জলবায়ুর প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ

চকরিয়া জনপদ থেকে বিলুপ্তির পথে গরিবের ঢেউটিন ‘গোলপাতা’

fec-image

গোলপাতা বাংলাদেশের একটি সম্ভাবনাময় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতি। গোলপাতা একটি অতি মূল্যবান প্রাকৃতিক অর্থকরী সম্পদও বটে। শক্ত ও অধিক টেকসই হওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের ঘরের ছাউনির কাজে ‘গরিবের ঢেউটিন’ হিসেবে খ্যাত গোলপাতা।

কক্সবাজারের চকরিয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলের লোকালয়ে এক সময়ে খাল, বিল, নদীর তীরসহ সর্বত্রে গোলপাতা গাছ পাওয়া যেত। মাটি লবণাক্ততা ও পলিযুক্ত হওয়ার কারণে বিভিন্ন এলাকায় গোলপাতা গাছের বিশাল সমাহার ছিল। দু’একটি এলাকা ছাড়া উল্লেখযোগ্য
হারে তেমন কোথাও দেখে মেলে না গোলপাতা গাছ। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রয়োজনীয় চাষাবাদ ও সংরক্ষণের অভাবে গোলপাতা গাছ আজ বিলুপ্তির বলে জানা গেছে। উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় গোলপাতা গাছ চাষের অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও সম্ভাবনাময় এ প্রজাতির চাষাবাদ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ বিলুপ্ত হতে চলেছে।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, তিনযুগ পূর্বে উপজেলার উপকূলীয় এলাকার গরিব ও হতদরিদ্র পরিবারের বসতঘরের চাল, গোয়াল ঘরের ছাউনি, ধানের গোলার ছাউনি, পোল্ট্রি মুরগি ঘরের ছাউনি ও চিংড়ি ঘেরের বাসার ছাউনির একমাত্র অবলম্বন ছিল গোল গাছের পাতা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙ্গনসহ সুষ্ঠু পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আজ গোলপাতা গাছ হারিয়ে যাচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিমত। বিশেষ করে উপজেলার খুটাখালীস্থ ফুলছড়ি, টকটকি ঘোনা, বহলতলী, অভ্যন্তরীণ খাল, বিল, নদীর তীর ও মোহনায় প্রচুর পরিমাণে গোলপাতা গাছ জন্মাতো বলে স্থানীয়রা জানায়। তিনযুগ আগেও এসব এলাকায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর মতো জায়গাতে গোলপাতা গাছ দেখা গেছে। গোলপাতা গাছের পরিকল্পিত চাষাবাদ খুব একটা না থাকলেও এসব গ্রামের খালের দু’তীরে এবং নিচু ও জলাভূমিতে প্রাকৃতিক ভাবেই গোলপাতা গাছ জন্মাতো। এসব গোলপাতা গাছের ঘন জংগলে বাঘ দাস, শিয়াল, বন্য মুরগীর অভয় আশ্রম ছিল বলে উত্তর ফুলছড়ি গ্রামের বাসিন্দারা জানায়। বর্তমানে মহেশখালী সাগর তীরবর্তী টকটকি ঘোনা, বহলতলীর এসব এলাকায় বর্তমানে গোলপাতা বিলুপ্তির পথে বললেই চলে।

ইউনিয়নের উপকূলীয় ফুলছড়ি কাঠালিয়া দেখা মেলেছে শুধুমাত্র ০.৫০ একর জায়গায় গোলপাতা রয়েছে। গাছের নাম ‘গোল’ হলেও এর পাতাগুলো দেখতে নারকেল গাছের পাতার মতো। সাধারণত একটি গোলপাতা গাছ লম্বায় ১০ থেকে ১৫ ফুট, কখনও ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়।

উত্তর ফুলছড়ি এলাকার বাসিন্দা নুরুল কবির জানান, গোল পাতা গাছের কোন অংশই কম নয়। গোলপাতা ঘরের বেড়া ও চাল তৈরীতে ব্যবহার করা হয়। পুরনো বা শুকনা পাতা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গোলপাতা গাছের ফল পুষ্টিকর খাদ্য। গোলের রস থেকে সুস্বাদু রস বা তারি তৈরী করা হয়।

খুটাখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রহমান বলেন, ইউনিয়নের উপকূলীয় এলাকা হিসেবে কাঠালিয়া পাহাড় বিস্তীর্ন এলাকায় একসময় গোলপাতা গাছ চাষের অনুকূল পরিবেশ ছিল। বর্তমানে খুটাখালী ছড়া ভাঙ্গন, মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রাকৃতিকভাবে গোলপাতা গাছ জন্মানো হার একেবারেই কমেছে। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে গোলপাতা গাছ চাষ করা হলে পরিবেশ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখবে।

চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন জানান, লবণাক্ত পলিযুক্ত মাটিতে গোলপাতা গাছ ভাল জন্মায়। বিস্তীর্ণ এলাকাসহ খালের ধার ও নদীর চরাঞ্চলে গোলপাতা গাছ চাষের উপযুক্ত স্থান। গোলপাতা গাছের বীজ (গাবনা) মাটিতে পুঁতে রাখলেই চারা জন্মায়। একেকটি গাবনায় ১৩০ থেকে ১৫০টি পর্যন্ত বীজ থাকে।

তিনি আরও বলেন, গোলপাতা গাছ চাষে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়না। এছাড়াও গোলপাতা গাছ চাষে কীটনাশক বা রাসায়নিক সারের কোন ধরণের প্রয়োজন হয়না, পরিচর্যারও তেমন দরকার পড়ে না। বীজ সহজলভ্য ও চাষে ব্যয় কম হওয়ায় গোলপাতা চাষ খুবই লাভজনক বলেও জানান তিনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন