জাতীয় সংসদে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ সংশোধনী বিল- ২০১৪ পাশ

জাতীয় সংসদ

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট:

রবিবার জাতীয় সংসদে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ সংশোধনী বিল- ২০১৪ পাশ হয়েছে। এদিন জাতীয় সংসদে বিলটি প্রস্তাবাকারে পাশের জন্য উত্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং এমপি। তিনি বিলটি পেশ করার পর বিলটি জনমত যাচাই এবং বাছাই কমিটিতে প্রেরণের জন্য কয়েকজন সংসদ সদস্যের প্রস্তাব জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এরপর বিলটি পাশের জন্য স্পিকার কণ্ঠভোট আহবান করেন এবং সংসদ সদস্যদের ভোটে বিলটি পাশ হয়।

রোববার দশম জাতীয় সংসদের চতুর্থ অধিবেশনের সপ্তম কার্যদিবসে বিল তিনটি পাস হয়। এ সময় অধিবেশনে সভাপতিত্ব  করেন ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া।

রবিবার সংসদের বৈঠক বসে বিকাল ৪টায়। শুরুতেই ৭১ বিধিতে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর শুরু হয় আইন প্রণয়ন কার্যাবলী। আইন প্রণয়ন কার্যাবলীর ২ নম্বর সূচিতে এই আইনটি উত্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উ শৈ সিং এমপি। তিনটি পৃথক পৃথক প্রস্তাবে খাগড়াছড়ি রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ সংশোধনী বিল ২০১৪ সংসদে উত্থাপন করেন এবং পাশ করার জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।

তবে বিলটি পাশের আগে জনমত যাচাই এবং বাছাই কমিটিতে প্রেরণের জন্য সংসদ সদস্য এম এ হান্নান, রুস্তম আলী ফরাজি এবং হাজি মোঃ সেলিম প্রস্তাব করে তাদের বক্তব্য পেশ করেন। স্পিকার তাদের বক্তব্য শোনার পর তাদের প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে নিষ্পত্তি করেন এবং এতে বিলটি যাচাই বাছাই কমিটিতে প্রেরণের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।

এদিকে বিলটি জাতীয় সংসদে পাশ করা হলে সোমবার হরতাল এবং মঙ্গলবার থেকে টানা অবরোধের কর্মসূচী ঘোষণা করলেও রবিবার রাতে রহস্যজনকভাবে সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে সকল কর্মসূচী প্রত্যাহার করে নেয় পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ

খাগড়াছড়ি জেলা পিবিসিপি সভাপতি মো. সাহাজল ইসলাম সজল এ বিবৃতিতে বলেন, ‘সংসদের সিদ্ধান্ত না পাওয়ার কারণে’ ও পিএসসি পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে পার্বত্য বাঙ্গালী ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখা কর্তৃক ঘোষিত সোমবারের হরতাল এবং লাগাতার অবরোধ কর্মসূচীর আল্টিমেটাম স্থগিত ঘোষণা করেছে। এদিকে টেলিফোনে বার্তা প্রেরক ও খাগড়াছড়ি জেলা পিবিসিপি’র সাধারণ সম্পাদক এসএম মাসুম রানার কাছে সংসদের সিদ্ধান্ত না পাওয়া বলতে কি বোঝানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেন নি।

উল্লেখ্য, গত ১০ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভা অর্ন্তবর্তকালীর জেলা পরিষদগুলোর চেয়ারম্যান ও সদস্যসহ ৫ জনের স্থলে ১১জন করার অনুমোদন দেয়। পরে জুন মাসে এটি সংসদে উপস্থাপন করা হয় এবং স্পিকার সেটিকে যাচাই বাছাই করার জন্য স্থায়ী কমিটিতে প্রেরণ করেন। গত সোমবার রাতে কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী তিনটি বিলই সংশোধিত আকারে পাশের প্রস্তাব করে রিপোর্ট উত্থাপন করেন।

বিলগুলো হচ্ছে ‘বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিল-২০১৪’, ‘রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিল-২০১৪’ ও ‘খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিল-২০১৪’। রিপোর্টগুলোতে বিল তিনটি পাসের সুপারিশ করা হয়। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিলে ১৪ সদস্যের পরিষদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি ১৩ সদস্যের মধ্যে, মারমা তিন জন, তঞ্চঙ্গ্যাঁ ও চাকমা একজন করে, মুরং একজন, ত্রিপুরা একজন, চাক, খিয়াং ও খুমি একজন করে; বম, লুসাই ও পাংখোয়া একজন করে এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাইরে তিনজন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাইরে মহিলা একজন এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ১ জন মহিলা সদস্য রাখার বিধানের প্রস্তাব করা হয়।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিলে ১৪ সদস্যের পরিষদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি ১৩ সদস্যের মধ্যে, চাকমা তিনজন, মারমা তিন জন, ত্রিপুরা তিন জন ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাইরে থেকে তিন জন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাইরে একজন মনোনীত মহিলা সদস্য এবং একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মনোনীত মহিলা সদস্য রাখার বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে।

রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিলে ১৪ সদস্যের পরিষদে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থেকে চেয়ারম্যান ছাড়া বাকি ১৩ সদস্যের মধ্যে চার জন প্রতিনিধি চাকমা, দুই জন মারমা, খেয়াং, লুসাই ও পাংখোয়া নৃ-গোষ্ঠীর একজন, ত্রিপুরা একজন, তঞ্চঙ্গ্যাঁ একজন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাইরে থেকে তিন জন সদস্য এবং এক জন মনোনীত মহিলা সদস্য ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একজন মনোনীত মহিলা সদস্য রাখার বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বিলটি সংসদে পাশ হওয়ায় ৩ পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য পদে রদবদল আসবে। এর মধ্যে অনেকেই চেয়ারম্যান ও সদস্য হওয়ার জন্য তদবির শুরু করেছেন।

এদিকে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন-১৮৮৯ সংশোধনী বিল ২০১৪ পাশের প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ী বাঙালী স্ব স্ব অবস্থান থেকে এই বিল পাশের বিরোধীতা করে আসছে। এ সংশোধনী বিল পাশের বিরোধিতা করে পাহাড়ী-বাঙালী দুই সম্প্রদায়ের মানুষ এরই মধ্যে মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ জোরালো আন্দোলন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে।

পাহাড়ীদের অভিযোগ, এই সংশোধনী বিল পার্বত্য চুক্তির বরখেলাপ। অন্যদিকে বাঙালীদের অভিযোগ এই সংশোধনী বিল পাশ হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয়দের তুলনায় বাঙালীরা আরো পিছিযে পড়বে।

এ বিষয়ে তিন পার্বত্য জেলা সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি জে এফ আনোয়ার চিনুর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি পার্বত্যনিউজকে বলেন, বাঙালীরা কেন বিরোধিতা করছে তা আমি বলতে পারবো না। তবে পাহাড়ীরা যারা বিরোধিতা করছে তারা শান্তিচুক্তির পর থেকে সরকার যখনই কোনো আইন করতে যাচ্ছে তখনই এর বিরোধিতা করেছে। আমরা চাইছি জেলা পরিষদগুলো পূণর্গঠন করে অচিরেই নির্বাচন দিতে। কিন্তু তারা তো নির্বাচনেরও বিরোধিতা করছে আলাদা ভোটার তালিকার কথা বলে।

এমপি চিনু বলেন, শান্তিচুক্তি অনুযায়ী সরকার জেলা পরিষদের কাছে ২৯টি বিভাগ হস্তান্তর করেছে। মাত্র ৫জন সদস্য দিয়ে এই বিশাল কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয় বলে এর পরিসর বাড়ানো হচ্ছে। তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী বলতে শুধু চাকমা বোঝায় না। চাকমাদের বাইরেও আরো অনেক উপজাতি এখানে বাস করে। সরকার জেলা পরিষদে তাদেরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায়। বর্তমান সংশোধনী পাশ হলে জেলা পরিষদে সবার অংশগ্রহণ ও সহাবস্থান নিশ্চিত হবে বলে তিনি জানান।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন