভয়ে সাধারণ পাহাড়িরা সরে অন্যত্র চলে গেছে বলেও জানা গেছে। এখনো প্রতিদিনই গোলাগুলির ঘটনাও ঘটছে।

নির্বাচনকে ঘিরে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর ভয়াবহ রণপ্রস্তুতি সত্ত্বেও সরকারের দিক থেকে তা নিয়ন্ত্রণের জোরালো কোন উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ফলে আবারো ভাতৃঘাতি সংঘাতের রক্তে রঞ্জিত হতে চলেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদ- একথা অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন