ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারক বাংলাদেশের একমাত্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মণিপুরি মুসলিম

fec-image

বাংলাদেশে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে স্বকীয় সত্তা বজায় রেখে সহাবস্থানকারী একমাত্র মুসলিম ধর্মাবলম্বী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হলো মণিপুরি মুসলিম বা পাঙাল। মূলস্রোতের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস সত্ত্বেও পাঙালরা তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আসছে। মণিপুরি মুসলিম তাদের ধর্মীয়, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলছে। বাংলাদেশের সিলেট ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় এই গোষ্ঠীর অধিকাংশের বসবাস।

কথিত আছে, পিতা মুসলিম ও মাতা মণিপুরির সমম্বয়ে সৃষ্ট নতুন সম্প্রদায় হলো মণিপুরি মুসলিম।

বাংলাদেশ মণিপুরী মুসলিম ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন কর্তৃক ২০১৯ সনের শুমারি অনুযায়ী, মণিপুরি মুসলিমের জনসংখ্যা ১০ হাজার ৯৪৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ পাঁচ হাজার ৬৩৮ জন ও নারী পাঁচ হাজার ৩০৯ জন। নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য আজো বজায় রেখেছে তারা, রয়েছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে মণিপুরীদের সঙ্গে তাদের মিল রয়েছে। তাদের ধর্ম ইসলাম। মণিপুরি মুসলিমদের ঘরবাড়ি, পোষাক-পরিচ্ছেদ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারা স্বতন্ত্র এবং বৈচিত্র্যময়। এই সমাজে ভিক্ষুক নেই। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা থাকে সবসময়ই। অধিকাংশ পাঙাল কৃষিকাজে নিয়োজিত এবং নারীরা তাঁতে কাপড় বুননে টাকা উপার্জন করে।

শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে জানা গেছে, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ও বংশ পরম্পরায় পোশাক পরিচ্ছদেও বেশ লক্ষ্যনীয় পরিবর্তন হয়েছে। পুরুষরা বাঙালিদের মতো শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি পরিধান করেন। নারীরা নিজস্ব তাঁতে তৈরি কাপড় এবং অবিবাহিত মেয়েরা বিভিন্ন রঙ ও কারুকাজ সম্বলিত ‘ফানেক’ (কোমর পর্যন্ত প্যাচানো কাপড়) পরে থাকে। বিবাহিত নারীরা বুক পর্যন্ত প্যাচানো ভিন্ন রঙ ও ডিজাইন করা ফানেক পরে থাকে। কোমরে ছোট কাপড় ‘খোয়াংনাম্ফি’ প্যাচানো থাকে।

বর্তমানে আধুনিক শিক্ষিত মেয়েরা বাঙালিদের ন্যায় সেলোয়ার-কামিজ, মেক্সি, শাড়ি, বোরকা ব্যবহার করে থাকে। নিজস্ব কোমর তাঁতে তৈরি ফানেক বা ব্যবহার্য জিনিসগুলো শুধুমাত্র নিজেদের ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়। ডিজাইনের আধুনিকায়ন ও রপ্তানিকরণের কোনো পরিকল্পনা ও সুযোগ না থাকায় ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমে যাচ্ছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালি ও পাশ্চাত্যের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রভাবে পাঙালদের নিজস্ব গৌরবময় ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে।

বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম অ্যাডুকেশন ট্রাস্টে সভাপতি সাজ্জাদুল হক স্বপন বলেন জানান, পাঙালদের ঐতিহ্যবাহী বাড়ি বিশেষ কারুকাজ, বৈশিষ্ট্য ও নিপুণ কারিগরের এক শৈল্পিক সৃষ্টি। এই ঐতিহ্যবাহী বাড়ি আজ অনেকটা অতীত ও বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। কালের সাক্ষী হিসেবে কয়েকটি বাড়ি সংরক্ষিত রয়েছে।

শিক্ষায় হার প্রায় শতভাগ। তবে উচ্চ শিক্ষার হার অপ্রতুল। মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের পুরুষের প্রধান পেশা কৃষিকাজ আর নারীদের বস্ত্রবুনন। কৃষিকাজ ছাড়াও তারা বাঁশ ও বেত দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কৃষি সরঞ্জাম ও আসবাব তৈরিতে দক্ষ। মেয়েরা কৃষিকাজে পুরুষের সমান পারদর্শী। এছাড়া তাঁতে কাপড় বোনা এবং সূঁচিকর্মে মেয়েদের অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে। তাদের পরিধেয় ফানেক বা চাকসাবির ওপর পাঙাল মেয়েদের সূঁই সুতার সুক্ষ্ম ও নিখুঁত কারুকাজ দেখে বিস্মিত হতে হয়।

সাজ্জাদুল হক স্বপন বলেন, সরকারি চাকরিতে অনেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন। বেসরকারি চাকরি, ব্যবসা ও প্রবাসীসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন অনেকে। নারীদের পোশাকে বৈচিত্র্য রয়েছে। সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে নারীদের নৃত্য, গান মুগ্ধ করে।

পাঙাল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যকে থাবল চোংবা বলে। সাধারণত কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে কিংবা বিশেষ কোনো উৎসবে তরুণ-তরুণীরা আলাদাভাবে এই নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন।

সামজিক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তারা মাতৃভাষা ও ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা বিয়ের অনুষ্ঠানগুলোতে মাতৃভাষা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বিয়ের দিনে ‘কাসিদা’ নামে পরিচিত এক ধরনের লোক ঐতিহ্যবাহী বিয়ের গান ও নাচের অনুষ্ঠান থাকে যা পাঙালদের একান্ত নিজস্ব।

ঈদ মণিপুরি মুসলিমদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। ঈদের দিনে গোত্র বংশ নির্বিশেষে সব শ্রেণির পাঙাল এক কাতারে সমবেত হয় এই বিশেষ দিনটিকে উদযাপন করার জন্য। ঈদের দিনে মেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়ে দল বেঁধে আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যায়। জুম্মা নামাজের আগে খুতবার সঙ্গে মাতৃভাষায়ও বয়ান ও ওয়াজ করা হয়ে থাকে।

মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের বিবাহরীতি বাঙালি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। বিয়ের আগের দিন রাতব্যাপী বর ও কনের বাড়িতে আলাদাভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। বর ও কনের উভয় অনুষ্ঠানে রাতব্যাপী চলে ঐতিহ্যবাহী পাঙাল গান। সব বয়সী লোকজন এই গানের উৎসবে মেতে ওঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ‘থাবালচোংবা’ (পাঙাল নৃত্য)। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে বরের পরনে থাকতো ধুতি। সেসময় হাতি ও পালকির প্রচলনও ছিল, তবে আজ তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম অ্যাডুকেশন ট্রাস্টে সভাপতির অভিযোগ, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থাকলেও কোনো একাডেমি না থাকায় সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা ব্যাহত হচ্ছে। সভা সেমিনার আয়োজনেও অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সূত্র: ইত্তেফাক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন