টেকনাফে ৫ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত: শঙ্কামুক্ত হলেও আতঙ্ক কাটেনি এখনো

komen

মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান, টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি:
বঙ্গোসাগরে সৃষ্ট নিম্মচাপ ‘কোমেন’ টেকনাফে আঘাত হেনেছে। এতে প্রকৃতির নিষ্ঠুর তাণ্ডবে প্রায় ৫০০০ ঘরবাড়ি, পাহাড়ী ও সড়কের গাছ লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে। জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে গাছ চাপায় এক জনের মৃত্যু হয়েছে। টানা এক সপ্তাহ ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

কোমেনের শঙ্কামুক্ত হলেও উপকূল এলাকায় এখনো আতঙ্ক কাটেনি। অনেকে ঘরবাড়িতে যেতে শুরু করেছে। এছাড়া উপজেলার, হোয়াইক্যং, হ্নীলা, বাহারছড়া, টেকনাফ সদর পৌরসভা, সাবরাং ও সেন্টমার্টিনদ্বীপে ব্যাপক ঘরবাড়ী, ঘেরা, গাছপালার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে গাছ চাপা পড়ে এক জনের মৃত্যু হয়েছে। সে পশ্চিম পাড়ার অলি আহমদের ছেলে মোঃ ইসলাম (৫৫)। হ্নীলা লেচুয়াপ্রাং এলাকার মৃত হাজত আলীর ছেলে মোহাম্মদ ইসমাঈল (২৩) উঠানে থাকা বিরাট তুলা গাছ গোয়াল ঘরে পড়ে ৩টি গরু মারা গেছে। গোটা উপজেলায় বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৫ হাজার বাড়ী ঘর।

গাছ চাপা পড়ে অধিকাংশ বাড়ীর দেয়াল ও ঘেরা ভেঙ্গে গেছে। বাতাসে উড়িয়ে গেছে প্রায় বাড়ীর ঘেরা বেড়া। তবে সেন্টমার্টিন ছাড়া কোথাও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রবল বাতাসে নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে শাহপরীরদ্বীপবাসীসহ নিম্মাঞ্চল এলাকার মানুষগুলো পানিবন্দি রয়েছে।

সবচেয়ে বেশী ভোগান্তিতে রয়েছে শাহপরীরদ্বীপবাসী। ভাঙ্গা বেড়ীবাঁধ দিয়ে বঙ্গোপসাগরের পানি ঢুকে সড়কটি বিধ্বস্ত হয়ে গত তিন বছর ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় নৌকা যোগে টেকনাফের সাথে চলাচল করছে। এখন জ্বলোচ্ছাসের ফলে কষ্টের সীমা নেই দ্বীপ বাসীর। সাগরের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে মূল ভূ-খণ্ড।

সেন্টমার্টিন দ্বীপে প্রচুর পরিমাণ নারিকেল গাছ ভেঙ্গে বাড়িতে পড়ে বাড়ি ঘর, হোটেল মোটেল বিধ্বস্ত হয়েছে। শতাধিক ফিশিং ও সার্ভিস বোট বঙ্গোপসাগরের ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙ্গে গেছে। দ্বীপের পশ্চিম পাড়া, ডেইল পাড়া, পূর্ব পাড়া, মাজের পাড়া, কোনার পাড়া, নজরুল পাড়া, দক্ষিণ পাড়ার বিভিন্ন ঘর বাড়ী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙ্গে যায় বাড়িয়ারী বাঁধ।

সেন্টমাটিন সার্ভিস বোট মালিক সমিতির সভাপতি আবু তালেব জানান, কয়েকটি সার্ভিস বোট বঙ্গোপসাগরে নোঙর অবস্থায় হারিয়ে গেছে। সাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-৬ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। কোস্টগার্ড ভবনসহ, স্কুল, সাইক্লোন শেল্টার, হাসপাতালে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে দ্বীপবাসী। ফলে আতংকে রয়েছে গোটা সেন্টমার্টিনবাসী। নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য মাইকিং অব্যাহত রেখেছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। উপকূলীয় ইউনিয়ন বাহারছড়ায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে বাড়ী ঘর।

বড় বড় গর্জন গাছসহ একাশি গাছের চাপায় ব্যাপক ঘরবাড়ী বিধ্বস্ত হয়েছে। বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে বাড়ীর ঘেরা ও টিন। হ্নীলায় বেড়ী বাঁধের উপর দিয়ে নাফ নদীর পানি ঢুকে প্লাবিত হয়েছে দমদমিয়া, হোয়াব্রাং, চৌধুরীপাড়া, রঙ্গিখালী নিম্মাঞ্চল। এছাড়া গাছ চাপায় ৩ টি গরু মারা গেছে। একই অবস্থা হোয়াইক্যং ইউনিয়নেও। সেখানেও গাছচাপা পড়ে ও বাতাসে ঘরবাড়ী এবং ঘেরা বেড়ার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্লাবিত হয়েছে উনছিপ্রাংসহ নিম্মাঞ্চল। পানিতে তলিয়ে গেছে চিংড়ি ঘের।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে আবারো কোমেন এর আঘাত হানার খবরে উপজেলাবাসী আতংক ও উৎকণ্ঠায় রয়েছে। সড়কের উপর গাছ পড়ায় সাময়িক ভাবে যান চলাচল বন্ধ থাকলেও দ্রুত সরিয়ে ফেলায় যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় সাগর ও নদী উত্তাল থাকায় টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিটের যাত্রী ও সেন্টমার্টিনে পারাপারের নৌ-চলাচল ৭দিন যাবৎ বন্ধ রয়েছে। চলাচল বন্ধ রয়েছে স্থল বন্দরের সকল প্রকার মালামাল বহনের ট্রলার। নিরাপদের অবস্থান করছে বন্দরে অবস্থানরত সকল ট্রলার । ভারি বর্ষণের সাথে সাথে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ায় সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।

কৃষিখাতে ১০কোটি টাকারও বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি জীবনযাত্রায় দুর্বিষহ দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট তীব্র বাতাসে মৎস্যঘের ও ধানী জমি পানিতে একাকার হয়ে গেছে। এতে ২৫০টি চিংড়ী খামার ও ২০০টি পুকুরের মাছ পানিতে তলিয়ে যায়। যাতে অন্তত ১০কোটি টাকারও বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মৎস্য অধিদপ্তর দাবী করছে।

অন্যদিকে ১০৫হেক্টর বীজতলা, ২০হেক্টর শাক সবজি, ৮হেক্টর পান, ৫০ হেক্টর আমন ধান সহ প্রায় ৩০লক্ষাধিক টাকা কৃষিকের ক্ষতি হয়েছে বলে কৃষি অফিস সূত্র জানিয়েছে।

এলিট এ্যাকুয়া কালচারের কর্ণধার শিল্পপতি, সমাজ সেবক আলহাজ্ব এইচ.কে.আনোয়ার সিআইপি জানান, এবছরের ঝড়-বৃষ্টি অতীতকে হার মানিয়েছে। নদীর পানি এবং পাহাড়ী ঢল মৎস্যঘেরের সাথে একাকার হয়ে গেছে।

সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার সৈয়দ হুমায়ুন মোর্শেদ মৎস্যখাতে প্রায় ১০কোটি টাকার ক্ষতির কথা স্বীকার করে বলেন, ৭-৮দিন ধরে সিগন্যাল থাকায় জেলেরা নদীতে মাছ শিকার করতে না পারায় তাদের জীবনযাত্রায় অনেকটা দুর্বিষহ দেখা দিয়েছে
সৃষ্ট ঘুর্ণিঝড়ের প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মালামালের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে এখনো প্রচষ্টা অব্যাহত আছে। ঘুর্ণিঝড় “কোমেন” সীমান্ত উপজেলা টেকনাফে ঝড়ো গতির বাতাস পল্লী বিদ্যুতের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি কাটিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পবিসকে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছে বলে গ্রাহক সূত্র জানায়।

এদিকে পল্লীবিদ্যুতের ইঞ্জিনিয়ার হামিদুল ইসলাম লাইনম্যান এবং গ্রাহকদের বরাত দিয়ে এ প্রতিবেদককে জানান, ২১টি বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙ্গে ও হেলে, ২টি স্থানে তার ছিঁড়ে, ৫৩টি জায়গায় লাইনের উপর বড় বড় গাছ, ১৫টি স্থানে ক্রস আর্মস, অসংখ্য ইনসুলেটর, বিভিন্ন এলাকার গ্রাহকদের সার্ভিস তার এবং মিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাতে ১০লক্ষ টাকারও বেশী ক্ষতি হয়েছে।

ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার(ডিজিএম) বলাই মিত্র সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ৩৩কেভি তথা মেইন লাইনের একাধিক স্থানে বড় বড় গাছ পড়ে আছে। তা অপসারণ করে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

টেকনাফের সেন্টমার্টিনদ্বীপের প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান জানান, প্রবল বাতাসে তৈরি ঘূর্ণিঝড় “কোমেন” সেন্টমার্টিনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যা পূর্বের ২০০ বছরকে হার মানিয়েছে। গত বুধবার সন্ধ্যা ৭ টা হতে হালকা বাতাস ও বৃষ্টি হলেও রাত ১১টার পর হতে বাতাসের তীব্রতা ভেড়ে যায়। রাতে প্রবল বাতাসের আঘাতে উড়ে যায় সেন্টমার্টিনের ৯০ ভাগ ঘরবাড়ী, বড় ছোট সব গাছ গাছালি ভেঙ্গে পড়ে মানুষের বাড়িতে, আবার উড়ে গিয়ে সমুদ্রে।

শাহপরীরদ্বীপের ইউপি সদস্য আবদুস সালাম জানায়, জালিয়াপাড়া, ক্যাম্পপাড়ায় প্রায় ৪’শ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়ে সাগরে গর্ভে তলিয়ে যায়। সাইক্লোন শ্লেন্টারে এখনো ২ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মোজাহিদ উদ্দিন জানান, উপকূলীয় ইউনিয়ন সেন্টমাটিন ও শাহপরীর দ্বীপে ৩ টি করে পৃথক ৬টি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো সেন্টমার্টিন ও সাবরাংয়ে সর্বশেষ খবররা খবর তদারকি করছে। এছাড়া উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির উদ্যোগ নিরাপদে আশ্রয় নেয়ার জন্য প্রচারণা অব্যাহত রয়েছে এবং শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। ৬০ টি আশ্রয় কেন্দ্রে প্রায় ৭০০০ লোক নিরাপদে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হোটেলসহ অস্থায়ী সাইক্লোন শেল্টার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন