কাঁটাতারে দুর্বিষহ কাটছে স্থানীয়দের জীবন

fec-image

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঁটাতারের বেষ্টনিতে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের অন্তত কয়েক হাজার স্থানীয় অধিবাসীর জীবন।

রোহিঙ্গাদের স্থান দিতে গিয়ে চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন তারা। তাদের অভিযোগ, প্রতিদিন নানা সমস্যার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নানান অপরাধ কর্মকাণ্ডে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন, কাটাচ্ছেন বন্দি জীবন। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অন্যত্র স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড হলো কুতুপালং। এ কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে লম্বাশিয়া গ্রামে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে বাস নুর জাহান নামের এক নারীর। এই নারী তাদের জীবনের কোনো স্বাধীনতা আছে বলে বিশ্বাস করেন না।

তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের জীবন বন্দি হয়ে গেছে কাঁটাতারের বেষ্টনিতে। অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে যেতে পথে পথে তল্লাশি চৌকি, প্রশ্নের কারণে নানা জটিলতায় পড়তে হয়। নিজের জমির ফসল আনতে গিয়েও একই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এছাড়া রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সংঘর্ষ, হামলা খুন ও গুমের ঘটনাও স্থানীয়দের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে এমন পরাধীন জীবন যাপন করতে হবে, কল্পনাই করেননি নুর জাহান।

একই এলাকার নাজির হোসেনের মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার কারণে কাঁটাতারের বেষ্টনি দেয়াটা জরুরি ছিল। কিন্তু এই কাঁটাতারের বেড়ায় বন্দি আমরাই এখন বন্দি হয়ে পড়েছি। অসুস্থ হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া, সংসারের কেনাকাটা করতে যেতে দীর্ঘপথ হেঁটে যেতে হয়। ঘর পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাশাপাশি আসা-যাওয়ার পথে এপিবিএনকে হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিয়েই দিন কাটছে।

নাজির বলেন, ‘আমার মেয়ে অনার্স পাস করে ঘরে এসেছে। এরইমধ্যে কয়েকটি বিয়েরও প্রস্তাব এসেছে। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে গাড়ি নিয়ে আসা সম্ভব না হওয়ায় বিয়ে ভেঙে গেছে।’

একই এলাকার ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রায়হান বলে, ‘আগে যে রাস্তা ব্যবহার করে স্কুলে যেতাম, এখন ওই রাস্তা বন্ধ। প্রায় আধাঘণ্টা ঘুরপথ বেয়ে স্কুলে আসতে হয়। আবার আসা-যাওয়ার পথে পথে তল্লাশি। এসব কারণে মাঝেমধ্যে ঠিক সময় স্কুলে পৌঁছাতে পারি না। এতে পড়ালেখাতেও সমস্যা হচ্ছে।’

একইভাবে রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তত চারশ’ পরিবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঁটাতারের বেষ্টনিতে বন্দি রয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন।

তিনি বলেন, এখানে চারশ’ পরিবারের সদস্যদের চলাফেরা, জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া, চিকিৎসা, কেনাকাটায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে স্থানীয় পরিবারগুলোর চলাফেরা সহজ করার পদক্ষেপ নেয়া দরকার। রোহিঙ্গাদের সরিয়ে বা ক্ষেত্রবিশেষে কিছু স্থানীয় পরিবারকে সরিয়ে এমন উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

শুধু রাজাপালং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প না; কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আশপাশের অন্তত বারোশ’ পরিবারের সদস্য কাঁটাতারের বেষ্টনিতে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করছেন। চলাফেরায় প্রতিবন্ধকতার মুখে রয়েছেন তারা। এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি।

তাদের অভিযোগ, প্রতিদিন নানাবিধ সমস্যার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নানান অপরাধ কর্মকাণ্ডে আতঙ্কিত অবস্থায় রয়েছেন তারা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অন্যত্র স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন তারা।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ব্যাপক এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। যেখানে কাঁটাতারের বেষ্টনির কবলে রয়েছে স্থানীয় সাড়ে তিনশ’ পরিবার। এদের চলাফেরার জটিলতা নিয়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে একাধিকবার জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো কার্যকরী উদ্যোগ দেখা যায়নি।’

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাঁটাতারের বেষ্টনি স্থানীয়দের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে, বিষয়টি স্বীকার করেছেন ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত এপিবিএনের কর্মকর্তাও।

৮ এপিবিএনের অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আমির জাফর বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য বেষ্টনি এবং তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানীয়রাও যাচাইয়ের মুখে পড়ছে। এ কারণে অনেক সময় স্থানীয়দের সঙ্গে এপিবিএন সদস্যদের কথা কাটাকাটি হয়।’

তবে নিরাপত্তার স্বার্থে এ কড়াকড়ি থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছুদ্দৌজা বলেন, ‘কাঁটাতারের বেষ্টনিতে কিছু স্থানীয় পরিবার বসবাস করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ওখানে সাময়িক কিছু অসুবিধা রয়েছে।

এ বিষয়ে স্থানীয়রা লিখিতভাবে আবেদন করেছেন কিনা জানা নেই। তবে স্থানীয়দের সরানো সম্ভব না। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের কীভাবে আলাদা করা যায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।’ তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করছে মিয়ানমারের ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা। আর স্থানীয় বাসিন্দা রয়েছেন মাত্র ৪ লাখের মতো।
সূত্র: সময় নিউজ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন