খাগড়াছড়িতে বাঙালি পরিবারে রেশন বিতরণে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষিত

fec-image

খাগড়াছড়ি জেলার ৯ উপজেলার ৮১টি বাঙালি (অ-উপজাতি) পরিবারের গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচীতে জানুয়ারী-মার্চ-২০২২ মাসের খাদ্যশস্য বিতরণে খাদ্য মন্ত্রনালয়,খাদ্য অধিদপ্তর ও পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে খাদ্যশস্য বিতরণ করা হয়েছে। বাজারে চাউলের মূল্যের উর্ধ্বোগতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গমের পরিবর্তে চাউল বিতরণ করার নির্দেশ থাকলেও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকেরা গুচ্ছগ্রাম ভিত্তিক রেশন ব্যবসায়ীদের সাথে মোটা অংকের উৎকোচে গমই বিতরণ করায় তোলপাড় চলছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশের আগে জেলা প্রশাসনের তড়িৎ সিদ্ধান্তে এই জটিলতার সৃষ্টি হয় এবং
সুবিধা হাতিয়ে নেয় একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা।

খাদ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য অধিদপ্তর ও পার্বত্য মন্ত্রণালয় থেকে খাগড়াছড়ি জেলার ৮১টি বাঙালি (অ-উপজাতি) পরিবারের গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচীসহ সকল ত্রাণমূলক খাতে গমের পরিবর্তে চাউল বিতরণ বরাদ্দপত্র ছাড় করা হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় স্মারক নং-৫৮তারিখ-০২.০২.২০২২খ্রি, খাদ্য অধিদপ্তর স্মারক নং-১০৯, তারিখ-০২.০২.২০২২ এবং পার্বত্য মন্ত্রণালয় স্মারক নং-৩৫, তারিখ-১৪.০২.২০২২ খ্রি. অফিস আদেশে খাগড়াছড়ির ৮১টি বাঙালি (অ-উপজাতি) পরিবারের গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচীর অনুকূলে ২৫৯৯৭ জন কার্ডধারীর মাঝে জানুয়ারী- মার্চ-২০২২ (তিন মাসের) খাদ্যশস্যের বরাদ্দ ছাড় করা হয়।

এর আগে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের স্মারক নং ৯ তারিখ ২৫.০১.২০২২ খ্রি.মূলে রেশন বিতরণে চিঠি ইস্যু করা হয়। এই চিঠি মূলে মাটিরাঙ্গা, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকেরা রেশনের ডি.ও ছাড় করেন।

পূর্বে প্রতি কার্ডধারী প্রতিমাসে ৩২ কেজি চাউল, ৫৩ কেজি গম পেয়ে আসলেও সম্প্রতি বাজারে চাউলের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ গম মজুদ না থাকায় জানুয়ারী- মার্চ-২২ মাসের বরাদ্দের ছাড়পত্রে প্রতি কার্ডধারীকে ৩২ কেজি চাউলের সাথে ৫৩ কেজি গমের পরিবর্তে ৩৭ কেজি চাউল (১ কেজি গমের পরিবর্তে. ৭১০ কেজি চাউল) অর্থাৎ প্রতি কার্ডধারীর অনুকূলে মাসে ৬৯কেজি চাউল বিতরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

কিন্তু এর আগেই পূর্বের ন্যায় ৩২ কেজি চাউল ও ৫৩ কেজি গম হিসেবে খাদ্যশস্য বিতরণে জেলার দীঘিনালা উপজেলার ১৫ টি গুচ্ছগ্রামের ৪১৮৮পরিবারে, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ৪টি গুচ্ছগ্রামে ১১৭২ পরিবারে, মাটিরাংগা উপজেলার ২৩টি গুচ্ছগ্রামে ৮৭৬৬ পরিবারে সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষা করে উপজেলা খাদ্যগুদাম থেকে রেশন ছাড় (খাদ্যশস্য বিতরণ) করায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রামের একজন চাউল ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে পাইকারী চাউল প্রতি কেজি ৩৪ টাকা,গম ২৯ টাকা। সে হিসেবে যেসব ব্যবসায়ী গম পেয়েছেন তাঁরা লাভবান। কারণ ১ কেজি গম বিক্রি ২৯ টাকা। আর ১ কেজি গমের সমপরিমাণ. ৭১০ কেজি চাউলের মূল্য ২৪ টাকা।
খাদ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারী আদেশ উপেক্ষা করে গম বিতরণের ফলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য নিয়ন্ত্রকেরা ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে মোটা অংকের সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে দীঘিলানা উপজেলার বেলছড়ি গুচ্ছগ্রামের প্রকল্প চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার এখানে ৩৯৮জন গুচ্ছগ্রাম কার্ডধারী পূর্বের নিয়মে ৩২ কেজি চাউল, ৫৩ কেজি গম বরাদ্দ পেয়েছে। আমি সকল কার্ডধারীর মাঝে রেশন বিতরণ সম্পন্ন করেছি।

উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুপ্রকাশ চাকমার মোবাইলে একাধিকবার ফোন করলে তিনি তা রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

মাটিরাঙ্গা উপজেলার তাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রকল্প চেয়ারম্যান মো. পেয়ার আহম্মদ মজুমদার বলেন, আমার অধীনে ৯৯৭ জন গুচ্ছগ্রাম কার্ডধারীর মধ্যে ৬০ শতাংশ পূর্বের নিয়মে চাউল ও গম এবং ৪০ শতাংশ নতুন নিয়মে শুধু চাউল পেয়েছি।

এ বিষয়ে জানতে মাটিরাঙ্গা উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সইলেন্দ্র লাল চাকমা বলেন, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য অধিদপ্তরের আদেশ দৃষ্টিপাত হওয়ার আগেই গত ৩ ফেব্রুয়ারি জানুয়ারী-মার্চ-২০২২ মাসের অ-উপজাতি পরিবারের গুচ্ছগ্রাম কর্মসূচীতে রেশন বিতরণে (ডি.ও) ছাড়পত্র প্রদান (চাউল ও গম উত্তোলনে) দেই।

এছাড়া পানছড়ি উপজেলার ১২টি গুচ্ছগ্রামে ৪১৩৫ পরিবার, মহালছড়ি উপজেলার ৬টি গুচ্ছগ্রামে ১০৮৫.৫ পরিবার,গুইমারা উপজেলার ৪টি গুচ্ছগ্রামে ১৫৮৬ পরিবার, রামগড় উপজেলার ৮টি গুচ্ছগ্রামে ৩২২০ পরিবার,মানিকছড়ি উপজেলার ৬টি গুচ্ছগ্রামে ১৬৭০ পরিবার ও লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার ৩টি গুচ্ছগ্রামে ৩৯২ পরিবারের অনুকূলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকেরা মন্ত্রণালয়ের নির্দিশিত আদেশ মোতাবেক প্রথমে চাউল বিতরণ করেন। পরে গমের পরিবর্তে চাউল বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন।

এদিকে খাদ্য গুদাম সংশ্লিষ্ট জনৈক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সম্প্রতি বাজারে চাউলের দাম বৃদ্ধিতে খাদ্য মন্ত্রনালয় তৃণমূলে চাউলের মজুদ অনুসন্ধানে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে একটি জরিপ চালিয়েছে। তাতে অবৈধ মজুদ না পাওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকারী সকল বরাদ্দে গম বন্ধ রেখে চাউল সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের একক ও তড়িৎ সিদ্ধান্তের ফলে এমন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

খাগড়াছড়ি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীন এ বিষয়ে বলেন, আমরা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়ার আগে সকল উপজেলায় জানুয়ারী- মার্চ-২২ মাসের অ-উপজাতি গুচ্ছগ্রামের রেশনের ডি.ও ইস্যু করি। গুদামের মজুদ অনুযায়ী উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কেউ, কেউ পূর্বের নিয়মে এবং গুদামে গমের মজুদ অনুযায়ী চাউল ও গমের ডি.ওর ছাড়পত্র প্রদান করেন। মন্ত্রণালয়ের গত ২ ফেব্রুয়ারি চিঠি পাওয়ার পর আর কোথাও আদেশের ব্যত্তয় ঘটেনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন